মা বলতেন,পাখি অভিশাপ দিলে ঝামেলায় পড়বি

মোহাইমিনুল ইসলাম
 | প্রকাশিত : ০৬ অক্টোবর ২০২১, ২০:২৭

সকাল সকাল অফিসে প্রবেশ করেছেন এক মা জননী। একজন জনপ্রতিনিধি তিনি, তবে আজ শুধুই 'মা' হয়ত। মা তো মা-ই; মায়েদের ভাষা একই... ডাকাতের মায়ের মুখেও ছেলের অনেক প্রশংসা শুনেছি। এই মায়ের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। কথার আগেই কান্না জুড়ে দিলেন।

‘আমার ফুলের গাছ মেয়ে, আমার অবুঝ মেয়ে, আমার পড়াশোনা করা মেয়ে’ - এসব বলে বলে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন উনার ফুলের গাছের (মেয়ের) ওপর! শুরুর এই আহাজারি শুনে বুঝতে দেরি নেই ঘটনা কী কী হতে পারে!

কান্নায় অনেক কষ্ট হয়, এই কষ্ট থেকে উনাকে বিশ্রাম দিতে নিজ থেকেই বললাম, ‘যে ছেলের গলায় ফুলের মালা দিতে আপনার ফুলের গাছ মেয়ে ভেগে গেছে তার কী বৃত্তান্ত ?’

আবার সেই মেয়ে হারা মায়ের চিরাচরিত উত্তর, ‘কিচ্ছু করে না, নেশা করে; ট্রাকের পেছনে চড়ে ঘুরে বেড়ায় আর বালি ফেলে! বালি ফেলতে এসেছিল আমার বাড়ির পাশে; এখন আমাকে বিপদে ফেলে গিয়েছে!’

পংকজ উদাস নামের জনৈক উদাস শিল্পী মেয়েদের নিয়ে গান গেয়েছেন, ‘চোখ তার চোরাবালি মন যে পাথর!’ অথচ, এই মা বলছেন উনার সে বালিকা-ই চোরাবালিতে পড়ে এক বালি-ওয়ালার হৃদয়ের সাথে বালির বাঁধ স্থাপন করেছে!

এই দুঃখের মাঝেও মায়ের সাহিত্যবোধ আমাকে মুগ্ধ করলো। ছোটকালে নদীতে গোসল করার অভিজ্ঞতা আছে; নদীর মাঝ দিয়ে ছুটে যাওয়া নৌকার মাইকে বাজা একটা পল্লীগীতি শুনেছিলাম; পল্লীর এই ঘটনার জেরে দেড় যুগ পরে গানটা মনে পড়ে গেল, ‘ধান কাটিতে আইসা রে বন্ধু কাইট্যা গ্যালা মন, ওরে বন্ধু কাইট্যা গ্যালা মন....!"

নতুন উদ্যমে কান্না শুরু হলো আরেকবার। একমাত্র মেয়ে হারিয়ে উনি ট্রমায় থাকতে পারেন - এই ভেবে কোনো প্রশ্ন না করে শুধু শান্ত হতে বলছিলাম। পুলিশ হয়ে তার মেয়েকে না এনে দেওয়ার একটা অতৃপ্তিও কাজ করছিল; এখনই কাজ শুরু করতে হবে। এসময় উনি ফুঁপিয়ে বলে উঠলেন, ‘আরেকবার শুধু আমার মেয়েকে এনে দেন, আমি পরের বার আর অনুরোধ করব না!’ এটা শুনে আবার খটকা লাগল! বললাম, ‘আপনি কি মামলা করেছিলেন? তদন্তকারী অফিসার কি অমুক? আপনার মেয়েকে কি আমরা অমুক জায়গা হতে উদ্ধার করেছি? হুম, মনে পড়েছে আপনি আগেও আমার এখানে এসেছিলেন।‘

এবার সব স্বীকার করে তিনি দুঃখের সাথে জানালেন, পুলিশ উদ্ধার করে কোর্টের মাধ্যমে মেয়েকে তার মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। ২২ দিন পর মামলা করে উদ্ধার করা মেয়ে ২২ ঘন্টাও মায়ের বাসায় থাকেনি! মায়ের কাছে এসেই সে ছেলের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলে, ছেলে খুব অত্যাচারী, ভুল বুঝিয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এসব বলে খুব সহজেই মায়ের কাছে বিশ্বস্ত মেয়ে হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে ফেলেছিল। এভাবে সে পাশের বাড়ি যায় ১০ মিনিট পর ফিরে আসে, আবার যায় আবার আসে, আরেকবার যায় আবার আসে, যায়- আসে, যায় আসে, যায়-আসে, যায়...................... আর আসে না এবার। মায়ের প্রাণ বায়ু এবার যায় যায়। মেয়ের তাতে কিছু যায় আসে না...

পুরো কাহিনী শুনে বললাম, নিশ্চয়ই মেয়ে সুখে আছে, না হলে ২২ দিন একটা ছেলেকে ঘৃণা করার জন্যে আজকাল যথেষ্ট সময়! স্নেহমহী সে মা বললেন, ‘ওদের অবস্থা ভালো না, স্যার। শুধু খাওয়া পরা দিতে পারে- জীবনে সাধ আহ্লাদের কিছুই থাকবে না মেয়েটার।‘

সাধ-আহ্লাদের অতিরিক্ত সন্ধান-ই মানুষের জীবনের বিস্বাদের মূল কারণ-তা আর বলা প্রাসঙ্গিক মনে হলো না।

যাহোক, পুলিশ এখন মামলার স্বার্থে হয়ত আবার এই মেয়েকে ধরে নিয়ে আসবে। স্কুল লাইফে গুলতি দিয়ে মেরে পাখি ধরতাম বলে মা বলতেন পাখি অভিশাপ দিলে ঝামেলায় পড়বি। মাঝে মাঝে মনে হয় এই ঝামেলার অংশ হিসেবেই পুলিশ হলাম কি না!

এসব পাখ-পাখাল তো প্রায়ই ধরে আনতে হয় পুলিশকে। প্রেমের মরা নাকি জলে ডুবে না; প্রেমের পাখির অভিশাপে কি হয় কে জানে!

লেখক: মোহাইমিনুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার

ঢাকাটাইমস/৬অক্টোবর/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :