উ ন্ন য় ন

সমষ্টির হিত চিন্তায় পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল

মাসুদ আহমেদ
| আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২১, ১০:১৮ | প্রকাশিত : ১২ অক্টোবর ২০২১, ০৯:৫৯

প্রাচীনকালে সরকারের সাথে জনগণের সামাজিক চুক্তি সম্পাদিত হতো। এটা এ জন্য করা হতো যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে, রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারে, এমন ক্ষমতার জন্য জনগণ কল্যাণ রাষ্ট্র পেতে পারে। এর জন্য মানুষ রাষ্ট্রকে কর দেবে। ফলে সরকার তাদের নিরাপত্তা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিল্প, বাসস্থান ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে। কথার শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তানের কথা বলতে হয় এই সূত্রে যে পশ্চিম পাকিস্তান সেই সামাজিক চুক্তি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে ভঙ্গ করার কারণেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সাল থেকে জনগণের সেই কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের হাতে বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। দেশের অগ্রগতি মূল্যায়নের বড় সূচক হচ্ছে জনগণের স্বল্পমূল্যে দ্রুত বেগে নানা স্থানে যাওয়ার নিরাপদ সুযোগ নিশ্চিত করা। সেটা হতে পারে সড়ক যোগাযোগ বা অন্যান্য মাধ্যমে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সব মানুষের বিমানের চড়ার সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। তাই আমরা সড়ক যোগাযোগটাই গুরুত্ব দিয়ে দেখি। সে ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে নয়ারহাটে যে ছোট্ট নদী ছিল তার ওপর ঢাকা ও মানিকগঞ্জের মধ্যে যোগসূত্র একটা কালভার্ট ছিল। সেখানে পুল বানানো যায়নি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তান সরকার সে চেষ্টাও করেনি। আমরা ১৯৭২ সালে একটা পুল নির্মাণ দেখতে পাই। এই প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হলে ঢাকা এবং মানিকগঞ্জ এর মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়।

এর আগে ওখানে ছোট্ট নৌকায় করে নদী পার হয়ে পাবনা বা উত্তরবঙ্গে যেতে হতো। তারপর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম হাজার হাজার পূর্ত কাজ সম্পন্ন হলেও যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু নির্মাণ দেশের প্রথম মেগা প্রকল্প। উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে এটি সবচেয়ে বড় মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। যেমন উভয় পাশে দ্রব্যমূল্য, পণ্য উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থাপনা এবং পর্যটন ও পরিবহন সেক্টরে অকল্পনীয় উৎকর্ষ এই যমুনা সেতুর ফলে সম্ভব হয়েছে। শুরুর প্রকল্প হিসেবে ইতিমধ্যে তা দেশের দুই অঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে বাধা ছিল সেটি দূর করেছে। দুই অঞ্চলে উন্নয়নের যে অসম রূপ ছিল সেটা সুষম রূপ পেয়েছে। এই যমুনা নদীর বাধা পার হয়ে দুই অঞ্চলের মানুষের শুধু পরস্পরের মধ্যে যাতায়াতই নয় এই পুল দেশের কোটি কোটি যাত্রীকে তিন ঘণ্টা ধীরগামী, ঝুঁকিপূর্ণ ফেরি, লঞ্চ, নৌকা, ট্রলার এবং স্পিডবোটে বিপদসঙ্কুল যমুনা নদী পার হওয়া থেকে চিরতরে রেহাই দিয়েছে। পাশাপাশি দুই অঞ্চলের মানুষের জীবনের মানের ব্যবধান অনেকটা ঘুচিয়েছে। এ দেশে এত বড় প্রকল্প ইতিপূর্বে আর হয়নি।

আমরা যদি পদ্মা সেতুর কথা ধরি তাহলে দেখব এটা ওই একই মডেলের বা আদলের যদিও অঞ্চলটা অন্যদিকে। মোটামুটি একই লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার দেশের দক্ষিণাঞ্চল বা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ত্বরিত যোগাযোগ এবং সেখানকার মানুষের জীবিকার উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্প হাতে নেয়, যা এখন বাস্তবায়নের শেষ স্তরে রয়েছে। এটা এত উপকারী হবে যে একান্ত সমালোচকরাও এর খুঁত ধরতে পারেননি। এ নিয়ে কিন্তু কোনো সমালোচনা নেই। কিছু সমালোচনা হয়েছে প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে। কিন্তু এর লক্ষ্য বা বাস্তবতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নাই। এটা দেশের ২১ কোটি (ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি ধরে) মানুষের উপকারের জন্য করা। যমুনা প্রকল্পের মতোই এ প্রকল্প উন্নয়ন ঘটাবে দুই অঞ্চলের দ্রব্যমূল্যে ও পরিবহন ব্যবসায়ে। নতুন বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি সেবাগুলো গড়ে উঠবে। সড়কের মান উন্নত হবে। ব্রিজের দুই পাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হসপিটাল, ক্লিনিক এবং বিভিন্ন পূর্ত কাজ, পর্যটন কেন্দ্র, অবকাশ যাপন ইত্যাদির বিকাশ ঘটবে। আগে ফেরি পার করতে যে সময় লাগত সেই সময়ে দুই পারের মানুষ ৩০ থেকে ৩৫ মাইল দূরত্ব পার হয়ে যাবেন সুরম্য ও মসৃণ পথ ধরে। কয়েক কোটি মানুষের আয় বৃদ্ধি পাবে। অনেকেই নতুন নতুন জীবিকার সন্ধান পাবেন। দক্ষিণাঞ্চলে পণ্যের দাম ন্যায্য স্তরে পৌঁছাবে। পূর্বাঞ্চলে এবং ঢাকায় যেসব পণ্যের উচ্চমূল্য ছিল, তা অনেকটাই নেমে আসবে এই দ্রুত পরিবহন সুবিধার কারণে।

এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ঢাকা যশোর রেলপথ নির্মাণের কথা আমরা জানি। সেটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার ৩ কোটি মানুষের জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। এই কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য। কারণ যমুনা বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু একই থিমে যদিও অন্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা এর মধ্যে ওই অঞ্চলের মানুষদের জীবন ও জীবিকায় এ সমস্ত সূচকগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পদ্মা সেতুর ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ শহরে প্রবেশ করবেন। আবার ওই গ্রামাঞ্চলগুলোতে শহরের বৈশিষ্টগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আগে যেমন যমুনার দুই পারে ভূয়াপুর, সিরাজগঞ্জ এবং এর পশ্চাৎপদ স্থানগুলো ছিল সেসব স্থানে সংঘটিত ব্যাপক আধুনিকায়ন প্রমাণ করেছে যে পদ্মা ব্রিজের উভয় পারের মানুষের জীবনে এই একই উন্নয়ন ঘটবে। এর কারণ সমাজ, সংস্কৃতি, ভূগোল, অর্থনীতি ও জনবৈশিষ্ট্য এখানেও সমতুল্য। এই যে ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’ এ কথাটা বলতে পারেন একজন বিজ্ঞ লোক। ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’ এটা কোনো রেটরিক বা অলংকার ছিল না কিন্তু। তা আসলেই আমাদের জনগণের মনন। সরকারের নেতৃত্বে যে উন্নয়নগুলো হচ্ছে সেগুলো সেই বক্তব্যের প্রতিফলন বটে। জনগণের বা আমাদের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য বলেই এই অধিবাসের শ্রেষ্ঠ ওই ভাষণের শব্দপুঞ্জে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়েছিল জাতির পিতার কণ্ঠে।

কিছু অপচয় এবং কালবিলম্ব মানে সময়ের বিলম্ব হতে পারে তবে সামগ্রিকভাবে এই প্রকল্প বিপুলভাবে সফল হবে। ‘টাইম ওভার রান ইজ কষ্ট ওভার রান’ এটা পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যে সত্যি তার কারণ আজকে ১০ টাকায় যে জিনিস পাওয়া যায় এক বছর পরে তা কিনতে ১২ টাকা লাগে। সেটা কিছুটা ঘটবে। বিভিন্ন প্রকল্পের সাথে তা ঘটেও থাকে। এটা ছাড়া অন্য কোনো সমালোচনার পয়েন্ট বের করা যায়নি এখনো পর্যন্ত। অধিকাংশ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটা আগে ঘটেছে সেই অভিজ্ঞতার শিক্ষাটা পরিকল্পনা কমিশন এবং দেশের অন্যান্য বাস্তবায়নকারীরা তাদের মাথায় রাখার ফলে এ ক্ষেত্রে সেটা কম ঘটবে।

এবার আসি ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের কথায়। এখানে বিবেচ্য গত ২০ বছর ধরেই আমাদের একটি সাধারণ সংবাদ শিরোনাম। দলমত নির্বিশেষে সব ধরনের পত্রিপত্রিকায় যে শিরোনামটা করা হয়েছে তা হলো ‘সর্বত্র উপচে পড়া ভিড়’। সেটা লঞ্চঘাটে হোক, সেটা বাসস্টেশনে হোক, শহরের অলিতে-গলিতে হোক কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে হোক। এবং আরেকটা শিরোনাম আমরা দেখেছি। সেটা হলো ‘যানজটের শহর ঢাকা’। প্রথম আলোর মতো পত্রিকা থেকে শুরু করে সব পত্রিকায় এ বাস্তব শিরোনাম আমরা দেখতে পাই। এগুলো নিরসনের জন্য কিছু করা দরকার।

এ লক্ষ্যে ওভারপাস, আন্ডারপাস, ফ্লাইওভার যেখানে যতগুলো বানানো সম্ভব সরকার কিন্তু সবগুলো করেছে তারপরও দিনে দিনে যানবাহনের গতি কমে এসেছে। এটা শুধু সাধারণ ধারণা নয়। এটা পরিবহন বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, স্থপতি বা অন্যান্য পেশাদার সমীক্ষার পরিসংখ্যান। যানবাহনের গতি সর্বত্র কমে আসছে। এখন যেমন ঢাকা শহরে গাড়ির গতি হচ্ছে ঘণ্টাপ্রতি গড়ে সাড়ে চার কিলোমিটার। ঈদযাত্রা বা অন্যান্য জাতীয় উৎসব যাত্রার সময় আমরা সড়কের নানা স্থানে দেখতে পাই ৮ কিলোমিটার বা ১৭ কিলোমিটার বা ২৬ কিলোমিটার যানজট। এই জট শহরের আশপাশ, উত্তরা বা গাবতলী হোক, মানে শহরের এন্ট্রি এবং এক্সিট পয়েন্ট এবং সর্বত্র বেশি। আর দূরবর্তী শহরে যেমন দাউদকান্দি ব্রিজের ওপর যানজট। কিন্তু মেট্রোপলিটন শহরের আশপাশ দিয়ে এই সংবাদ শিরোনামটি একেবারে খুব বেশি অপরিহার্য।

এ প্রসঙ্গেই আমি মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি বড় লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা করি। এই প্রকল্পের পিপিতে একটি বড় লক্ষ্যমাত্রার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইংরেজিতে সে কথাটিতে বলা হয়েছে যে এই মেট্রোরেল চালু হলে ব্যক্তিগত যানবাহনের ৭ ঘণ্টাব্যাপী অচল অবস্থার (স্ট্যান্ড ষ্টিল) অবসান হবে। তাহলে তারা সমীক্ষা করেছেন যে কোথায়ও কোথাও ব্যক্তিগত যানবাহনকে ৭ ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এটি প্রশ্নযোগ্য। আমি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করছি না। প্রশ্ন হলো এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্যক্তিগত যানবাহনের ৭ ঘণ্টা অচলাবস্থার অবসান কীভাবে হবে? প্রকল্পে বলা হয়েছিল ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহনের কথা। এতে রেলের কতটা ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে? একদিকে ৬০ হাজার যাত্রী প্রতি এক ঘণ্টায় পরিবহন করে ১০ ঘণ্টা যদি ধরি মানে সকাল ৮টা থেকে মোটামুটি অফিস শেষ হওয়ার সময় থেকে আরও দুয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত যে সংখ্যক ফ্লাইট চালাতে হবে সেটির পরিকল্পনা আসলে আরো একটু ভালো করে বোঝা দরকার। যদি সেটি চালানোও যায় তাহলে রেল দিয়ে পরিবহন করতে হবে ৬ লাখ যাত্রীকে। কিন্তু ঢাকায় বসবাসরত মানুষের সংখ্যা হচ্ছে সোয়া দুই কোটি। এর মধ্যে অন্তত ৬০ লাখ মানুষ প্রতিদিন নানা কাজে বাইরে বের হয়ে যানবাহনে চড়েন। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, শিক্ষার্থী, রোগী, মামলার তদবিরে আগত বিভিন্ন লোকজন, এর সঙ্গে জড়িত পুলিশ, আসামি, সাক্ষী এবং তাদের সঙ্গে জড়িত যানবাহন, সশস্ত্র বাহিনীর কোনো কোনো অংশ, ফায়ার ব্রিগেড, অ্যাম্বুলেন্স এবং অন্যান্যভাবে যাতায়াতকারী রোগী।

ঢাকা শহরে নবাগত বিভিন্ন অংশের দর্শনার্থী এবং যারা ব্যবসা করেন তারা ইত্যাদি মিলিয়ে এই ৬০ লাখ লোক গাড়িতে চড়েন এই শহরে। সোয়া দুই কোটির মধ্যে অনেকেরই জীবিকার কাজে বের হতে হয় না। প্রকল্পের প্রথম অংশে এই রেলের একটি বড় অংশ উত্তরায় বিস্তৃত যেখানে সেক্টর আছে ১৭টা সেখানে মনুষ্য বসবাস করে অনেক। উত্তরায় যারা বসবাস করেন তারা প্রায় সবাই অবস্থাপন্ন মানুষ। তাদের প্রায় সবারই ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। কিছু সরকারি কর্মচারী বাস করেন যারা তাদেরও ব্যক্তিগত ও সরকারি গাড়ি আছে। এখন রেল কর্তৃপক্ষ ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী আকৃষ্ট করবেন কী করে? এ বিষয়টি পরিষ্কার নয়। যদিও প্রথম স্টেশন থেকে শেষ স্টেশন অর্থাৎ মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়াটা খুব যৌক্তিক হয়েছে, যা ৪০ টাকা ২৫ পয়সা।

ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকরা বাসা থেকে স্টেশন পর্যন্ত আসবেন কী করে? অনেকে নিজে ড্রাইভ করেন। যারা উচ্চ শিক্ষিত মানুষ তারা গাড়ি নিজে চালান। সেটি একটি প্রশ্ন। যদি নিজে চালান তাহলে স্টেশনে নেমে গাড়িটা কোথায় রেখে যাবেন? ড্রাইভার যদি থাকে তাহলে তারা এটুকু অংশ চালিয়ে আবার চলে যাবেন। এরপর ধরুন যিনি মতিঝিল, শাহবাগ বা ফার্মগেট নামবেন সেটা কিন্তু তার মূল গন্তব্য নয়। একজন শাহবাগ নামলেন অথচ তাকে যেতে হবে শিল্পকলা একাডেমি বা এজি অফিসে। সেসব স্থানে তিনি কিসে করে যাবেন? মতিঝিল থেকেও বিভিন্ন গন্তব্যে তিনি কিসে করে যাবেন? স্টেশন থেকে এক মাইল দুই মাইল দূরে তার যে কাজ সেখানে কিসে করে যাবেন? নিশ্চয়ই রিকশা, অটোরিকশা, বাস, মিনিবাস, উবার ও অন্যান্য যানবাহন যা এখন চলছে। অর্থাৎ বর্তমান যানবাহনগুলো সেখানে থাকবে।

প্রতিদিন মানুষের সমৃদ্ধি বাড়ছে। তা কিন্তু ঘর্মাক্ত গণপরিবহনে চড়ার লক্ষ্যে নয়। এটা ব্যক্তিগত রুচির কথা। আমার ২-৩ কোটি টাকা আছে, আমি ২০ লাখ টাকা দিয়ে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি কিনব। এমনকি বিআরটিএ অফিস থেকেও দেখা যায় যে ঢাকা মেট্রো অঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ নতুন (রিকন্ডশন্ডসহ) গাড়ি আসে। অর্থাৎ ১২০০টি নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশের দিকে যাত্রা করছে। তো উন্নত দেশের কথা যদি ধরি তাহলে কিন্তু অনেক উন্নত দেশে মাথা প্রতি আড়াইটা করে গাড়ি আছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে গাড়ি আছে প্রতি ৪২৫ জনের জন্য একটি করে। আমাদের মোটামুটি সাড়ে ৪ লাখ গাড়ি আছে। তার মধ্যে ট্রাক, ভ্যান, অটোরিকশা, টেম্পো, মোটরসাইকেল, ট্রাক্টর, ব্যাটারি চালিত ভটভটিও অন্তর্ভুক্ত। তাই এ সবগুলো আসলে ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, কারের সংখ্যা আসলে অনেক কম। অথচ সমৃদ্ধির কারণে তা বাড়তে থাকবে। যানজট পরিস্থিতি তাহলে কিভাবে পরিবর্তন হবে তার লক্ষণ এখনই দেখা যাচ্ছে। যেমন রেলের যে অংশ নির্মিত হয়েছে তার পরিপার্শ্বটি পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ রেলটা যেখান দিয়ে চলবে তার আশেপাশে কী অবস্থা? এই রেল চালু হওয়ার আগেই মতিঝিল এলাকাটা ধরি কারণ এখানে যাত্রীর একটা বড় অংশ থাকবেন। এখানে আগে দু’সারির রাস্তা ছিল। একটা আপ একটা ডাউন। একটা ফার্মগেটের দিকে যাবার এবং অপরটি ফার্মগেট থেকে মতিঝিলে আসার। এখন সেখানে মেট্রোরেলের পিলার বসেছে এবং কোথাও কোথাও ট্র্যাক স্থাপনের কাজ চলছে। প্রতি দুটি পিলারের মাঝখানে হকার ও অন্যান্যরা দখলে নিয়েছেন। ট্র্যাক দুপাশে দুটি অর্থাৎ রাস্তা তিন ভাগ হয়েছে। ফলে নিচের দুটি রাস্তা অনেক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এই রাস্তায় এখন খুব ধীরগতিতে একটি যানবাহন চলতে পারে। তার মধ্যে দু’পাশের পুরোনো ভবনগুলো তো সেখানেই রয়ে গেছে। শাপলা চত্বর থেকে মধুমিতা পর্যন্ত যান অথবা মতিঝিল থানা থেকে পল্টনের দিকে যান, দুই পাশেই নানা রকম পথচারী, দোকানের গুচ্ছ ইত্যাদির কারণে মানুষ এবং যানবাহনের সংঘর্ষ ক্রমবর্ধমান। ফুটপাতও সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আবার রেল ট্র্যাকের দুই পিলারের ফাঁকা স্থানে ভ্যান, মোটরসাইকেল, গাড়ি, মিনিবাস, ভাঙা এবং পরিত্যক্ত ট্রাক এবং রান্নাঘরের বর্জ্যের বস্তা এর মধ্যে ওই ফাঁকা জায়গা দখল করেছে। ওই জায়গাগুলো এভাবে দখল করার কারণে এবং বিভিন্ন ফেরিওয়ালা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ায় এ রাস্তা পারাপার বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ মানুষ ওই অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর দিকে যাচ্ছেন। ওদিককার মানুষও অপর পারে আসছেন বিভিন্ন কাজে। তার ফলে রাস্তার প্রশস্ততা আরও কমে গিয়েছে। এদিকে আছে ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়। আমরা আগে বলতাম, ফুটপাত ফেরিওয়ালাদের দখলে। এখন অবস্থাটা কী সেটা গিয়ে দেখলেই বুঝা যায়। এই সংকীর্ণ অবস্থায় রাস্তাটি গাড়ি এবং মানুষের গতি দিন দিন কমিয়ে দিচ্ছে। অথচ ওখান দিয়ে যেতে ও আসতে হবে এবং এক পার থেকে অন্য পারেও চলাচল করতে হবে।

তেমনি শাহবাগ হয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত দুই পাশেই রাস্তা আরো সংকুচিত হচ্ছে। এই দৃশ্য কিন্তু নতুন নয়। এর আগে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভার এবং রাজারবাগ ফ্লাইওভারের পিলারের নিচগুলোকে দেখেন। সেখানে পরিত্যক্ত যানবাহন, ভিক্ষুক, বর্জ্য ও টেম্পোস্ট্যান্ড স্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ ফাঁকা কিছু নেই। ওখানেই আবার যাত্রী ওঠায় ও নামায়। ওখান থেকে যাত্রীরা বাসাবোর দিকে রওনা দেবেন, কিন্তু ব্রিজের নিচের ও আশপাশের এই ফ্যাক্টরগুলো রাস্তায় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। সেই সঙ্গে মালিবাগের মোড় থেকে যে গাড়িগুলো আসছে সেগুলো বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর কারণে কিন্তু আমি এখনো আসিনি। সেটা শেষে বলব। মেট্রোতে চড়ার ফলে প্রাইভেট যানবাহন কমবে এই তো প্রত্যাশিত। কার ছাড়াও প্রাইভেট যানবাহনের মধ্যে বড় বাস আছে এখনো, মাঝারি বাস আছে, মিনিবাস আছে এবং অটোরিকশা আছে। এতে কর্মরত চালক শ্রমিক বা অন্যান্য কর্মী মালিকের জীবিকা এবং তাদের ব্যাংকঋণ নিষ্পত্তির বিষয়টা কি হবে। সেগুলোকে কি আমরা আস্তে আস্তে অবলুপ্ত করতে পারব? এদের সাথে আর যারা জড়িত যেমন গাড়ি আমদানিকারক, রপ্তানিকারক তাদের বিষয়টা কি হবে? এতে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে সেটা মোকাবেলা করতে হবে। তারপর হচ্ছে ফ্লাইওভারের নিচের মতোই মেট্রোরেলের নিচের রাস্তায় অবস্থিত দোকান যেমন সেখানে রঙের দোকান আছে, রডের দোকান আছে, সিমেন্টের দোকান আছে। এসব জায়গায় যারা কিনতে আসবেন তাদের যানবাহনগুলো কোথায় পার্ক করা হচ্ছে এবং অধিকাংশেরই আন্ডারগ্রাউন্ড যানবাহন পার্ক করার জায়গা নেই।

আগে রাস্তাটা চওড়া ছিল বলে মগবাজারের আশপাশে যানবাহন পার্ক করা যেত। তেমনিভাবে ফার্মগেটের নিচ দিয়ে রাখা যেত। মতিঝিলেও একই অবস্থা। এখন সেগুলো অন্যান্য মানুষের হাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে, দখল হয়ে যাওয়ার ফলে, এই পার্কিং করাটা আরো কঠিন হবে। ফলে ট্রাডিশনাল যানবাহনগুলোকে নিচ দিয়ে চলতেই হবে। তাদের যানবাহনগুলো ওখানে কোথায় দাঁড়াবে? এটি একটি প্রশ্ন। আরো হচ্ছে যে ক্লিনিক, হসপিটাল, বাসা ও মসজিদ যেগুলো যেখানে সেগুলো কিন্তু সেখানেই থাকবে। সেসব জায়গায় যাতায়াত করা মানুষের অনেকেরই কিন্তু মেট্রোরেলে যাওয়ার দরকার নেই। ফার্মগেটে যারা বসবাস করেন ওখানেই স্কুল আছে, রাজারবাগে যারা বসবাস করেন ওখানেই স্কুল আছে। তাদের মেট্রোরেলে যাতায়াতের দরকার নেই। যেখানে মসজিদ আছে সেখানে নামাজ হবে। তারা যে রাস্তা পারাপার হবেন তাদের অবস্থাটা ক্রমশ কি রকম কঠিন জটিল এবং অসামাজিক হবে সেটা আগে ভাবতে হবে।

এখানে বাইরের লোকও আসবেন স্থানীয় অধিবাসী ছাড়াও। তাদেরও বাইরে যাতায়াত করাটা খুবই কঠিন হবে। উত্তরা থেকে যিনি ফার্মগেটে এসে নামবেন তাকে তো আনন্দ সিনেমা হল হয়ে গ্রিন রোডের দিকে যেতে হবে নানা কাজে। তাকে আকৃষ্ট করার জন্য ওখানে অনেক রিকশা, টেম্পোর মতো যানবাহন থাকবে। আবার ফার্মগেট থেকে হলিক্রস কলেজের দিকে যদি ঘুরি, তেজকুনিপাড়ার দিকে যাই, এসব জায়গায়ও একই অবস্থা হবে। তো এগুলোর ব্যবহারকারীদের জন্য প্রতিটি রাস্তা ক্রমে আরো সংকীর্ণ হবে এবং তারা বেশ অসুবিধার মাধ্যমে চলবেন।

তাছাড়া মেট্রোর প্রতিটি স্টেশনে যাত্রীদের ভিড়ের কারণে সেখানে রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন অপেক্ষা করবে যাত্রীদের নিয়ে অন্যান্য গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। সেটা কিন্তু ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে, কারণ বিভিন্ন যানবাহন পরিচালনাকারীরা জানবেন যে, এখন যাত্রী কোথা থেকে ধরতে হবে। চলমান যাত্রীদের মেট্রোরেলের স্টেশনে নিয়ে যেতে হবে এবং সেখান থেকে তাদের নিয়ে আসতে হবে। এই বিষয়টায় ৬০ হাজারের লক্ষ্যমাত্রা যদি ধরি ঘণ্টায় তাহলে এই কয়টি স্টেশনে কি পরিমাণ মানুষ উঠবেন-নামবেন? অফিসের যাত্রী, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং শিক্ষার্থীরা মেট্রোরেলের এলাকায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত যে ভিড় এবং যানজটের সিংহভাগ সৃষ্টি করবে তা নিশ্চিত। কারণ এই জনসংখ্যা হচ্ছে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ যা আমি আগে বলেছি। এদের আধিক্যের কারণেই কেবল ওই সময়ের মধ্যে এদের অধিকাংশকে মেট্রোরেলে পরিবহন করা যাবে না। তারা এটি পছন্দ করা সত্ত্বেও। তারা নিচ দিয়ে চলাচল করবেন ছোটখাটো যানবাহন নিয়ে। এদের অনেকের আবার প্রতিষ্ঠানের যানবাহন আছে। তার মানে যানজট ওখানে কমছে না।

যেমন সরকারি কর্মচারীদের অধিকাংশেরই বড় বড় বাস আছে কিংবা অন্যান্য যানবাহন আছে। সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের নিজস্ব যানবাহন আছে। আদালতের নিজস্ব যানবাহন আছে। এছাড়া অনেকের আছে ব্যক্তিগত যানবাহন। আর যাদের ব্যক্তিগত যানবাহন নেই তারা বাস, মিনিবাস, অটোরিকশায় চড়া অব্যাহত রাখবেন। আর মোটরসাইকেল, পাঠাও ও শেয়ার রাইডিং। এগুলোর সংখ্যা কিন্তু দিনে দিনে এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তারা ফুটপাতের ওপর উঠে যায়। যে কারণে ফুটপাতের ওপর বিভিন্ন জায়গায় লাল রঙের পিলার দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে তারা বাধ্য হয়ে মেইন রাস্তা দিয়েই চলে। এর কারণ পরে বলছি।

এটা কিন্তু অব্যাহত থাকবে কারণ এগুলো দ্রুতগতিতে যায়। অলিগলি চট করে পার হয়ে গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছে যেতে পারে। যাদের দ্রুত যাওয়া দরকার অথবা কোনো স্থানে একটি জিনিস ডেলিভারি দিতে যাবেন তাদের এগুলো দিয়ে চলা অব্যাহত থাকবে।

এগুলো কোনো আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না। এছাড়া মেট্রো স্টেশনে পৌঁছা, স্টেশন থেকে ওঠা এবং নামা নিয়ে একটা বিরাট ভিড়ের সৃষ্টি হবে এটা স্বাভাবিক কথা। কারণ ঘুরেফিরে সবকিছু ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহনের যে লক্ষ সেটা বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা দেখেছি কারওয়ান বাজারে যে আন্ডারপাস সেখানে কি পরিমাণ ভিড়। গুলিস্তানের ওখানে কি পরিমাণ ভিড়। মানুষে মানুষে সংঘর্ষ। সেটা দেখেছি ৫-৭ বছর আগেই। এখন সেটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তাছাড়া এসব যানবাহন ভাড়া কমিয়ে কাজ করবে যখন দেখবে যে ট্রেনে মানুষ যাচ্ছে। মেট্রো স্টেশনের মতো নির্দিষ্ট স্থান বা অন্যত্র না নামিয়ে বরং যাত্রীকে তার আসল গন্তব্যে নামিয়ে দেওয়ার সুবিধা দেওয়ার ফলেও যাত্রীদের কাছে এগুলোর আকর্ষণ বেশি থাকবে বলে আমি মনে করি। ফলে জট কমার কোনো কারণ নেই।

ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ এবং ফুটপাত সংকীর্ণ করে রাস্তার প্রশস্তকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও যানজট বেড়ে চলেছে- এটা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য। তাই আমরা রেল ট্র্যাক বানাচ্ছি? এ প্রসঙ্গে অন্য একটি উদাহরণ দেই। তা হলো Allternate Dispute Resolution হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সামাজিক আপসের মাধ্যমে ফরমাল কোর্টে না গিয়ে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা করা। এটা কেন সরকার করেছে? তার কারণ হচ্ছে ২০১৩ সালে মামলা জট ছিল ৩০ লাখ। ২০১৮ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ৩৫ লাখ। বর্তমানে অর্থাৎ ২০২১ সালে ৪০ লাখ মামলা জট রয়েছে। তারপর Allternate Dispute Resolution চালু করার কয়েক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও মামলা জট ৪০ লাখে উন্নীত হয়েছে। যানজট এবং মামলাজট একই সুত্রে গাঁথা।

মেট্রোরেল যানজট কতটা নিরসন করতে পারবে তাতে আমার সন্দেহ আছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের ফলে যাত্রীদের এক-চতুর্থাংশ কিন্তু একটি সুবিধা পেয়েছেন। তা হলো প্রকল্প এলাকার ভেতর খুব দ্রুতবেগে চলা যাচ্ছে। আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি, হাতিরঝিলের বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করে যাত্রীদের একটা অংশ খুব দ্রুত চলাচল করতে পারছে। সেটা কি রকম? আপনি ধরুন রাইফেল শ্যুটিং ক্লাব থেকে মগবাজারে আসবেন আগে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া দিয়ে আসতেন তাতে সময় লাগত বেশি। কিন্তু এখন আপনি শ্যুটিং ক্লাবের ভিতর দিয়ে ঢুকে হাতিরঝিল প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মগবাজার চৌরাস্তায় আসতে পারছেন খুব দ্রুত গতিতে, যার দূরত্ব অতিরিক্ত চার কিলোমিটারের বেশি। অনেক যাত্রীর ক্ষেত্রে এই চার কিলোমিটারের ব্যয় বহন করা কষ্টকর। কিন্তু একটা সুবিধা হয়েছে এই পর্যন্ত অনেক আরামে আসলাম। কিন্তু মগবাজার থেকে যেখানে যাবেন সেখানে যেতে কিন্তু আগের সময়ই লাগবে। এর কারণ কি? ওখানে তো আগে থেকেই আটকে আছে অনেক যান। তারপর আপনি ওখানে পড়লেন ওইসব যানবাহনের সঙ্গে। তারপর প্রতিযোগিতা করে আপনি মগবাজার চৌরাস্তায় যাবেন, বাংলামোটরে যাবেন, কিংবা বেইলি রোড বা রাজারবাগের দিকে যাবেন। সেটা কিন্তু আগের মতোই দীর্ঘ সময় লাগবে। রামপুরাতে এত ভিড় যে, আমি রামপুরা টেলিভিশনের এন্ট্রি পয়েন্ট থেকে হাতিরঝিলে ঢুকে গুলশানে যাব। ভেতরের রাস্তায় দ্রুত বেগেই শ্যুটিং ক্লাবের মাথায় আসতে পারবেন। তারপর আড়ংয়ের মোড় থেকে ডান দিকে গুলশান ১ নম্বর বা ২ নম্বরে যাবেন। তখন প্রচণ্ড জটের মধ্যে আপনাকে পড়তে হবে। কারণ ওখানে আগে থেকেই অনেক গাড়ি অপেক্ষমাণ রয়েছে। ফলে একটা সুবিধা হয়েছে এই যে, ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ একদম আরামে আসছেন কিন্তু প্রকৃত দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে, ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। তেমনি মেট্রোরেল প্রকল্প অর্থাৎ মূল গন্তব্যে পৌঁছতে রেলের ওপর যখন চড়ব ততক্ষণ দ্রুতগতিতে যেতে পারব, এটা ঠিক। কিন্তু তারপর স্টেশন থেকে নানা গন্তব্যে যেতে সময় ও জট এড়ানো যাবে না।

এই রেলস্টেশনগুলোর একটাও যাত্রীদের মূল গন্তব্য নয়। ফার্মগেটে কোনো অফিস নেই। মতিঝিলে অফিস আছে, হাজারো ব্যাংক আছে। আছে মধুমিতা সিনেমা হল। তারপর স্টক এক্সচেঞ্জ। এখানে লাখ লাখ মানুষ ভিড় করেন। সেখানে কিন্তু মতিঝিলে নেমেই যেতে হবে। তখন শাপলা চত্বর থেকে আপনি যানজটে পড়বেন এবং সেটা কি রকম অবস্থা হবে তা অনুমেয় বর্তমান পরিস্থিতি দেখেই। মেট্রোরেলে যে সিংহভাগ যাত্রী চড়বেন তাদের জন্য এবং যারা নিচের পথে যানবাহনে চড়বেন তাদের জন্য যানজট হ্রাস পাবে না। মামলা জটের মতোই এর প্রধান কারণ হচ্ছে জনসংখ্যাধিক্য। আমি বলতে চাচ্ছি ৩০৬ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আয়তন। তার মধ্যে বসবাস করেন সোয়া ২ কোটি মানুষ। কিন্তু ইউএনএফপি জনসংখ্যার বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে একজন মানুষের জন্য কতটুকু স্পেস দরকার। কতটুকু টয়লেট দরকার, এমনকি কারারুদ্ধ মানুষের জন্য কতটুকু স্পেস দরকার, কতটুকু অক্সিজেন দরকার, ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কতটুকু জায়গা দরকার সবকিছুই হিসাব করেছে। তাতে সর্বসাকুল্যে ঢাকা শহরে বাস করতে পারেন ৫০ লাখ মানুষ। কিন্তু এখানে মানুষ হয়েছে সোয়া ২ কোটি। আর দেশে বছরে ২২ লাখ করে মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ২২ লাখের একটি অংশ ঢাকায় ঢুকছেন প্রতিদিন।

ঢাকায় প্রতিদিনই নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট, হাউজিংয়ের বিল্ডিং উদ্বোধন হচ্ছে। সেগুলোতে কারা থাকছেন? এই নতুনরা? ফলে জনঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য এরা আসছেন। এতটুকু জায়গায় এই মানুষজনকে হ্যান্ডল করতে গেলে আসলে এই অবস্থা অনিবার্য। আমি কোনো কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করছি না। কর্তৃপক্ষের এসব প্রকল্পের উদ্যোগ অত্যন্ত শুভ। কিন্তু বিজ্ঞানে একটা কথা আছে। তা হলো সর্বোচ্চ বহনক্ষমতা। একজন ছাত্রকে যদি আপনি দিনে ২৬ ঘণ্টা পড়তে বলেন তাহলে কিন্তু আর দিনের সংজ্ঞা রইল না। তেমনি সবকিছুরই একটা বহনক্ষমতা আছে। তার বাইরে বহন করা যাবে না।

একটি জেলখানায় কতজন কারাবন্দিকে রাখবেন তার নির্দিষ্ট সংখ্যা থাকতে হবে। একজন জজকে আপনি বিচার করতে দিয়ে বলবেন ‘সুষ্ঠু বিচার চাই’। কিন্তু তাকে যদি দিনে ১৭টি মামলা নিতে হয় তাহলে তিনি বিচার করতে পারবেন না। সবাইকে হাজির করে একটা রায় দিতেই কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। একটা শুনানি নিতে অন্ততপক্ষে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। এভাবে ওয়ার্কিং আওয়ারের মধ্যে কয়টির শুনানি নেওয়া সম্ভব? অনুরূপভাবে এইটুকু ছোট্ট জায়গায় সোয়া দুই কোটি মানুষের বসবাস। প্রতিদিন আরো ৬ হাজার মানুষের প্রবেশ। এভাবে আমরা সর্বোচ্চ বহনক্ষমতাকে ক্রমাগত লঙ্ঘন করেছি। কাজেই মেট্রোরেল যানজট কতটুকু দূর করতে পারবে তা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়।

সম্প্রতি আপনারা পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগরবিদ হাবিব সাহেবের বক্তব্য হয়তো টিভিতে দেখেছেন। আমিও দেখেছি। আর মেট্রোরেলের চলাচলের ক্ষেত্রটা কতটুকু? সাড়ে ১২ মাইল। এর মধ্যে একটি অংশ অর্থাৎ শহরের সাড়ে ১২ মাইল এলাকার মধ্যে ট্রেনটা দ্রুত গতিতে ছুটতে পারবে। এটা ঠিক। কিন্তু তারপর যাত্রীদের কি অবস্থা হবে সেটি দেখা যাবে। যানজটের সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। সেটা আরেকটা বিষয়। ‘স্ট্যান্ড স্টিল’ বলা হয়েছে, যানজট নিরসন হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে যানজটের সংজ্ঞাটা কি। কতটুকু গতি পেলে আমরা ঠিক করব যে এটা যানজট নয়। আমরা সেই সংজ্ঞায় না গিয়ে দেখি যে, বিভিন্ন সমীক্ষায় এ পর্যন্ত দেখা যায় ১৯৮৫ থেকেই ঢাকা শহরে যানবাহনের গড়গতি ১৫ কিলোমিটার ছিল। মানে ১ ঘণ্টায় ১টি গাড়ি গড়ে ১৫ কিলোমিটার চলতে পারতো। সেটা কমে ১২, ১০, ৮, ৭ কিলোমিটার হয়ে ২০২০ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায় সাড়ে ৪ কিলোমিটারে এসে নেমেছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মেট্রোরেল প্রকল্পটা নেওয়া হয়েছে। ভালো কথা। এর মধ্যে আবার ব্যক্তিগত কারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যদিও সেটার সংখ্যা নগণ্য। লক্ষ্যের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে ‘ব্যক্তিগত যানবাহনের স্থবির অবস্থা দূর করা হবে’। ঘণ্টায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার বেগে গাড়িতে বসে থাকতে যদি যাত্রীর আপত্তি না থাকে তাহলে আপত্তিটা কার? মানুষ কিন্তু এর মধ্যেও গাড়ি কিনছেন। এসব গাড়ি অব্যবহৃত থাকলেও সেটা নষ্ট হবে। ব্যাংক লোনের ব্যাপার আছে। এর সঙ্গে জড়িত অর্থনীতির একটা ব্যাপার আছে। সেটা হলো ড্রাইভার, মেকানিক, পেট্রোল ব্যবসা, মবিল ব্যবসা, খুচরা যন্ত্রাংশ মেরামতের কারখানাগুলোতে জড়িত শ্রমিক অর্থাৎ এসবের সাথে যারা জড়িত তাদের কি হবে? কাজেই দেশের এবং ঢাকার জনসংখ্যা হ্রাস করতে না পারলে মেট্রোরেল দিয়ে যানজটের অধিকাংশই দূর করা যাবে না বলে আমি মনে করি। সেটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

এ প্রসঙ্গে জাতির পিতার একটা কথা বলি। জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে এক ভাষণে বলেন যা আমি নিজে শুনেছি। তিনি বলেন, জনসংখ্যাকে অবশ্যই রোধ করতে হবে। তখন জনসংখ্যা ছিল কত? মাত্র সাড়ে সাত কোটি। সেখান থেকে আরো একটি কথা বলেন, দুঃখের সাথে বলতে হয় আমাকে যে, একটি ফৌজদারি মামলায় দেড় বছর সময় লাগে নিষ্পত্তি হতে।’ আর এখন একটা ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি হতে ১২ থেকে ১৮ বছর সময় লাগে। সেটা আহসানউল্লাহ মাস্টারের মতো বিখ্যাত মানুষ হন আর প্রথম আলোর মালিক লতিফুর রহমানের মেয়ের হত্যার মামলাই হোক। এর কারণ হচ্ছে মামলাজট। কারণ মামলার সংখ্যা ৪০ লাখ। উকিলের সংখ্যা ৯১ হাজার আর বিচারক ২০০০ জন। তাহলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, জনসংখ্যা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি দ্রুত বিচারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। বলেছেন যে কেউ অপরাধী হলেও তার দ্রুত বিচার করার ব্যবস্থা নিন। অনুরূপভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩০ সালে এ বাংলাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, আমাদের জন্মশাসন অবশ্যই কর্তব্য। কারণ তিনি দেখেছেন দুই বাংলায় জনসংখ্যা কীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং তাতে কি সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে।

এখন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেন জনসংখ্যা নাকি সমস্যা নয়। এই ধরনের নাশকতামূলক কথা যারা বলেন তাদেরকে দায়িত্ব দেন। জনসংখ্যা যদি জনসম্পদই হবে তাহলে আপনি যানজট দূর করার পদক্ষেপ নিচ্ছেন কেন? মানুষের স্বাধীনভাবে চলার মাধ্যম ও অধিকার তার ব্যক্তিগত গাড়িকে কেন নিয়ন্ত্রণ করবেন? এগুলো আসলে ঠিক নয়। আমরা জানি নিশ্চয়ই জাতির পিতা কিংবা বিশ্বকবি অনেক মেধাবী ছিলেন। আমরা কেউ তাদের মেধার সামনে কিছুই না। সচিব এ. এম. এন সিদ্দিকী এমনকি যিনি এটির দায়িত্বে আছেন আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। তার সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় আমার। তিনি খুব ভালো কাজ করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারও শুভ ইচ্ছা নিয়ে কাজটা করেছে যে, এতে একটা কিছু হবে। তবে মূল যে লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে সেটি অবিলম্বে তো দূরের কথা বিলম্বেও মিলবে না কারণ হলো ওই ২২ লাখ করে মানুষ বাড়ছে।

একটি অংশ এটার ব্যবহারকারী হবেনই। সেই সঙ্গে অন্যান্য যেসব কথা বললাম আনুষঙ্গিক গাড়ি বৃদ্ধি, রাস্তা সংকীর্ণ হওয়া, আরো প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি, এমন মানুষকে সার্ভ করার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি, স্কুল, হসপিটাল, ইউনিভার্সিটির বৃদ্ধি এগুলো পরিচালনার জন্য নিচের পথে নতুন নতুন যানবাহনের আগমন ঘটবেই। সেটা প্রাইভেটকার হোক কিংবা বড় পাবলিক বাস হোক। এগুলো যানজটকে বাড়াতে থাকবে। ক্রমবর্ধমান মানুষ তথা যাত্রীদের পরিবহন করতে হলে যানবাহন বাড়াতে হবে। যানজটও তাতে বাড়বে। কারণ স্থান ছোট। গণতান্ত্রিক এই দেশে কোনো আইন দিয়েই কার আমদানি বন্ধ করা যাবে না। মেট্রোরেলে ৬০ লাখ যাত্রীর সামান্য অংশ পরিবহন করা সম্ভব। সক্ষমতা, সামাজিক শ্রেণিবিভাগ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার কারণেও লাখ লাখ যাত্রীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গণপরিবহনে চলতে বাধ্য করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে আদর্শ অবস্থায়ও মেট্রোরেল দৈনিক যাত্রীর অধিকাংশকে পরিবহন করতে সক্ষম হবে না। আমাদের জনচরিত্র ইতালি বা থাইল্যান্ডের মতো হবে না। আবার মানুষের বাড়ছে সমৃদ্ধি। তাই বিলাসবহুল ও সাধারণ ব্যক্তিগত কার আমদানি বাড়াতে থাকবে এবং মানুষ তাতে চড়বেন। এর ফ্লেক্সিবিলিটি ও কমপেটিবিলিটির কারণে (একটি ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি যেকোনো অলিগলি গৃহ অফিস বা ভবনের আশপাশে যেতে পারবে। সেটার মতো তা সরলরৈখিক নয়।) তাই মেট্রো বহির্ভূত এবং মেট্রোর নিচের সড়কগুলোতে ওই ৬০ লাখ যাত্রীর অধিকাংশই ভ্রমণ করবেন জীবন ও জীবিকার নানা প্রয়োজনে। ফলে যানজট নিরসন বা সহজীকরণ হওয়ার যুক্তি খুব দৃঢ় বলে মনে হয় না। আর এগুলোকে পর্যায়ক্রমে অবলুপ্ত করে তাতে কর্মরত লোকজনের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা করা কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব হবে না। এটা কিন্তু নয়ারহাটের ছোট্ট ব্রিজ নির্মাণের মতো না যে, কয়েকজন নৌকার মাঝি ছিল। তাদের ওই প্রকল্পের মধ্যেই চাকরি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আমি মনে করি যে জনসংখ্যাকে আস্তে আস্তে কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তারপরই আমরা যে সব প্রকল্প নেই না কেন সেগুলো সফলতার মুখ দেখতে পাবে। মোটের ওপর ৬০ লাখ যাত্রীর ৫৪ লাখই মেট্রোর নিচের সনাতন যানবাহন ব্যবহার করবেন। ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধি পাবে। তাই মেট্রোরেল যানজট কমাতে পারবে বলে মনে হয় না।

কর্ণফুলী টানেলটা আসলে ঠিক আছে। তাই টানেল বাস্তবায়নে অসুবিধা হবে না। ওটা মূলত জনকল্যাণকর হবে। প্রকল্প সাংহাইয়ের আদলে গড়া। চট্টগ্রাম নগরী- কক্সবাজারের যানজট নিরসন এবং এশিয়ান হাইওয়ের সাথে দেশের সংযুক্তি অনেক অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করবে।

লেখক: মাসুদ আহমেদ, গল্পকার ও প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন কম্প্রোট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :