সত্যের সাথে দাঁড়াও, যদি তা একা করতে হয় তবুও

রেজাউল মাসুদ
 | প্রকাশিত : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:০৯

প্রথম শ্রেণির ননক্যাডার অফিসার সে। নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থে উপজেলা পর্যায়ের যেকোনো কর্মকর্তাকে তোষামোদি আচরণে স্যার ডেকে ফেনা তুলে সখ্য করে ফেলায় বেশ পারঙ্গম সে। মাদক ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না তার, একসময় গাঁজা-ফেনসিডিল সেবন করতো, হেরোইনও নিত সময় সময়, এখন ইনজেকশন এবং নিয়মিত ইয়াবা সেবন করে সে। রিহ্যাবে ভর্তিও ছিল বেশ কিছু সময়। মাদক ছাড়তে পারেনি তাই এখন পায়ে পচন ধরেছে অথচ লোকজনদের বলে বেড়ায় ছাত্রাবস্থায় জঙ্গি দমনে গ্রেনেড হামলার শিকারে তার এ অবস্থা।

তার নামে একাধিক মামলা। বেশকিছু অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জেলও খেটেছে অনেক দিন। একটা স্টেশনে বেশিদিন সে থাকতে পারে না। টাকা-পয়সা লেনদেনসহ অনৈতিক অভিযোগের শেষ নেই যেন। তার সাথে যার সমস্যা হয় তাদের নামে মিথ্যা মামলাও সে করে প্রতি স্টেশনে।

পাওনা টাকা যাতে পরিশোধ করতে না হয় এমন ভাবনায় মিথ্যা মামলা করার খায়েশ হয় ননক্যাডারের। চাঁদাবাজি হত্যাচেষ্টা এবং গুরুতর জখমের অভিযোগ এনে চারজনের নামে থানায় মিথ্যা মামলা করার প্লান চূড়ান্ত করে সে। চারজনের প্রথমজন তার কাছে ৯ লাখ টাকা পাবে। কোনোভাবে টাকা দিচ্ছিল না সে, অবশেষে টাকা না পেয়ে পাওনাদার নন ক্যাডার অফিসারের নামে কোর্টে মামলা করে। এই মামলা থেকে বাঁচতে মিথ্যা মামলার নাটক সাজায় সে। তার অফিসের দুজন কর্মচারীকে সাক্ষী হিসেবে টাকা দিয়ে বশে আনে। উপজেলার বড় বড় কর্তাদের তার পক্ষে বলতে অনৈতিকভাবে কনভিন্স করে ফেলে সে।

রাতের বেলায় এক কলেজ মাঠে তাকে আটক করার নাটকের দৃশ্য মঞ্চস্থ হয়। অভিযোগে বলা হয়, হত্যার উদ্দেশ্যে একজন তাকে আক্রমণ করে। আরেকজন তার হাত-পা বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করে, তাতে তার নাক-মুখ দিয়ে গলগল রক্ত বের হয়। পূর্বপরিকল্পনানুযায়ী থানা পুলিশের কাউকে ফোন না করে উপজেলার বড় কর্তাদের ফোন করে সে। নাটকের শেষ দৃশ্যে সে উদ্ধার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, নির্মম নির্যাতনের শিকার অসহায় সরকারি কর্মকর্তা আবেগী স্টাটাস দেয় ফেসবুকে, মানুষের সিমপ্যাথিসহ নানা মন্তব্যের বন্যায় ভাসতে থাকে সে, হাসপাতাল থেকে গুরুতর জখমের সার্টিফিকেটও পেয়ে যায় ভর্তির আগেই।

উপজেলা কর্তার ওসিকে ফোন, ওসি সাহেব দন্ডবিধির ৩০৭, ৩৮৫ ৩২৬ ধারায় মামলা নিবেন। কত বড় সাহস, রাতের আঁধারে আমার উপজেলায় একজন ননক্যাডার কর্মকর্তাকে হত্যা করতে হামলা, এসব বরদাশত করা হবে না বলে হাক্কানি দিয়ে উঠে বড় কর্তা।

ওসির কাছে সে রাতেই এজাহারের ড্রাফট চলে আসে, মিথ্যা অভিযোগ এবং ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায় ওসি, বড় বড় কর্তাদের উপর্যুপরি ফোন এবং নানামুখী চাপে অবশেষে ওসি জেলার এসপির কাছ থেকে মামলা রেকর্ডের পারমিশন নেয়। ননক্যাডার কর্মকর্তা তার অফিসের পিয়ন, পাইক পেয়াদা, উপজেলার বড় কর্তারা রাজ্য জয়ের স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে থাকে, ফুর্তিতে মেতে উঠে তারা। রাত শেষ হতেই মামলা, এফআইআর, আসামি এরেস্ট, রিমান্ড, আহ কি ক্ষমতা, কি আনন্দ, কত মজা। এক ফোনেই নাটক মঞ্চস্থ, কত বড় সাহস! আমার কাছ থেকে পাওনা টাকা নিবে, দেখাব চৌদ্দ শিক!

কিন্তু ভোরের আলো না আসতেই রেজাউল মাসুদের কাছে অভিযুক্ত চারজনের মূল ব্যক্তিটি এক রেফারেন্সে পৌঁছে যায়। রেজাকে জানানো হয় ননক্যাডারের ঘটনাটা মিথ্যা এবং পুরোটাই সাজানো নাটক, সত্যের লেশমাত্র এখানে নেই। অভিযুক্তগণ ঘটনাস্থল থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে ছিলেন সেদিন, এমনকি গত ছয় মাসেও তারা সে ঘটনাস্থলে আসেনি। ‘প্লিজ স্যার আমাদের বাঁচান, রক্ষা করেন। আমার ছোটভাইটি ইংল্যান্ডে যাওয়ার সব কিছু ফাইনাল হয়ে আছে, এখন এ মুহূর্তে মিথ্যা মামলা রেকর্ড হলে আমরা চরম বিপদে পড়ে যাব।’ রেজার সাইবার ইন্সট্রুমেন্ট কাজ করতে থাকে। ততক্ষণে ওসির সাথে কথা হয়ে যায় কয়েকবার। রেজাকে জানানো হয় মামলাটি সরকারি কর্তার, তাকে মারধর করা হয়েছে তাই রেকর্ড করতেই হবে। উপজেলার বড় কর্তাদের উপর্যুপরি চাপ তদবির রয়েছে। রেজার আবার ফোন এবার একটু কড়া ভাষায় ‘এমন একটি ডাহা মিথ্যা মামলা রেকর্ড না করলেই কি নয় ওসি সাহেব।’ স্যার সত্য-মিথ্যা যাই হোক আমার রেকর্ড করতেই হবে। কিছু করতে হলে আপনি আমার আলফা ওয়ান স্যারকে বলুন।

জেলার এসপিকে রেজা ফোন করে। এসপি রেজার কথা বিশ্বাস করে সার্কেল এডিশনাল এসপিকে ঘটনাটি সরেজমিনে দেখার দায়িত্ব দেয় । একদিন সময় পাওয়া যায়, ততক্ষণে সাইবার রেজাল্ট চলে আসে রেজার কাছে। অভিযুক্তরা এ ঘটনার সাথে কোনোভাবেই যে সংশ্লিষ্ট নয় তা ডিজিটাল ইভিডেন্সে জ্বলন্ত হয়ে ধরা দেয়। নেপথ্যে কে কে রয়েছে, মহাশয়তানির কলকাঠি কোন কোন বড় কর্তা নেড়েছে আইটি ফরেনসিকে তারও দৃশ্যমান হয়। এডিশনাল এসপি থানায় যায়, মেইল করে সব তথ্য তাকে দেওয়া হয়। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সে, রেজার সাথে সার্বক্ষণিক কথা হয়েই যাচ্ছে তার। অবশেষে মিথ্যা মামলা রেকর্ড না করতে সিদ্ধান্ত দিয়ে আসে এডিশনাল এসপি। ততক্ষণে খবর চলে যায় নাটক মঞ্চস্থকারীদের। ননক্যাডার স্টাটাস দেয়, ‘থানা মামলা নিতে গড়িমসি করছে কিন্তু উপজেলার বড় বড় কর্তারা আমার পক্ষেই রয়েছে।’

পরের দিন আরেক ধাপে জোর প্রচেষ্টা চালায় উপজেলার বড় কর্তাদের নিয়ে, যে কোনো উপায়েই মামলা রেকর্ড করতে তৎপর তারা। রেজার কাছে খবর আসে আজ যেনতেনভাবে থানায় মামলা হবে, বিষয়টা রেজার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। রেজা এসপিকে আবার ফোন করে। এসএমএস, মেইল করে ডিজিটাল ইভিডেন্স পাঠায় এসপিকে। এসপি রেজাকে আশ্বস্ত করে , ওসিকে কড়া হুঁশিয়ারি করে জানিয়ে দেয় এই মিথ্যা মামলা হবে না, যদি উপজেলার কর্তাদের কথায় ওসি তুমি ফলস কেইস রেকর্ড করো তবে সাথে সাথেই তুমি এ থানা থেকে প্রত্যাহার হবে।

মিথ্যা মামলা থেকে বেঁচে যায় চারটি মানুষ , বেঁচে যায় চারটি পরিবার। ফোনে হাউমাউ করে কান্নায় যেন রেজার কাছে তাদের একমাত্র কৃতজ্ঞতার ভাষা । শুধু বলে আল্লাহ্ আপনার মঙ্গল করবেন সবসময়ই, যেখানেই থাকুন যে অবস্থায়ই থাকুন।

যে উদ্দেশ্যে লেখা

চরম খারাপ হলো ননক্যাডার অফিসারটি, যে মিথ্যা মামলার নাটক সাজিয়েছে, বেশি খারাপ হলো তার অফিস সহায়ক যারা তার কুকাজে সহযোগিতা করে সাক্ষী হয়েছে, খারাপ হলো উপজেলার কর্তারা যারা নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, খারাপ হলো স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যিনি মিথ্যা জখমী মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়েছে। খারাপ হলো দালাল লোকটি যে ওসির সাথে মধ্যস্থতায় কনভিন্স করছে।

দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে বাদীর বিরুদ্ধেও একই ধারায় পাল্টা মামলা করা যায়। ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন আদালত।

থানা, পুলিশ কিংবা ওসি একটা ইন্সট্রুমেন্ট, কমান্ড বক্স, রাষ্ট্রযন্ত্র মাত্র। অথচ দিনশেষে এরাই ভিলেন। যত দোষ এসআই ওসি এসপির। যত খারাপ যেন পুলিশই!!

একটি যন্ত্র যখন প্রতিহিংসাপরায়ণ, অনৈতিক বা আর্থিক লাভবান কিংবা খারাপ উদ্দেশ্য হাসিলে সবসময় ব্যবহ্রত হবে, যন্ত্র তখন নিজে থেকেই সময় সময় খারাপ হয়ে উঠতে পারে প্রকৃতির নিয়ম এটিই।

লেখক: বিশেষ পুলিশ সুপার, সিআইডি

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :