উ ন্ন য় ন

একজন শেখ হাসিনা একজন প্রধানমন্ত্রী একটি বাংলাদেশ

প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০২১, ১৩:০০ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২১, ১৪:১০

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

বাংলাদেশের যে অগ্রগতি আমরা লক্ষ করছি, বিশেষ করে গত এক যুগ ধরে এতে প্রধানত দুটি বিষয় কাজ করেছে। একটি হচ্ছে নেতৃত্ব অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনকল্যাণকামী চিন্তা-চেতনা উদ্ভূত নীতিকাঠামো ও পারিপাশির্^কতা আর অপরটি হচ্ছে সেই অনুকূল পরিবেশে মানুষের শ্রম তথা কৃষক, কৃষিশ্রমিক, শিল্প ও অন্যান্য শ্রমিক, উদ্যোক্তাদের শ্রম। বিশেষ করে অতি ক্ষুদ্র (সরপৎড় বা অণু) উদ্যোক্তারা যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। অন্যান্য যারা বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় শ্রম ও নেতৃত্ব দেন তাদের কারণেও উন্নয়ন এগিয়ে চলেছে। সঠিক নেতৃত্ব না থাকলে অনুকূল পারিপাশির্^কতা সৃষ্টি হয় না এবং অগ্রগতি হওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আমি মনে করি উন্নয়নের অগ্রগতির জন্য অনুকূল পারিপাশির্^কতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে এটি কেমন করে তৈরি হলো? ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি অঙ্গীকার করা হয়। সেটি হচ্ছে এ দেশে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরি করা হবে। এই অঙ্গীকারের ভিত্তিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশ ও অন্যান্য খাতে যে কার্যক্রমগুলো শুরু করা হলো ২০০৯ সাল থেকে, সেই ধারাবাহিকতায় দেশ এগিয়ে চলে।

কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত দেশ আর্থ-সামাজিকভাবে ক্রমঅগ্রসরমান ছিল। এর মৌলিক তিনটি দিক আছে। এগুলো হচ্ছেÑ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দিক। এই তিনটি কিন্তু সমান্তরালভাবে চলতে হয়। তা না হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। আর একটি বিষয় হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন অংশ যেমন− ধনী, দরিদ্র, নারী, পুরুষ এবং বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী সকলকে যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না। কল্যাণ রাষ্ট্র গড়তে হলে এই দুই ধারাই সমান্তরালভাবে এগিয়ে যেতে হবে। যে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি বাংলাদেশ ২০১৬ সাল থেকে বাস্তবায়ন করছে সেটার মূল কথাই হচ্ছে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে আর্থসামাজিক বিকাশ ঘটাতে কাজ করতে হবে এবং সেই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণও করতে হবে।

এখন পেছনে চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি মৌলিক দিক হলো এই দেশে একটি সমাজ হবে যেখানে সবাই তার অধিকার পাবে। সবাই মানব-মর্যাদায় বসবাস করবে। সেটি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনার অনুসরণে প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে তিনটি বিষয় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। একটি হচ্ছে এই দেশে বৈষম্য থাকবে না। দ্বিতীয়ত, সবাই সমান মানবাধিকার ভোগ করবে। আর তৃতীয়ত সবাই মানব মর্যাদায় বসবাস করবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সেই কথা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ মানে হলো নানাভাবে বঞ্চিত সকলের বঞ্চনা থেকে মুক্তির সংগ্রাম। বিজয়ের পর যখন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তখন কিন্তু এই বিষয়টা বারবার বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। একটি ব্যাখ্যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। যদিও অনেকেই মনে করতে পারেন কথাটা খুব সাধারণ কিন্তু আমার কাছে এটি সাধারণ নয়। তিনি বলতেন ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে’। এই একটি বক্তব্যের মধ্যে পুরো একটি দর্শন নিহিত আছে। দর্শনটা হচ্ছেÑ সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন সাধন করতে হবে। অর্থাৎ যারা দুঃখী নয় তাদের জন্য আমাদের বিশেষ কিছু করার দরকার নেই। তারা এমনিতেই এগিয়ে যাবে। যারা বঞ্চিত দুঃখী তারা যাতে এগিয়ে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে, তাহলেই এই সমাজ একটি সমাজ হিসেবে এগিয়ে যাবে। কাজেই এই যে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে এ কথার মধ্যে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবকেন্দ্রিক চিন্তা নিহিত আছে। এটি বঙ্গবন্ধুর দর্শন। তাঁর মানবকেন্দ্রিক দর্শন। এতে রয়েছে তাঁর মানবকেন্দ্রিক সমাজ চিন্তা, রাজনৈতিক চিন্তা, উন্নয়ন চিন্তা। সব কাজই করতে হবে মানুষকে কেন্দ্র করে। সেই ধারাবাহিকতা শেখ হাসিনা তাঁর চিন্তা-ভাবনায় ধরে রেখেছেন। তাঁর ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের যে অঙ্গীকারের কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা ওই ধারাবাহিকতায় এসেছে। 

বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে, বিশেষ করে বিগত এক যুগে। এ কথা আমরা সবাই জানি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদেশেও নন্দিত। ২০১০ সাল থেকে প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে এবং ২০১৯ সালে তা ৮.২ শতাংশে পৌঁছেছিল। মাথাপিছু আয় এই করোনাকালেও বেড়েছে। এর বড় একটি কারণ রেমিট্যান্স হলেও দেশের অর্থনীতি কঠিন অবস্থায়ও সে রকমভাবে স্থবির হয়নি। এখন মাথাপিছু আয় ২,২২৭ ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০১০ সালেও ৭৮১ মার্কিন ডলার ছিল। সেখান থেকে এখন আমরা এই জায়গায় এসেছি। দ্বিতীয় হচ্ছে সামাজিক দিক। শিশুমৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে কমেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ও এক বছরের কম বয়সী শিশু উভয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। মাতৃমৃত্যুর হারও কমেছে। জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। প্রত্যাশিত গড় আয়ুতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সবার আগে। ভারতে ৬৮ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৭ বছর। নারীর ক্ষমতায়নে এবং উন্নয়নে বাংলাদেশে দক্ষিণ এশিয়া সবার ওপরে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এক্ষেত্রে আমাদের যে লক্ষ্য সেখানে আমরা এখনো পুরোপুরি যেতে পারিনি। এখনো অনেক পথ বাকি। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এগিয়ে আছি এবং এগিয়ে চলছি। তাহলে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সামাজিক উন্নতি হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি তো হয়েছেই।

২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২০ সালে এসে একটা ধাক্কা খেয়েছে। শুধু বাংলাদেশ একা নয়, সারা বিশ্ব ধাক্কা খেয়েছে। উন্নত হোক আর অনুন্নত হোক বিশ্বের সব দেশই ধাক্কা খেয়েছে। আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়ার দেশসমূহসহ পৃথিবীর সর্বত্রই এই ধাক্কা লেগেছে। এর আগে কোনো মহামারি এ রকম সারা বিশ্বে ছড়ায়নি। অনেক বড় মহামারি হয়েছে। অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। কিন্তু সেগুলো হয়েছে কিছু কিছু অঞ্চলে। এবার সারা বিশ্বে। কোনো দেশই এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। বাংলাদেশও প্রস্তুত ছিল না। কেউ জানত না এ রকম একটা মহামারি এসে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিবে। তারপরও কিন্তু খুব দ্রুতই বাংলাদেশ সেটা মোটামুটি সামাল দিতে পেরেছে। প্রথম পর্যায় বাংলাদেশ যথেষ্ট ভালোভাবেই সামলাতে পেরেছিল। দুই দিক থেকেই। এক. জীবন রক্ষা অর্থাৎ স্বাস্থ্য, টিকা দেয়া, আক্রান্তের সেবা করা, আক্রান্তের হার কমিয়ে আনা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপদেশ দেওয়া, হাসপাতালের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, ডাক্তার-নার্সের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ফলে প্রথমবার সংক্রমণ বেশি দূর গড়ায়নি।

কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কাটা খুব বাজেভাবে এসেছে। ডেলটা ভাইরাস। তবে এটাও মনে হয় এখন অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। বর্তমানে ব্যাপকভাবে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা জরুরি। প্রথম যখন বাংলাদেশ টিকা দেওয়া শুরু করে ওই সময় বিশ্বের ১৩০টি দেশ একটা টিকাও দিতে পারেনি। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে। গৃহীত নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে দায়িত্বপ্রাপ্তরা, কিন্তু নেতৃত্বের ব্যাপারটা অনেক বড় এখানে এবং সেই নেতৃত্ব শেখ হাসিনা দিয়ে আসছেন। তারপর ভারতের সাথে বাংলাদেশ টিকার জন্য চুক্তি করে। কিন্তু ভারতের অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে, চুক্তি করলেও তাতে বাংলাদেশকে আর টিকা দিতে পারল না। এর জন্য আমরা সমস্যায় পড়ে যাই। তারপর সারা বিশ্বে তোলপাড় করে কয়েকটি দেশ থেকে টিকার ব্যবস্থা করা হলো। টিকা আসতে শুরু করলো। কোভ্যাক্স অর্থাৎ জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে টিকা আসতে শুরু করল। চীন কিছু টিকা বাংলাদেশকে উপহার দিল। ক্রয় করাসহ বিভিন্নভাবে আরো অনেক টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং শিগগিরই তা আসতে শুরু করবে বলে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে। টিকা কার্যক্রম যথেষ্ট জোরালোভাবে শুরু করা হয়েছে। আগামীতে আরো জোরদার করা হবে। অব্যাহত প্রচেষ্টা রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আনার ব্যাপারে। আমি আশা করি এই টিকা কার্যক্রম চলমান থাকবে এবং আগামীতে আরো গতি পাবে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি। যদি ১৮ বছর এবং বেশি বয়সের জনসংখ্যা ধরা হয় তাহলেও প্রায় ১১ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। সুতরাং এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক দূর যেতে হবে। আমি আশা করি এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে, সময় হয়তো লাগবে। এখন স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হচ্ছে। ১৮ বছর বয়সের ছাত্রছাত্রীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ১২ বছর বয়স থেকে শিশুদের টিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন।

অপর দিক হচ্ছে জীবিকা। লকডাউনের কারণে অর্থনীতি যথেষ্ট স্থবির হয়ে পড়েছিল। লকডাউনের সময় তো বটেই অন্য সময়েও বিভিন্ন কারণে কাজকর্মে স্থবিরতা দেখা দেয়। কাজেই অনেক মানুষ নতুন দরিদ্র হয়েছে। অনেক দরিদ্র মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছে, বেকার হয়েছে এবং অনেকে খাদ্য সংকটে পড়েছে। অবশ্য সার্বিকভাবে অর্থনীতি হ্রাসকৃত হারে হলেও এগিয়ে চলছে।

খাদ্যসংকটে নিপতিতদের সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। এ রকম মানুষের সংখ্যা এত বেশি হয়েছে যে, সকলকে সহায়তা দেওয়া সরকারের পক্ষে একা সম্ভব নয়। সরকার অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু দেশের বিত্তশালীরাও জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে। আমরা সাধারণত কাউকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করি না বরং অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়াই। তবে বিশেষ দুঃখ-দুর্দশা দেখলে অনেকেই আমরা সাধারণত তাদের পাশে দাঁড়াই। এটা আমাদের চরিত্রের একটা গুণ। যেমন বড় কোনো বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় হলে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। করোনাকালেও সে রকম দেখা গেছে। তবে মানুষ যেমন দুর্দশাগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে তেমনি কিছু মানুষ চুরিও করেছে। এই বিষয়ে কিছুদিন আগে শেখ হাসিনার একটা বক্তব্য গণমাধ্যমে দেখলাম। তিনি বলেছেন, ‘যারা গরিবের ৫ কেজি আটা আর ১০ কেজি চালের লোভ সামলাতে পারে না তাদের রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষা করা উচিত’। অপরদিকে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সরকার বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিয়েছে। অবশ্য কুটির ও অণু উদ্যোগগুলো তেমন সহায়তা পায়নি। এ ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

এবার নজর দেওয়া যাক বাজেটের দিকে। ২০২০-২১ সালের বাজেটে করোনাকালে অর্থনৈতিক ও খাদ্য সংকটে পড়া মানুষকে সহায়তা করার জন্য খাদ্যসহায়তাসহ সামাজিক বেষ্টনী বা সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে ৯ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। বাজেট বরাদ্দের প্রায় চার গুণ। কারণ মানুষের দুর্দশা লাঘব করতে হবে। এর জন্য খরচ বাড়ানো হয়েছে। এটা শেখ হাসিনার সকলের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং মানবিক চিন্তাচেতনার জন্যই সম্ভব হয়েছে। ভুখা মানুষকে খাওয়াতে হবে। প্রকট দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবার কাছেও যে সবকিছু পৌঁছে গেছে তা হয়ত নয়। তবে অবশ্যই বাজেট বরাদ্দ থেকে চার গুণ ব্যয় করেছে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে খাওয়ানো অর্থাৎ মানুষের জীবিকা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই প্রশংসনীয়। বঙ্গবন্ধুর চিন্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এই পদক্ষেপ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের একটা বিশেষ দিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তিনি মানুষের কল্যাণ চান।

তাঁর মানব কল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপের আরো দুটো উল্লেখযোগ্য উদাহরণের কথা বলা যেতে পারে। অসহায় গৃহহীনদের জন্য বাড়ি নির্মাণ। গৃহহীনদেরকে হাজার হাজার বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। তবে দুঃখজনক যে, কিছু ধান্দাবাজ লোক এমনভাবে কিছু বাড়ি বানাচ্ছে যেগুলো ভেঙে পড়ছে। এত ভালো একটা মানবকল্যাণমুখী কর্মসূচিকে যারা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করছে না বরং ধান্দা করছে, তাদেরকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। অপরটি হচ্ছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্যও পাকা বাড়ি বানিয়ে দেওয়া এবং তাদের কাছ থেকে ভাড়া না নেওয়ার ঘোষণা। এটা দুঃখী মানুষের প্রতি সহানুভূতি উদ্ভূত চিন্তা! এরা কত টাকাই বা বেতন পায়? তারা ভাড়া দিয়ে তো থাকতে পারবে না। এই পদক্ষেপগুলো শেখ হাসিনার সামগ্রিক চিন্তাভাবনার অংশ। সামগ্রিক চিন্তাটা হচ্ছে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দারিদ্র্য নিরসনের কথা ধরা যাক। দারিদ্র্য অনেক কমে আসলেও ২০১৯ সালে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। বর্তমানে তা অনেক বেড়ে গেছে  কোভিড-১৯-এর কারণে। দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে কৃষিতে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে এক্ষেত্রে কৃষি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দরিদ্র বেশির ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া কৃষির বাইরে অনেক কুটির, অণু শিল্প ও ব্যবসা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে যেগুলো দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিমালিকানায় এ রকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার উৎসাহিত করতেন। তিনি বড় শিল্পকে রাষ্ট্রীয়করণ করেছিলেন এবং কুটির, অণু শিল্প ও ব্যবসাকে ব্যক্তি খাতে প্রসার লাভ করার জন্য সহায়তা দিয়েছিলেন।

অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য কৃষি এবং কুটির, অণু শিল্প ও ব্যবসার যেমন প্রয়োজন তেমনি দরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং বড় শিল্প ও ব্যবসায় এবং অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্পের। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনীতির ভিত শক্ত করে গড়ে তোলার জন্য যেমন কৃষি ও অকৃষি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ প্রয়োজনীয় তেমনি অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করার জন্য বিভিন্ন খাতে উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক বড় প্রকল্পও জরুরি। ভিত গড়ার উল্লিখিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি উল্লেখ করতে হয়। তা হলো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা। সারা দেশে ১০০টি এ রকম অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, বেশ কয়েকটির স্থাপন ইতোমধ্যে এগিয়ে চলছে। এগুলোতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ছোট শিল্প গড়ে উঠবে। মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠিত হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর আশপাশে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠবে এবং অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ব্যাকওয়ার্ড-ফরওয়ার্ড লিংকেজের মাধ্যমে গড়ে ওঠা নানান ব্যবসা-বাণিজ্য আর্থসামাজিক অগ্রগতিকে টেকসই করতে সহায়ক হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য যেমন সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তেমনি পরিবেশের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা-ই নয়, তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও রাখছেন। যা সর্বত্র নন্দিত এবং তাকে সে জন্য স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে।

অর্থনীতির উচ্চতর পর্যায়ে উত্তরণ এবং টেকসইভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে কিছু বড় আকারের প্রকল্প প্রয়োজন দেখা দেয়। যেমন চলাচলের জন্য উন্নত সুযোগ-সুবিধা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, উৎপাদনে সহায়ক সেবা খাতসমূহ ইত্যাদি অনেক বাড়াতে হবে। এর মধ্যে যদি আমরা চলাচলের বিষয়ে কথা বলি, তা হলে সর্বাগ্রে আসবে পদ্মা সেতুর কথা। বিশ্বব্যাংক বললো তারা এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। অন্যান্য সম্ভাব্য অর্থায়নকারীও না বলল। তখন শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন যে, পদ্মা সেতু আমরা নিজেদের অর্থায়নে নিজেরাই তৈরি করব। তার এই একটা বার্তা দেশে তো বটেই সারা বিশ্বে চলে গেল যে, বাংলাদেশকে আর এদিক ওদিক ঠেলা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ এখন শক্ত অবস্থানে। তারপর আইনগতভাবে বিশ^ব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে বাংলাদেশ যখন জিতে গেল তখন বিশ^-পরিমণ্ডলে দেশ আরো শক্ত অবস্থানে উন্নীত হলো। সিদ্ধান্ত নিয়েই নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলো। বর্তমানে বাস্তবতা এই যে, আর কিছুদিনের মধ্যেই সেতুটি চালু হয়ে যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখানেও কাজটি যত দ্রুত করা যেত, বাস্তবায়নে নিয়োজিত অনেকের গাফিলতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত বেশি সময় লাগছে এবং ব্যয় বাড়ছে। এ রকম যেন ভবিষ্যতে না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে।

তারপর রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র। সেটির কাজও খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে। হয়তো দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে জাতি এটা থেকে সুফল পেতে শুরু করবে। উন্নত এমনকি উন্নয়নশীল অনেক দেশে অনেক নদীর নিচ দিয়ে পারাপারের টানেল আছে। নদীর ওপরে পুল দিয়ে যানবাহন পার হচ্ছে, আবার নিচ দিয়েও। যানজট কমছে, দ্রুত চলাচল সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশে কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল হচ্ছে। আমরাও সেই জায়গায় চলে যাচ্ছি। এটিও একটি বড় প্রকল্প। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলো ঢাকা মেট্রোরেল। ঢাকা মেট্রোরেলের মাধ্যমে আমরা চলাচলের ক্ষেত্রে আধুনিক যুগে প্রবেশ করলাম। মেট্রোরেল ভারতে আছে। কলকাতায় বহু বছর ধরে আছে। বিভিন্ন উন্নত দেশে তো আছেই। এটি খুব দ্রুত চলাচলের জন্য উপযুক্ত। ঢাকার মতো একটি বড় যানজটের শহরের জন্য খুবই উপকারী হবে। শুক্রবার সকালে অর্থাৎ যে সময় যানজট থাকে না সে সময় যেখানে যেতে মাত্র দশ মিনিট লাগে, অন্য সময় লেগে যায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। প্রচুর সময় নষ্ট হয়। মেট্রোরেল খুব দ্রুত চলবে। যানজট থাকবে না। সময়মতো যাতায়াত করা যাবে। তার মানে সময় বাঁচবে এবং কাজ, উৎপাদন, দেশ এগিয়ে যাওয়া সবকিছুই বৃদ্ধি পাবে। তারপর আরো একটি বৃহৎ প্রকল্প হচ্ছে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর। সেটিও হবে। কাজ এগিয়ে চলছে। এই যে বড় বড় প্রকল্প এগুলোর দরকার আছে অর্থনীতি ও সমাজের আধুনিকায়নের জন্য এবং অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত ও টেকসই করার জন্য, তবে খেয়াল রাখতে হবে অগ্রগতি যাতে টেকসই হয়, সে জন্য সবাই যাতে এই প্রক্রিয়ায় ন্যায্যভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

কেউ কেউ বলেন এ রকম বড় বড় প্রকল্পে অর্থ নষ্ট হচ্ছে। মোটেই নয়। দীর্ঘমেয়াদে টেকসই আর্থসামাজিক বিকাশের জন্য এগুলোর দরকার আছে। গ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, কৃষি খাতের উন্নয়ন করা, গ্রামীণ অকৃষি খাতের বিকাশ ঘটানো যেমন দরকার আছে তেমনি এগুলোরও প্রয়োজন আছে। তবে বিভিন্ন খাত ও আর্থসামাজিক সব শ্রেণির সামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতি যাতে ঘটে সেদিকে অবশ্যই দৃষ্টি রাখতে হবে। মানে একটি সার্বিকভাবে পরিকল্পিত সর্বজনীন অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। বড় প্রকল্প থেকেও সাধারণ মানুষ উপকৃত হতে পারে। যেমন মেট্রোরেল অপেক্ষাকৃত কম খরচে সাধারণ জনগণ চলাচল করবে। সাশ্রয়ে এই সেবা পাবে। পদ্মা সেতু দিয়ে বাসে বা অন্যান্য যানবাহনে সাধারণ মানুষ চলাচল করবে। এখন তো নৌকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয়, সময়ের অপচয় হয়। তারপর সেতুর দুই পাশে অনেক অর্থনৈতিক ছোট ছোট কর্মকাণ্ড গড়ে উঠবে। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। প্রাক্কলন করা হয়েছে পদ্মা সেতুর কারণে অর্থনীতির পরিধি ১ শতাংশ বা কিছু বেশি বাড়বে। আমি মনে করি তা আরও বেশি হবে। কারণ আরো নতুন নতুন অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এই সেতুর কারণে গড়ে উঠবে। কাজেই পদ্মা সেতু নির্মাণ একটা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়ন।

একটি অর্থনীতি বা সমাজ যখন এগিয়ে যায়, তখন সেখানে সমস্যা থাকতে পারে এবং বিভিন্ন কারণে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, হয়। শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই এমনটি ঘটে, ঘটছে। কাজেই নেতৃত্ব দূরদর্শী হলে বিদ্যমান, এমনকি সম্ভাব্য সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। আমরা দেখছি শেখ হাসিনা সমস্যাও চিহ্নিত করছেন। প্রয়োজনও চিহ্নিত করছেন সে কথা আগেই বলা হয়েছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রয়োজন চিহ্নিত করছেন এবং সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। সমস্যা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার বিবেচনা করতে পারি। এতে অনেকগুলো বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে সমাধান করার লক্ষ্যে। চিহ্নিত সমস্যাগুলোর কয়েকটি উল্লেখ করছি। করোনার প্রাদুর্ভাব না ঘটলে হয়তো আমরা দেখতাম বেশ কিছু সমস্যার সমাধান ইতোমধ্যে হয়ে গেছে অথবা হওয়ার পথে। দেশে দুর্নীতি ব্যাপক। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না, শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করা হয়েছে। দেশে আর্থসামাজিক বৈষম্য বাড়ছে তা কমিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত করা আছে। সুশাসনে ঘাটতি আছে, দূর করতে হবে। আইনের শাসনে যা কিছু ঘাটতি আছে তা দূর করার কথা বলা হয়েছে। তারপর কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার কারণে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় মানুষ তেমন অবদান রাখতে পারছে না। সেটাও চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এর বিকেন্দ্রীকরণের ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে তরুণদের সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে কারণ ‘তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’। তারপর নারী উন্নয়নের কথা চিহ্নিত করা আছে। নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। যাতে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন আরো ঘটে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তারপর শহর থেকে গ্রাম পিছিয়ে আছে। গ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। এখানে বলা আছে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’। এর মানে এই নয় যে, গ্রামকে শহর বানাতে হবে। শহরে যে সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে গ্রামেও সে রকম প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো ছাড়া আরো কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। আমি মনে করি এই সমস্যা চিহ্নিতকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা সাধারণত সমস্যা দেখেন না। কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি ব্যতিক্রম। হ্যাঁ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এর পেছনে কিছু নেতিবাচক গল্প রয়েছে। সেই গল্পগুলোর সমাধান দরকার। লক্ষণীয়, এসব সমস্যা চিহ্নিত করার পরেও যারা এগুলো দূর করার লক্ষ্যে কার্যক্রম বাস্তবায়নে নিয়োজিত তারা অনেক সময় যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। শেখ হাসিনার সঠিক নীতি নির্দেশনা আছে, সাবলীল ও দূরদর্শী নেতৃত্ব আছে। কিন্তু বাস্তবায়নে যারা আছেন, তাদের অনেকে সঠিকভাবে কাজ করছেন না বলে অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। এদের অনেকের মধ্যে গাফিলতি রয়েছে, রয়েছে অকারণে দীর্ঘসূত্রতা, রয়েছে দুর্নীতি ও ধান্দাবাজি। এ রকম যারা করেন তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি যাতে তারাও এ পথ থেকে সরে আসেন এবং অন্যরাও সে পথে না যায়। তখন লক্ষ্যের পথে অগ্রগতি আরো বেশি হবে।

আরো একটা সমস্যা চিহ্নিত করা আছে। সেটা হচ্ছে দক্ষতার ঘাটতি। ২০১১ সালে দক্ষতা উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিভিন্ন খাতে ও পর্যায়ে দক্ষতা ঘাটতি ব্যাপক। যথাযথ জরিপের মাধ্যমে খাত ও পর্যায়ওয়ারী ঘাটতি নিরূপণ করে দক্ষতা উন্নয়ন প্রক্রিয়া জোরদার করা জরুরি। অন্যথায় ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া ব্যাহত হবে।

বাজেট বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া যাক। গত বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ সালে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত প্রায় দশ হাজার কোটি ব্যয় করা যায়নি। করোনাকালে এ খাতে আরো বেশি ব্যয় করার কথা ছিল। উল্লেখ্য, ২০২০-২১ সালের সংশোধিত বাজেটে মোট বরাদ্দের মাত্র ৭৪ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে। অবশ্য করোনা মহামারি ছিল এর একটি বড় কারণ। কিন্তু দক্ষতা ও অন্যান্য কারণও আছে এর  পেছনে। সাধারণত সংশোধিত বাজেটের আকার মূল বাজেট থেকে বেশ কমিয়ে আনা হয় এবং তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ সাধারণত বাস্তবায়িত হয় অন্যান্য বছরে এবং বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় করা হয় বছরের শেষের দিকে এসে। প্রথম দিকে তেমন ব্যয় হয় না। শেষের দিকে তাড়াহুড়ো করে ব্যয় বাড়ানো হয় বলে কাজের মান ভালো হয় না এবং এতে চুরির সুযোগ বাড়ে। দক্ষতার ঘাটতিসমূহ এবং অন্যান্য কারণ চিহ্নিতই আছে। বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তাই দক্ষতা উন্নয়ন ও চিহ্নিত অন্যান্য সমস্যা সমাধানে তৎপরতা বাড়িয়ে পারিপার্শ্বিকতার উন্নয়ন ঘটিয়ে সব কার্যক্রম বাস্তবায়নে আরো সাফল্য নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছেছি ২০১৫ সালে এবং ২০২০-এর দশক শেষে টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচির অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন, উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছা এবং সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে লক্ষ্যভুক্ত কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধনে এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য নীতি এবং কর্মসূচির যেমন দরকার আছে, তেমনি বলিষ্ঠ নেতৃত্বও অপরিহার্য। শেখ হাসিনা সেরকম নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। তবে যারা তাঁর নেতৃত্বে নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণ করেন, কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন, তাদেরকেও জনকল্যাণে নিবেদিত থেকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন, সেটির বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভরসা রেখে বলতে চাই আমরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা একদিন গড়বোই এবং সেই পথ রচনায় শেখ হাসিনা সফল হবেন। এই লেখায় যেসব বাধা ও ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো অতিক্রম করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, দেশের সকলকে ন্যায্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রম আরো জোরদার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় (বৈষম্যহীন সমাজ, সকলের সব মানবাধিকার নিশ্চিত হওয়া এবং সকলের মানব-মর্যাদায় বসবাস) দেশের ত্বরান্বিত টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে অভিযাত্রা নিশ্চিত করতে পারবেন বলেই আমি বিশ্বাস করতে চাই।

 

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ, সমাজ চিন্তক, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত