মেয়ে থেকে ছেলে হওয়ার তিন গল্প

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০২১, ০৯:৪১ | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৩৯

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

নেত্রকোণার বাসিন্দা হাসান। ১৫ বছর বয়সী এই কিশোর ‘লিঙ্গ বিকাশজনিত ত্রুটি’ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পরিবারের পক্ষ থেকে তার এ বিষয়টি চেপে যাওয়া হয়। তাকে পরানো হয় মেয়েদের পোশাক। সমাজে তার পরিচয় ছিল মেয়ে হিসেবেই। তখন হাসানের নাম ছিল মনি। কিন্তু ৯ বছর বয়সে এসে পরিবারের কাছে নিজের চিকিৎসার দাবি করে হাসান। এরপর তার চিকিৎসা করা হলে পুরোপুরি কিশোর হিসেবে পূর্ণতা পায় সে।

ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে হাসান বলে, ‘আমি যদি ওই বয়সে পরিবারকে এটা না বলতাম তাহলে হয়তো আমার চিকিৎসা হতো না। এটা আল্লাহরই একটা কুদরত।’

বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে সমস্যা হয় কিনা জানতে চাইলে হাসান বলেন, ‘আমার বন্ধুরা সবাই বিষয়টা জানে। তারা আমাকে এ বিষয় নিয়ে কিছু বলে না। একদিন একজন বলেছিল। পরে এসে আমাকে স্যরি বলেছে।’

একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আলেয়া থেকে আমিনুল হয়েছে এক শিশু। শিশুটির মায়ের ভাষ্য, জন্মের পর আমিনুলের লিঙ্গ বিকাশজনিত সমস্যা ছিল। সামাজিকভাবে শিশুটিকে হিজড়া বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তবে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে শিশুর চিকিৎসা করিয়েছেন তার পরিবার। এখন শিশুটি সুস্থ।

আর ইমরান ২১ বছর বয়স পর্যন্ত নারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন নারী হিসেবে। এর আগে থেকেই ইমরান জানতেন, তিনি নারী নন, পুরুষ। নিজের পরিচয় নিশ্চিত হতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তিনি। চিকিৎসা নিয়ে এখন পরিপূর্ণ যুবক তিনি।

নারী পরিচয় থেকে পুরুষ হয়ে বিপাকেও পড়েছেন তিনি। এবার জাতীয় পরিচয়পত্র, শিক্ষা সনদে নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করতে হবে তাকে।

এ ধরনের মানুষকে রোগী হিসেবে দেখছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। চিকিৎসকদের ভাষায়, এরা ‘লিঙ্গ বিকাশজনিত ত্রুটি’ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা মানুষ। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলে তারা স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। 

বাংলাদেশে এক যুগের বেশি সময় ধরে এ রোগের চিকিৎসা হয়ে আসছে। তবে অন্যান্য চিকিৎসার মতো এর প্রচারণা হয়নি সেভাবে। ফলে অনেকেই এখনো জানেন না, দেশে লিঙ্গ বিকাশজনিত ত্রুটির চিকিৎসা সম্ভব। 

দেশের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা এ রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট সার্জন মো. নজরুল ইসলাম (আকাশ) ২০০৩ সাল থেকে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন লিঙ্গ বিকাশজনিত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুদের। 

তার মতে, লিঙ্গ বিকাশজনিত ত্রুটি থাকা একটি স্বাভাবিক বিষয়। শিশু জন্মের পর যদি তার লিঙ্গ শনাক্ত না করা যায়, তাহলে একটি মেডিকেল পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে ওই শিশুটি পুরুষ নাকি নারী। 

চিকিৎসকরা বলছেন, হাজার হাজার বছর ধরে লিঙ্গে নানা ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিচ্ছে মানুষ। তবে এ সংক্রান্ত চিকিৎসা ও সচেতনতার অভাবে তা সেভাবে বিকাশ লাভ করেনি। পরিপূর্ণ চিকিৎসা হলে এর সমাধান সম্ভব। আর ইতিমধ্যে এ ধরনের সমস্যা নিয়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের অনেকেই এখন বিবাহিত। স্বাভাবিক সংসার করছেন।

ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি শিশু জন্মের পর তার গোপনাঙ্গ দেখে যদি বোঝা না যায়, সে ছেলে নাকি মেয়ে, তাহলে একটি ক্যারিওটাইপ পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখা যায় তার ক্রোমোজম ৪৬ এক্সএক্স, তাহলে সে মেয়ে। আর যদি দেখা যায় ৪৬ এক্সওয়াই, তাহলে সে ছেলে। এরপর তার লিঙ্গে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেভাবে চিকিৎসা করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারও একটা, কারও দুটি, কারওবা তিনটি সার্জারি করতে হয়।’ 

গত এক যুগে চার শতাধিক লিঙ্গ বিকাশজনিত ত্রুটি আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করেছেন ডা. নজরুল ইসলাম। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন বিয়ে করে সংসার করছেন। 

এ ধরনের রোগীরা ভবিষ্যতে সন্তান জন্ম দিতে পারবেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একেকজনের সমস্যা একেক রকম। চিকিৎসা হলে অনেকেই সন্তান জন্ম দিতে পারবে। আবার যাদের সমস্যা খুব বেশি, তারা পারবে না।’

এই চিকিৎসক মনে করেন, অন্যান্য রোগীর সঙ্গে চিকিৎসা নয়, লিঙ্গ বিকাশজনিত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া মানুষের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করা প্রয়োজন।

(ঢাকাটাইমস/৮অক্টোবর/মোআ)