বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার জন্য স্বর্ণোজ্জ্বল দিন

প্রকাশ | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:১২

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষি মানুষের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন আজ। ১৯৭৪ সালের আজকের দিনটি নিঃসন্দেহে বিশ্বের বুকে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ এই দিনে জাতিসংঘে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন, বাঙালির জন্য একটা পরম পাওয়া। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে ছিলেন। তেমনি বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতিসংঘের সদস্য পদ অর্জনের পর সেখানে প্রদত্ত বাংলা বক্তৃতার মাধ্যমে বাংলাভাষাকে আরও সুউচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। আর এই কারণে আজকের দিনটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই গর্বের দিন নয় এটি গোটা বাঙালি জাতির জন্যই গৌরবের।

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘আপনি ইংরেজীতে বক্তৃতা করবেন’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন; ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের আট দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু সাধু বাংলায় জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘মাননীয় সভাপতি আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তষ্টির ভাগিদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙিক্ষত ছিলেন। যে মহান আর্দশ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত রহিয়াছে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদদের বিদেহী আত্মা ও মিলিত হইবেন।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন দানকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়া বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যাহাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজে স্থানলাভ করিয়াছে এই সুযোগে আমি তাহাদের অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ছিল শান্তি ও ন্যায়ের মিলিত সংগ্রাম। জাতিসংঘ গত ২৫ বছর ধরিয়া এই শান্তি ও ন্যায়ের জন্যই সংগ্রাম করিয়া যাইতেছি।

বঙ্গবন্ধু জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশে দেশে সেনাবাহিনী ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানান এবং বাংলাদেশেসহ চারটি দেশ আলজেরিয়া, গিনিবিসাউ এবং ভিয়েতনামের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘এই দেশগুলো অপশক্তির বিরুদ্ধে বিরাট বিজয় অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে। চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস জনগণের পক্ষেই থাকে’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিন, জাম্বিয়া, নামিবিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

বঙ্গবন্ধু আরও বলেন,‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই উপমহাদেশের শক্তি কাঠামো সৃষ্টি করিয়াছে। আমরা শান্তি চাই। আর এই জন্যই অতীতের সকল গ্লানি ভুলিয়া যাইতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘জাতিসংঘের সদস্য ও সম্ভাবনার যে দিক বাংলাদেশ উপলব্ধি করিয়াছে, আর কেউ তেমনটি করিতে পারে নাই।’

বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘সম্মানিত সভাপতি, মানুষের অজয় শান্তির প্রতি আমার বিশ্বাস রহিয়াছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ অসম্ভবকে জয় করিবার ক্ষমতা রাখে।’ তিনি উদাত্ত কন্ঠে বলেন, অজয়কে জয় কারিবার সেই শক্তির প্রতি অকুন্ঠ বিশ্বাস রাখিয়াই আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিবো। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো সেই সব দেশ দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, কেবল তাদেরই এই দৃঢ়তা ও মনোবল রহিয়াছে, মনে রাখিবেন সভাপতি, আমরা বাঙালি জাতি চরম দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিবেনা, টিকিয়া থাকিবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার জনগণের দৃঢ়তাই আমাদের প্রধান শক্তি।’

বঙ্গবন্ধুর বাংলার এই ভাষণ ১৯৭২ সালেই হতে পারত কিন্তু  চীন বারংবার ভেটো দিয়ে জাতিসংঘে আমাদের সদস্য হওয়ার পথ রুদ্ধ করে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ধারাবাহিকতায় তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছেন। তিনি বাংলাকে জাতিসংঘের সপ্তম দাপ্তারিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। নারীর ক্ষমতায়নকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যাপ্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন বলে উল্লেখ করে নারী শিক্ষা প্রসার নিয়ে কথা বলেন।

তিনি আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশের নারীরা এখন উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। সকল পেশার নারীর অংশগ্রহণের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন এটা বোধ হয় ব্যতিক্রম ব্যাপার যে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধী নেতা, স্পিকার, সংসদে উপনেতা সকলেই নারী।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম স্বাধিকার আন্দোলনের প্রস্তুতি ও দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ। ২৫ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণটিও ছিল তেমনি সমগ্র বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত নির্যাতিত নিস্পেষিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত ও অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব শান্তি, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়