‘হঠাৎ দুর্যোগে’ কোথায় আশ্রয় পায় হাওরের মানুষ?

রুহুল আমিন শিপার
 | প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৫৫

পরশু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম। নরসিংদী সদর, বেলাবো উপজেলায় কাজ সেরে কুলিয়ারচর এসে জলপথে অষ্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সঙ্গে ডিআইজি হায়দার ও ডিআইজি মাহবুব। কালনী নদীর উজানে স্পিডবোটে যেতে যেতে অদ্ভুত এক বসতঘর চোখে পড়ে। চারিদিকে পানি আর মাঝখানে একবিন্দু বসতি। মাত্র একখানা ঘর। কী বিচিত্র বাস্তুসংস্থান! এটি ভূগোল অথবা সমাজবিজ্ঞানের শুধু পাঠ্য না, অবশ্য পাঠ্য।

বেলা বারোটার পরে যখন অষ্টগ্রাম থানায় পৌঁছাই তখনো ঝকঝকে রোদ। পরিদর্শন শেষে জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে যাওয়ার পথে কুহেলির ফোন।

–ওখানে আবহাওয়া কেমন?

মাহবুব বলে,

–ভাবীকে বলো আকাশে-বাতাসে ভিটামিন ডি।

সেটাই বললাম।

কুহেলি বলল,

–ঢাকায় কিন্তু একদম অন্ধকার। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।

–নামুক

লাঞ্চ শেষ করে দেখি ঢাকার মেঘ ততক্ষণে অষ্টগ্রামে পৌঁছে গেছে। দেখতে দেখতে ‘কঠিন তুফান’ শুরু হয়ে গেল। একখানা ছোটখাটো ঘূর্ণিঝড়। ঘণ্টাখানেক পরে অবশ্য সব শান্ত হয়েছে। কুলিয়ারচর থানার ওসি সুলতান মাহমুদের ভাষ্যমতে হাওরে নাকি এমনটা প্রায়ই হয়। জীবিকার সন্ধানে হাওরের মাঝে থাকা মানুষ এমন ‘হঠাৎ দুর্যোগে' কোথায় আশ্রয় পায়? বিশেষ করে বজ্রপাত হলে?

সুলতান বলেন, আশ্রয়ের সুযোগ কম। ক'দিন আগে বজ্রপাতে সাতজন মারা গেছে। অনেক সময় রাতে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসে না। ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবি হলে সলিলসমাধিই নিয়তি। কখনো লাশ মেলে, কখনো মেলে না।

ঝড় থামলে আমরা অষ্টগ্রাম-ইটনা-মিঠামইন সড়ক ধরে অনেক দূর যাই। রাস্তায় বিস্তর ইজিবাইক, ডিজেলচালিত অটোরিকশা চোখে পড়ে। নসিমন-করিমন টাইপের ‘ট্যুরিস্ট বাসে’ হাল ফ্যাশনের ঢাকাই তরুণীদের ‘এক পশলা’ দেখেছি বলে মনে হলো। এরা দলবেঁধে এসেছে। স্থানীয় ছেলেমেয়েও আছে অনেক। একটা ব্রিজে গাড়ি থামিয়ে আমরা নেমে পড়লাম। পুলিশ দেখে ভিড় একটু সরে গেল, কেউ কেউ স্থান ত্যাগ করলো। আমরা কিন্তু অতটা ‘খারাপ না’ যে কাউকে ‘সটকে পরতে' হবে। কিন্তু সেটা এদের বোঝাবে কে?

হাওরের পানি নামছে। ব্রিজের ওপর থেকে দেখছি ধীরগতির স্রোতধারা ভাটির দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। শেষ বিকালের রোদ সেখানে চকচক করছে। নভেম্বরের শেষ অব্দি পুরোপুরি নেমে যাবে। তখন শুরু হবে বোরো আবাদ। এ অঞ্চলে এই একটাই ফসল। মার্চ-এপ্রিলে আবার পানি আসতে শুরু করবে।

এই সড়কের প্রশংসা করতেই হয়। রাস্তা আছে আর ঘরবাড়ি, অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, মুদিখানা নেই এমন জায়গা এই বঙ্গে কোথাও পাবেন না, কেবল অষ্টগ্রাম ছাড়া। আদিগন্ত জলরাশির মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া এই দৃষ্টিনন্দন সড়কের প্রশংসা করতেই হয়। বাংলার বিখ্যাত ট্রাক ড্রাইভারদের খপ্পরে না পড়ায় এর স্বাস্থ্যও বেশ ভালো। তবে 'উনারা' নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। মাত্র ক'দিনের অপেক্ষা।

সড়কের দু'ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ি। জলমগ্ন। নিচ থেকে ইটের ভিত দিয়ে তার উপর থাকার ঘর, গোয়াল ঘর ইত্যাকার সব। একের ভেতর সব। যাকে বলে কমপ্যাক্ট। তবে চারিদিকে কোনো বেড়া নেই দেখে খুব অবাক হয়েছি। ছোট ছোট শিশুদের আগলে রাখে কে? নাকি এ জীবনের সাথে ওরাও অভ্যস্ত? হতে পারে শিশুরাও অভিযোজনের বিষয়টি জানে। আমার মাথায় অন্য বিষয় ঘুরছিল। বছর পাঁচেক ধরে নদী অঞ্চলে রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়েছে। এ উভচর সাপ খুবই ভয়ংকর। ইতোমধ্যে যদি হাওর এলাকায় ছড়িয়ে থাকে তাহলে সাত-আট মাসের পানি বন্দীজীবন বড়ই দূর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। আহারে জীবন!

হাওর-বাওর, নদীমাতৃক বাংলায় প্রকৃতির সাথে সংগ্রামে রত সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা। মার্বেলে মোড়ানো শীতল ঘরে বসে জীবন নিয়ে দেয়া বানোয়াট সংজ্ঞা এই জীবনের কথা বলে না। যেখানে আছে অষ্টপ্রহর সন্তানের পানিতে পড়ার ভয়, বজ্রপাতের ভয়, রাত পোহালেও ফিরে না আসার ভয়। আরও আছে ‘হরেক রকম’ সরীসৃপের ভয়।

তারপরও মানুষ জিতে যায়। কারণ ‘সরীসৃপ’ কখনো জেতে না। কখনোই না।

লেখক: ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :