অবৈধভাবে ওয়াকিটকি বিক্রি হচ্ছে দারাজে

প্রকাশ | ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১০:০৪ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১৫:২৬

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

দারাজে এবার রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তার জন্য স্পর্শকাতর ওয়াকিটকি ও বেজ রেডিও বিক্রি হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া এসব ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির টু ওয়ে রেডিও বিক্রি অবৈধ বলছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনকি সাধারণের অবাধে এই বেতার যন্ত্র ও সরঞ্জামাদি বিক্রি ও ব্যবহার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কেননা এসব রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি সরকারি বাহিনীগুলোর ব্যবহৃত রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সিতে ইন্টারফেয়ারেন্স তৈরি করতে পারে।

সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্যোগকালে ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোকে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বিটিআরসির তালিকাভুক্ত শৌখিন রেডিও অপারেটর বা অ্যামেচার রেডিও অপারেটররাও বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি পান। এ ছাড়া গুরুত্ব অনুযায়ী লাইসেন্স নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারেন। 

কিন্তু এসব বেতারযন্ত্র আমদানি, কেনা বা বিক্রির জন্য বিটিআরসির লাইসেন্স ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে ছাড়পত্র (এনওসি) প্রয়োজন হয়। এমনকি যিনি কিনবেন তার জন্য সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি বাধ্যতামূলক। এসব রেডিও কেনা বা আমদানি করতে হয় কমিশনের তালিকাভূক্ত ভেন্ডরের (বিক্রেতা) মাধ্যমে। এর বাইরে রেডিও কেনাবেচা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

সরকারের এত সব নিয়ম-কানুন এড়িয়েই ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির ওয়াকিটকি এবং বেজ রেডিও কেনাবেচা হচ্ছে ই-কমার্স প্লাটফর্ম দারাজ ডটকম ডট বিডিতে। ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে বেশ কিছু টু ওয়ে রেডিও, বেজ রেডিও ও বিভিন্ন বেতার সরঞ্জাম বিক্রির জন্য প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে। 

দারাজের ওয়েবসাইটে ওয়াকিটকি (টু ওয়ে রেডিও), বেজ রেডিও, ফ্রিকোয়েন্সি কাউন্টার, সফটওয়্যার ডিফাইন রেডিও এবং এর নানা সরঞ্জামাদি দেখা গেছে। দারাজের এসব ভেন্ডরের বেশির ভাগই ওভারসিজ ভেন্ডর বা বিদেশি বিক্রেতা। তাদের এসব রেডিও সরঞ্জামাদি দেশে বিক্রির অনুমতি নেই। তারপরও কাজটি করছে অবাধে।

‘প্রাইম পয়েন্ট’ নামের দারাজের এক সেলার বাওফ্যাংয়ের  এক জোড়া ওয়াকিটকি বিক্রির জন্য প্রদর্শন করছে, যার দাম ৮৫২৬ টাকা। `Boyouyoushop’ নামের এক সোলারের এক জোড়া ৩-৫ কিলোমিটার রেঞ্জের টু ওয়ে রেডিওর দাম দেখাচ্ছে ২২২২ টাকা।

এ ছাড়া ফ্রিকোয়েন্সি কাউন্টার মিটারও পাওয়া যাচ্ছে দারাজে। এই মিটার দিয়ে আশপাশের সব ফ্রিকোয়েন্সি খোঁজা এবং পরিমাপ করা যায়। এর দাম দেখানো হচ্ছে ৪৯১৭ টাকা। এটি বিক্রির জন্য প্রদর্শন করছে মি গ্লোব্লা নামের একটি প্রতিষ্ঠান। 

‘XHHDQES’ নামের সেলার দারাজে বিক্রি করছে মিনি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মিটার। দাম ১৯৮০ টাকা। ‘The Old Tree’ নামের বিদেশি সেলার দারাজে ৭৪৯৯ টাকায় ২৫ ওয়াটের বেজ রেডিও বিক্রি করছে। এটি একটি ডুয়েল ব্যান্ডের ইউএইচএফ/ভিএইচএফ রেডিও। এসব রেডিও সাধারণত বেজ স্টেশনের কাজে লাগে।

দারাজ সার্চ করলে এই ধরনের অসংখ্য ওয়াকিটকি ও বেজ রেডিও কেনার লিংক মেলে। অনুমতি ছাড়াই এসব রেডিও কেনা যাচ্ছে, যা কিনা আইনবিরোধী। 

‘Cacao (Shenzhen)’ নামের একটি সেলার লং রেঞ্জের বিজ্ঞাপন দিয়ে বেজ রেডিও বিক্রি করছে। এসব রেডিও ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে টিউন করা নেই। স্ক্র্যান দিয়ে যেকোনো ফ্রিকোয়েন্সিতে সিগন্যাল ট্রান্সমিশন ও রিসিভ করা যায়। দারাজে প্রদর্শিত পণ্যের বিবরণে এসব তথ্য দেওয়া আছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এসব রেডিও এবং রেডিও ডিভাইস বিক্রি হচ্ছে যার-তার কাছে। 

ওয়াকিটকি ছাড়াও দারাজে বিক্রি হচ্ছে ওয়াকিটকির অ্যান্টেনা, ব্যাটারি, চার্জার, হেডফোন, মাইক্রোফোন, সফটওয়্যার ডিফাইন রেডিও ইত্যাদি।
দারাজে প্রদর্শিত ওয়াকিটকি এবং বেজ রেডিওর বিবরণীতে এর ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ হিসাবে বলা হয়েছে আল্ট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে (ইউএইচএফ) রেঞ্জ ৪০০-৪৭০ মেগাহার্জ। ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে (ভিএইচএফ) রেঞ্জ ১৩৬-১৭৪ মেগাহার্জ। অর্থাৎ ভিএইচএফ  এবং ইউএইচএফ  ফ্রিকোয়েন্সিতে লম্বা একটা রেঞ্জ রয়েছে এসব রেডিওতে। 

বিটিআরসির লাইসেন্সপ্রাপ্ত অ্যামেচার রেডিও অপারেটর এবং আইনজীবী তানভীর হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, বাংলাদেশে টু ওয়ে রেডিও বিক্রি করতে পারে কেবল বিটিআরসির তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে রেডিও কিনতে বিটিআরসি থেকে প্রাপ্ত লাইসেন্স এবং রেডিও কেনার ছাড়পত্র (এনওসি) থাকতে হয়। কিন্তু দারাজ বা দারাজের সেলার ক্রেতার কাছ থেকে কোনোরূপ লাইসেন্স ও ছাড়পত্র (এনওসি) না নিয়ে সরাসরি বিক্রি করছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। যেসব টু ওয়ে রেডিও বিক্রি হচ্ছে দারাজে, সেগুলো ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির। এগুলো অবাধে বিক্রি ও ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয়। 

এসব রেডিও না কেনার পরামর্শ দিয়ে তানভীর হাসান বলেন, লাইসেন্স ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী  কারও কাছে এসব রেডিও পেলে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।

বিটিআরসির আইন বলছে অবৈধভাবে রেডিও তরঙ্গের ব্যবহারের সাজা ১০০ কোটি টাকা জরিমানা এবং ১০ বছরের জেল। 

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা টাইমসকে বলেন, যাদের রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের লাইসেন্স আছে তারাই কেবল এ ধরনের রেডিও কিনতে ও ব্যবহার  করতে পারবে। এর বাইরে অনুমোদন ছাড়া বেতারযন্ত্র দিয়ে তরঙ্গ ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিটিআরসি প্রায়ই র‌্যাবকে সঙ্গে নিয়ে অবৈধ রেডিও ও এই ধরনের যন্ত্রাংশের অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করে থাকে।

বিটিআরসির তালিকাভূক্ত রেডিও আমদানিকারক এবং বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অলিওফিন্স করপোরেশনের প্রোপাইটর আবদুল্লাহ আল সাব্বির ঢাকা টাইমসকে বলেন, টু ওয়ে রেডিও ইকুইপমেন্ট বিক্রি নিষিদ্ধ নয়। তবে শর্তসাপেক্ষে বিক্রি করার নিয়ম। একজন ক্রেতা চাইলেই তার কাছে রেডিও ও এর সরঞ্জাম বিক্রি করার বিধান নেই। তার কাছে বেতার যন্ত্রাংশ ব্যবহারে বিটিআরসির লাইসেন্স ও কেনার ছাড়পত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে বিক্রেতাকে।

দেশে অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের শীর্ষ সংগঠন অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি অব বাংলাদেশের সহকারী সম্পাদক সৈয়দ সামসুল আলম দীর্ঘদিন অ্যামেচার রেডিও অপারেশন এবং প্রচারে কাজ করছেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও বিটিআরসি নানা কাজে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো অ্যামেচার রেডিও এবং প্রাইভেট মোবাইল রেডিও (পিএমআর)। এসব রেডিও লাইসেন্স দেয়ার সময় সরকার ফ্রিকোয়েন্সি সীমা বেঁধে দেয়। এক  ফ্রিকোয়েন্সির লাইসেন্স নিয়ে অন্য ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয়। এসব রেডিও কেনার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্সের পাশাপাশি ছাড়পত্র (এনওসি) নিতে হয়। লাইসেন্স ছাড়া রেডিও কেনা-বেচা অপরাধ। এটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিও বটে। 

অবৈধভাবে ওয়াকিটকি বিক্রি করা আইনবিরোধী বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এ ব্যাপারে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিটিআরসি এই ধরনের অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে সব সময়ই অভিযান চালায়। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিই। অনেকে নিয়ম না মেনে অবৈধভাবে ওয়াকিটকি বিক্রি করছে। এটি তারা করছে গোপনে, যা আইনের বিরোধী। আমাদের কাছে সুস্পষ্ট অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিব।’

এ বিষয়ে দারাজের বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিউকেশন ম্যানেজার সায়ন্তনী তিশার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি এ ব্যাপারে তার প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য জানতে এজেন্সি ফোর থট পিআরের কাছে লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে বলেন। 

ফোরথট পিআরের কাছে ই-মেইল মারফত বক্তব্য জানতে চাইলে তারা জানায়, এ ধরনের যন্ত্র আগে বিক্রি হতো, এখন হয় না। এখন এমন বেতারযন্ত্র দারাজে বিক্রির প্রমাণ দেখাতে পারলে তারা এ ব্যাপারে বক্তব্য দেবেন।  

কিন্তু দারাজের ওয়েবসাইট সার্চ করে এ ধরনের বেশ কিছু টু ওয়ে রেডিও বিক্রির জন্য প্রদর্শিত হতে দেখা যায়, যার স্ক্রিনশট ও লিঙ্কও ঢাকা টাইমসের কাছে আছে। 

(ঢাকাটাইমস/৪অক্টোবর/এজেড/মোআ)