জন্ম সনদ পেতে এতো হয়রানি!

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২১, ০৯:৫৪

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস

আফরোজা সুলতানা (ছদ্মনাম) একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তিনি তার মৃত মায়ের ব্যাংকে জমানো টাকা উঠানোর প্রয়োজনে মায়ের মৃত্যুসনদ আনতে গিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের খিলগাঁওয়ে অফিসে। তাকে বলা হলো তার মায়ের অনলাইন জন্মনিবন্ধন বের করতে হবে। তার বিপরীতে ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করতে হবে।  

আফরোজা সুলতানা পড়েন বিপাকে। তিনি তার মায়ের অনলাইন জন্মসনদ কোথায় পাবেন! তখন তো এই ব্যবস্থা ছিল না। তার প্রশ্ন নিজের ও মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পর  আবার কেন জন্মনিবন্ধন সনদ দিতে হবে?’

কেস স্টাডি-২

‘২০১০ সালে আমার বোনের বাচ্চার জন্মনিবন্ধন সনদ দেয় সিটি করপোরেশন। সেই জন্মনিবন্ধন সনদ স্কুলে জমা দেওয়া হয় এসএসসির রেজিস্ট্রেশনের জন্য। কিন্তু  স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেন, অনলাইনে জন্মনিবন্ধন লাগবে। তখন আমি তার অনলাইন জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে জানতে পারি, এ জন্য তার বাবা-মায়ের অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ লাগবে। তবেই সম্ভব বাচ্চার জন্মনিবন্ধন। একটি বাচ্চার জন্মনিবন্ধনের জন্য এই হয়রানি যদি ভুগতে হবে তাহলে জাতীয় পরিচয়পত্রের কী সুবিধা পেলাম? ২০১০ সালে একবার জন্মনিবন্ধন সনদ বের করেছি, সেটা তারা অনলাইন বেইজড করেনি, এখন আর সেটা এটা কার্যকর নয়।’

কেস স্টাডি-৩

১০ বছরের সিজান রহমান রাজধানীর আইডিয়াল স্কুলের ছাত্র। তার মা মালয়েশিয়ায় থাকেন। সেখানে যেতে চায় সিজান। এ জন্য তাকে পাসপোর্ট বানাতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন অনলাইন জন্মসনদ, স্কুলের পরিচয়পত্র, বাড়ির বিদ্যুৎ বিলের ফটোকপি, চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলরের সনদ ইত্যাদি। এ ছাড়া অনলাইন তার জন্মসনদ করতে গেলে সিজান রহমানের বাবা-মায়ের অনলাইন জন্মসনদ দিতে হবে। আবার তার বাবা-মায়ের অনলাইন জন্মসনদ করতে হলে সিজানের দাদা-দাদি, নানা-নানির জন্মসনদ দিতে হবে। এত কাগজ সিজান রহমান কোথায় পাবে?

এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, বাংলাদেশে জন্ম-মৃত্যু এবং বিবাহ রেজিস্ট্রেশন সর্বজনীন করার আইন ২০০৪ সালে পাস হয়। ২০০৬ সালের ৩ জুলাই থেকে কার্যকর হয় আইনটি। তখন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করা হলে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সনদ দেওয়া হতো। ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনলাইনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন শুরু হয়।

যাদের জন্ম ২০০১ সালের আগে তাদের জন্মনিবন্ধন করতে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন লাগবে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান সার্ভার এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে এই সার্ভার পূর্ণ কার্যকর হয়েছে। ওয়েবসাইটে ঢুকে ওই সাইটে আবেদন করতে হবে।

মৃত্যুনিবন্ধন সার্টিফিকেট পেতে কেন মৃত ব্যক্তির জন্মনিবন্ধন সনদ লাগবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘যার জন্ম নেই, তার মৃত্যুও নেই। জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট হয় জন্মের পরই। আর জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়েছে ১৮ বছর বয়স হলে। তাহলে একজন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে কীভাবে মৃত্যু নিবন্ধন সার্টিফিকেট দেবে?’

এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল যোবায়েদুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এভাবেই সাইট তৈরি করা হয়েছে। এর আগে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অনেকে জালজালিয়াতি করত। এটা রোধ করার জন্য  অনলাইনে ফরম পূরণ করতে হয়। যাদের জন্ম ২০০১ সালের পরে হয়েছে তাদের বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন লাগবে।

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটা আমরা  জনপ্রতিনিধিদের কাছে দিতে চাচ্ছি। এই প্রক্রিয়াটা চলছে। আমরা জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছি। এক-দুই মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে অনুমতি পেতে পারি।’

২০০০ সালের আগে যাদের জন্ম হয়েছে তাদের অনলাইন  জন্মনিবন্ধন করতে হলে তার বাবা-মায়ের অনলাইন জন্মসনদ না থাকলেও চলবে। এখন তার বাবা-মায়ের অনলাইন জন্মসনদ করতে হলে তার বাবা-মার স্কুল সার্টিফিকেট, কাবিননামা, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স অথবা যেকোনো প্রমাণ দিলেই হবে।  

এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন পদ্ধতি www.https:/bdns.gov.bd/bd/brbd

মৃত জন্ম নিবন্ধনে নিয়মাবলি 

অনলাইনে মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য লাগবে জন্মনিবন্ধন সনদ, ডাক্তারের দেওয়া মৃত্যু সনদপত্র, কবরস্থানে দাফনকৃত রশিদ অথবা প্রমাণপত্র, স্থায়ী ঠিকানার পক্ষে বাড়ির ট্যাক্স বা বিদ্যুৎ বিল বা দলিলের ফটোকপি, দাফন গ্রামের বাড়ি হলে চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রমাণপত্র,  ৫০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা, আবেদনকারী ও মৃত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং ছবি। 

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন ফরম সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত  জমা নেওয়া হয়।

জন্ম নিবন্ধনে যা লাগবে: জন্ম তারিখের পক্ষে প্রমাণপত্র যেমন ইপিআই কার্ড, হাসপাতালের সনদ, পিএসসি, জেএসসি, এসএসসির সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি (মূল কপি দেখাতে হবে)। আবেদনকারীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি। স্থায়ী ঠিকানার পক্ষে বাড়ির ট্যাক্স, বিদ্যুৎ বিল, দলিলের ফটোকপি এবং স্থায়ী ঠিকানা গ্রামে হলে নাগরিকত্ব সনদপত্র।

জন্ম নিবন্ধন কী

জন্ম নিবন্ধন হলো একজন মানুষের নাম, লিঙ্গ, জন্মের তারিখ ও স্থান, বাবা-মায়ের নাম, তাদের জাতীয়তা এবং স্থায়ী ঠিকানা নির্ধারিত নিবন্ধক কর্তৃক রেজিস্টারে লেখা বা কম্পিউটারে এন্ট্রি প্রদান এবং জন্ম সনদ প্রদান করা।

জন্মনিবন্ধন সনদ পাসপোর্ট ইস্যু, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু, ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি, জমি রেজিস্ট্র্রেশন, ব্যাংক হিসাব খোলা, আমদানি ও রপ্তানি লাইসেন্স প্রাপ্তি, গ্যাস, পানি, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সংযোগ, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন), ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রাপ্তি, বাড়ির নক্সা অনুমোদন, গাড়ির রেজিস্ট্র্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার জন্য কাজে লাগে।

এ ব্যাপারে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্টার জেনারেল মো. ওসমান ভূঁইয়াকে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের সার্ভারে কিছু সমস্যা রয়েছে। আমরা সেগুলো সমাধানের জন্য কাজ করছি।’

ঢাকাটাইমস/৬অক্টোবর/এএ/মোআ