আমার সাইকেল কেনা

প্রকাশ | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৩০ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:২৭

রেজাউল মাসুদ

সব সাইকেলগুলো স্কুল মাঠের এক পাশে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হতো। স্কুল ছুটির পর দেখতাম সিনিয়র ভাইরা বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে যে যার সাইকেলে চেপে মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের বাঁকা পথ ধরে এই সাইকেলের সারি দূরে চলে যাওয়ার দৃশ্যটি ছিল দারুণ। মনের গহীনে আশা বাধতে থাকে আমারো যদি এমন একটা সাইকেল থাকতো!

সে রাতে একটুও ঘুমুতে পারিনি। নতুন সাইকেল কেনার উত্তেজনা ছিল পুরো বাড়ি জুড়ে। সকালের ট্রেনে আমি আর আব্বা রওয়ানা দিই। এটা ছোটখাট কোনো ঘটনা ছিল না, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ছেলেকে ফনিক্স সাইকেল কিনে দেওয়ার বিরাট ঘটনা। দুঃসম্পর্কের এক ভগ্নিপতি যিনি সাইকেল মেকানিক হিসাবে বেশ খ্যাতি ছিল। বাড়তি সতর্কতায় সুদুর ময়মনসিংহ শহরে তাকে নিয়ে যাই অরিজিনাল মেড ইন চায়না ফনিক্স সাইকেল কেনার মিশনে।

“এইটে বৃত্তি পেলে তোমায় সাইকেল কিনে দিব।” আব্বা বেসরকারি স্কুল শিক্ষক। যে চাকরি, যে বেতন তাতে সহসাই একটা সাইকেল কেনার কথা ভাবা যায় না। সংসার চালিয়ে দুইটা পয়সা জমানোর কোনো উপায় নেই, ছোটবেলাতেই এটা আমি বুঝেছি। কিন্তু একটি সাইকেল তো প্রয়োজন। বৃত্তির রেজাল্ট পাওয়ার আনন্দের সাথে প্রথম যে অনুভুতি কাজ করছিল তা হলো আমার একটা সাইকেল হয়ে গেল। তখনকার সময়ে আমাদের গ্রামে হাতেগোনা কয়েকটি সাইকেল ছিল। আমার এক কাজিনের নতুন ফনিক্স সাইকেল কেনায় এলাকায় হৈচৈ বেধে যায়। দুরদুরান্ত থেকে লোকজন তার সাইকেল দেখতে আসে, ফনিক্স সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় সবাই তার দিকে তাকিযে থাকত, তার মাঝে সবসময় একটা হিরোইজম ভাব কাজ করত।

নব্বই এর দশকে তখনকার সময় ডাকাত দলেরা গ্রামের এমন ছেলেদের টারগেট করে অপহরণ (গ্রামের ভাষায় হাইজ্যাক) করে মুক্তিপণ আদায় করত। আমার সেই কাজিনকে এক রাতে ডাকাত দলেরা উঠিয়ে নিয়ে যায়, চৌদ্দদিন পর পঞ্চাশ হাজার টাকার মুক্তিপণে তাকে উদ্ধার করা হয়। এমন ঘটনায় আমাদের পুরো এলাকা জুড়ে ভয় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ডাকাতরা আমায়ও তেমন উঠিয়ে নিবে এমন কথা ভাসতে থাকে চারদিকে। এরকম অস্থির পরিস্থিতে কত রাত যে গরীব মানুষের বাড়িতে থেকেছি তার হিসাব নেই। রাত নয়-দশটার দিকে আম্মা তার শাড়ির আঁচলে আমায় ঢেকে দোয়া দরুদ পরে ফু দিয়ে পার্শ্ববর্তী গরীব মানুষদের ঘরে রেখে আসত।

এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আব্বা এক সকালে হঠাৎ ঘোষণা দেয়, সাইকেল কেনা হবে না!  নতুন সাইকেল কিনেই নাকি আমার কাজিনটা বিপদে পড়েছে। মন খারাপ হয়ে যায়। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যেন আমার। একদিকে ভয় আরেকদিকে না পাওয়ার হতাশায় দিন কাটতে থাকে। আম্মাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত, আব্বার সিদ্ধান্ত বদলে আপা মূল ভুমিকা নেয়।

একটা সাইকেলই আমার শৈশবের আনন্দের অনেক বড় উপাদান হয়েছিল। সুযোগ পেলেই চুপিসারে আব্বার সাইকেল হাতে নিয়ে তার সাথে হাঁটতাম। তারপর বাঁকা হয়ে মাঝখানের ফাঁকা দিয়ে পা ঢুকিয়ে অনেক কসরত করে চালানো, এরপর একটু একটু সাইকেলে চড়তে শেখা। অনেক ছোট্ট তাই সিটে বসে প্যাডেল নাগাল পেতাম না! তারপর এক দিন হঠাৎ করে রডের উপর বসে " ব্যথা " উপেক্ষা করে সাইকেল চালিয়েই ফেললাম। প্রথম যেদিন পুরোপুরি সাইকেল চালালাম তখন মনে হয়েছিল আমার চেয়ে পৃথিবীতে বুঝি আর কেউ অতটা সুখী নয়।

সেই সাইকেলের কথা ভাবতেই প্রথমে মনে পড়ে আব্বার ব্রেকবিহীন, রঙ ওঠা, জরাজীর্ণ দুইচাকার যানটার কথা! কত দিন হয়ে গেল! সেই ব্রেকহীন সাইকেলও নেই, আব্বাও নেই। সহকারী প্রধান শিক্ষক বাবার সাইকেলের পিছনে চড়ে কত মাঠ, কত সবুজ পার হয়েছি, কতশত বার ডুবে গিয়েছি আব্বার গল্পের সাথে গভীর নীলে! কত ধুলা মাখা পথ, দূরদুরান্ত কয়েকগ্রাম পাড়ি দিযে আব্বার সাথে স্কুলে যেতাম। সাইকেলে বসে আব্বার গায়ের গন্ধ পেতাম, কি একটা নেশার মতো প্রশান্তি যেন। এটা কি ওটা কি বলে আব্বাকে কতই না ব্যস্ত রাখতাম। গ্রামের স্কুলে বেশিদিন পড়া হয়নি আমার। আমার মা যিনি প্রতিটি ব্যাপারেই অত্যন্ত বিচক্ষণ ছিলেন। ক্লাস থ্রি থেকে ফোর এ উঠতেই আব্বার হাই স্কুলের সাথে দুরবর্তী ভালো এক প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেয় আমায়।

অবশেষে আব্বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কিনে দিলেন। তখন ক্লাস নাইনে আমি। বছরের কয়েকমাস চলে গেছে। কাঙ্খিত সেই ফনিক্স সাইকেল। কি গতি ! আর কি সুন্দর দেখতে! আমি যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকলাম!  স্কুলে যাওয়াটাই ছিল প্রধানতম কাজ। সাইকেল সবসময় ঝকঝক রাখতে আর নানা কারণে নিয়মিত মেকানিকের কাছেও যেতাম। বাড়িতে এসে দানাপানি কিছু মুখে দিয়েই কোথাও আবার শা করে চলে যাওয়াও ছিল অনেকটা নেশার মতো।

 

আশে পাশের বাজার, কত বাড়ির অলিগলি ঘুরেছি তার ইয়ত্তা নেই। স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সাথে এই সাইকেলেই নান্দিনার ময়নামতি কিংবা মুক্তাগাছার রানা মুন রুমা সিনেমায় যাওয়াও ছিল নিয়মিত ঘটনা। তখন রাস্তায় বাস স্কুটার কিংবা অন্য কোনো যানবাহন নিয়মিত ছিল না। বন্ধুদের পাল্লায় মাঝে মাঝে ত্রিশ চল্লিশ কিমি দুরে জামালপুর শহরের নিরালা, কথাকলি সিনেমায়ও গিয়েছি এ দ্বিচক্রযানেই।

জীবনে যে ক’টা শিক্ষা আমার সত্যি সত্যি কাজে লেগেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সাইকেল চালানো শিক্ষা। গ্রামের মেঠো ঝড় বৃষ্টি ধুলো ধূসরিত পথে সেই কৈশোরে বাবার ব্রেকহীন সাইকেল কিংবা বৃত্তির ফনিক্স চালিয়ে যে বর্ণিল আনন্দ পেয়েছি আজকের পরিণত বয়সে দ্রুত গতির পিচ ঢালা পথে অকটেনের পাজেরো চালিয়েও সেই আনন্দ কখনোই উপলব্ধি করি না !

লেখক: বিশেষ পুলিশ সুপার, সিআইডি

ঢাকাটাইমস/২৩সেপ্টেম্বর/এসকেএস