উ ন্ন য় ন

রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা তাঁর কাছে প্রত্যাশা

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০২১, ০৯:০০

মাসুদ কামাল

একটু নেতিবাচকভাবেই না হয় শুরু করি।

আমার পরিচিত একজন সেদিন এসে বললেন, এলাকায় তিনি একটা সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছেন। খুব একটা বড় কাজ নয়, তারপরও লাখ চল্লিশেক টাকা তো তার থাকবেই।

আমি একটু অবাকই হলাম। তাকে বেশ কিছুদিন ধরে চিনি। বেশ ভদ্র ছেলে, ঢাকায় একটা ভালো চাকরি করেন। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন। এলাকায় মোটামুটি পরিচিতি আছে। এবার যখন জেলায় যুবলীগের কমিটি হলো তাতে তিনি জায়গা পেলেন। একটু ধরাধরি করেই একটা সম্পাদকীয় পদ পেতে হয়েছে তাকে। আমি বলেছিলাম, আপনি তো ঢাকায় থাকেন, জেলা যুবলীগের কমিটিতে আপনার কি কাজ? উত্তরে সে যা বলল, শুনে একটু অবাকই হলাম। “জেলা কমিটির অনেকেই তো ঢাকায় থাকেন। এটা কেবল আমাদের জেলাতেই নয়, দেশের সকল জেলাতেই আপনি এই দৃশ্য দেখবেন।  আমি ছাত্রলীগ করেছি, এখন তার পরবর্তী ধাপ হিসেবে যুবলীগ না করতে পারলে হারিয়ে যাব। চাকরি করি তাতে কি হয়েছে, রাজনীতিও তো করতে হবে!”

এখন যুবলীগের নেতা হিসেবে একটা সেতু তৈরির কাজ পেয়েছেন তিনি। তিনি একা নন, তার কমিটির আরো অনেকেই এমন কাজ পেয়েছেন। কাজটি পেতে চেষ্টা করেছেন অনেকেই, তবে সরকারি দলের নেতা যারা তারাই শেষ পর্যন্ত কাজগুলো পেয়েছেন। আমি জানতে চাইলাম, “এ ধরনের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা কি আছে আপনার?”

“না, নেই। তবে কাগজপত্রে আছে। আমি অন্য একজনের কাগজপত্র ভাড়ায় নিয়েছি। আসলে কাজটা তারাই করছে, কাগজপত্রে আমি তাদের মালিকানার অংশ হয়ে আছি। সে কারণে কাজ শেষে মুনাফার একটা বড় শেয়ার আমি পাবো।”

সেই শেয়ারের পরিমাণটাই গিয়ে ৪০ লাখ টাকার মতো দাঁড়াবে। হিসাবটা শুনে আমি চুপ করে রইলাম। ভদ্রলোক বললেন, “আপনি অবাক হচ্ছেন কেন? এটা নতুন কিছু নয়। এই দেশে সবসময়ই এমন হয়। এলজিইডি বা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ তো এভাবেই বিলি-বণ্টন হয়। এই সরকারের আমলে কাজকর্ম একটু বেশি হচ্ছে বলে অনেকের চোখে পড়ছে।” 

এই শেষ বাক্যটি আমার মনে ধরল। আসলেই এই সরকারের আমলে কাজকর্ম একটু বেশি হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে আজ ১৩ বছর। টানা এতগুলো বছর এর আগে আর কেউ এদেশে ক্ষমতায় ছিল না। দীর্ঘ এই সময়ে দেশ কতটুকু এগিয়েছে? একটি দেশ কতটুকু অগ্রসর হলো বা পিছনের দিকে গেলÑ সেসব নির্ণয়ের কিছু প্যারামিটার আছে। মানুষের আয়ু, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক অবস্থা, দুর্নীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা, পরিবেশ, এমনকি সবুজায়নÑ এসব বিবেচনায় নিয়েই নির্ধারিত হয় একটি দেশ কতটুকু এগিয়েছে। যে প্যারামিটারগুলোর কথা এখানে উল্লেখ করলাম, তার বাইরেও কিছু বিষয় হয়তো রয়েছে। কিন্তু মোটা দাগে এই কয়টির কথাও যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখবÑ অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু বিশ্বপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান অবিমিশ্র ইতিবাচক নয়।  পৃথিবীতে বর্তমানে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা রয়েছে। এরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন দেশের র‌্যাংকিং করে। যেমন কেউ কেউ বলে দুর্নীতিতে পৃথিবীর কোন দেশের কী অবস্থান, আবার কোনো একটি সংস্থা হয়তো মানবাধিকারের বিবেচনায় একটা তালিকা প্রকাশ করে, আবার কেউ হয়তো রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতাÑ ইত্যাদি নিয়ে তালিকা বানায়। বলা বাহুল্য, এসবের প্রায় প্রতিটিতেই আমাদের অবস্থান থাকে  নিচের দিকে। সরকারের দিক থেকে অবশ্য প্রতিবারই প্রতিবাদ করা হয়। বলা হয়Ñ এই মূল্যায়ন বা তালিকা আসলে বাস্তবসম্মত নয়, পক্ষপাতদুষ্ট, বিশেষ গোষ্ঠীর প্ররোচনায় এটা করা হয়েছে। সরকারের মন্ত্রীরা বলেন, মিডিয়াতে সেসব প্রকাশিত হয়, তবে তালিকায় অবস্থানের পরিবর্তন হয় না।

কিন্তু একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয় না। বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় প্যারামিটারগুলোতে আমরা যদি এতই নিচে থাকি, তাহলে অর্থনীতির বিবেচনায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কীভাবে? কীভাবে এবং কেন আমাদের জিডিপি বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের আয়ু? অর্থনৈতিক সক্ষমতা না বাড়লে পদ্মা সেতুর মতো একটা বিশাল স্থাপনা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কীভাবে? রাজধানী ঢাকাতে কিংবা হাইওয়েতে কীভাবে একের পর এক তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার?

কিছু পরিসংখ্যানের দিকে বরং তাকানো যাক। বিএনপি সরকারের শেষ দিকে, ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় উৎপাদন প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার ছিল ৫.৪ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার । এই সরকারের আমলে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের হিসাবে দেখা যায় জিডিপির হার হয়েছে ৮.১৩ শতাংশ। আর মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৯০৯ মার্কিন ডলারে। এখানে একটা প্রশ্ন অনেকেই করেন। ১৯০৯ ডলার মানে আমাদের টাকায় এক লাখ ৬২ হাজার টাকার মতো। বছরে গড়ে এত টাকা কি দেশের প্রতিটি মানুষ আয় করে থাকেন? আসলে গড় হিসাবের ফাঁকিটা এখানেই। বছরে এত টাকার অর্থ হচ্ছে মাসে ১৩ হাজার টাকার মতো। তাহলে যে পরিবারে চারজন সদস্য তাদের প্রতি মাসে ৫২ হাজার টাকা আয় হওয়ার কথা, সেটা নিশ্চয়ই হয় না। একজন শিল্পপতির মাসিক আয় ধরা যাক এক কোটি টাকা, আর তার একজন কর্মচারীর আয় ৩০ হাজার টাকা। দুজনের আয়ের গড় করলে দাঁড়ায় ৫০ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এখন এই দুজনকেই যদি বলা হয়Ñ তাদের গড় আয় এই ৫০ লাখ ১৫ হাজার টাকাÑ মানবেন তারা? হয়তো সে কারণে অর্থনীতির এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, গড় আয়ের হিসাবটি আসলে এক ধরনের সান্ত্বনার হিসাব। বলা হয়ে থাকে, চলমান পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গড় আয় বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে ধনী আরও ধনী হওয়া, মধ্যবিত্ত সব গরিবে পরিণত হওয়া।

পরিসংখ্যান বা অর্থনীতির হিসাব কিন্তু সে কথা বলছে না। আগেই বলেছিÑ আমাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। বেড়েছে জাতীয় বাজেটের আকার। বাজেট বাস্তবায়নে আগে বিদেশি সাহায্যের ওপর যেরকম নির্ভর করতে হতো, সেই নির্ভরশীলতাও অনেকটাই কমেছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ যে কিছু নিতে হচ্ছে না, তা নয়। নতুন ঋণ কিছু হচ্ছে, তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো আগে যে ঋণগুলো করা হয়েছিল, সেসব বৈদেশিক ঋণও পরিশোধ করা হচ্ছে নিয়ম মেনেই। এতসব করার পরও সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধির কারণে দারিদ্র্যের হার নিম্নমুখী, বর্তমানে এটা ১৪ শতাংশের কম। এই হিসাবকে সত্য ধরলে মানতেই হবে যে, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় গরিবি কমেছে।  সমালোচকরা অবশ্য অন্য কথা বলেন। তাদের মতে, গরিবি আসলে কমেনি, গরিবের সংখ্যা বেড়েছে, তবে দারিদ্র্যের মাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়েছে। এ কারণেই না খেয়ে কেউ মারা যাচ্ছে না। কিন্তু অভাব তাদের ছাড়ছে না। এইসব তথ্য অর্থনীতির পরিসংখ্যান, বাস্তব পরিস্থিতিÑ সবকিছু মিলিয়ে চিন্তা করলে কিছুটা হলেও ধন্ধে পড়ে যেতে হয়।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যে বেড়েছে তা নিয়ে কেউই সন্দেহ করবেন না। আসলে সন্দেহ করার কোনো সুযোগও নেই। ফ্লাইওভার, সেতু, মেট্রোরেল, সম্প্রসারিত মহাসড়কÑ এসব তো দৃশ্যমান। চাইলেও অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। উন্নয়নের ঢেউ রাজধানী থেকে শুরু করে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছে। গ্রামেও রাস্তাঘাট হচ্ছে, সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এই যে নির্মাণকাজ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডÑ এর অবধারিত অনুষঙ্গ হিসেবে দুর্নীতিও বিস্তৃত হচ্ছে না? একে মনে হয় অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের দেশে যেকোনো সরকারি নির্মাণকাজের সঙ্গে দুর্নীতির বিষয়টি যে একেবারে জড়াজড়ি করে থাকে, সেটা আমরা অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি। কিন্তু সেটি যখন অবিশ্বাস্য আকার ধারণ করে, তখনই তা নিয়ে হয় হইচই। দুর্ভাগ্য আমাদেরÑ এ রকম হইচই এখন প্রায়ই শুনতে হচ্ছে।

আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি শেখ হাসিনাকে খুবই পছন্দ করেন। তার বিবেচনায় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত সরকারপ্রধান এসেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে সফল ও কৌশলী হলেন শেখ হাসিনা। এমনকি রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি মেয়েকে তার পিতার চেয়েও উপরে রাখেন। তার মতে, সরকার পরিচালনা করতে গেলে কেবল উদার থাকলেই চলে না, কখনো কখনো কঠোর হতে হয়। সেই বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে।

আমার সেই বন্ধুটিও ইদানীং কিছুটা হতাশ দেশজুড়ে দুর্নীতির বিস্তার দেখে। সেদিন কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই তিনি বললেন, “যদি কেবল দুর্নীতির লাগামটা টেনে ধরা যেত, তাহলেই দেখতেন পাল্টে গেছে দেশের চেহারা। সরকার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে, কিন্তু সেসব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঝামেলা হচ্ছে।”

দুর্নীতির বেশকিছু প্রচলিত উদাহরণও তিনি দিলেন। সরকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। প্রকল্পটি তো বড়, বাস্তবায়িত হলে মানুষের উপকার হবে। কিন্তু সরকার কি বলে দিয়েছিল সেখানে এক একটা বালিশ ছয় হাজার টাকা করে কিনতে? অথবা বালিশ ভবনের উপরে তুলতে প্রতিটির জন্য ৭৬০ টাকা করে খরচ ধরতে? এই যে বালিশ নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল, তারপরও কি কারও শিক্ষা হলো? এ ঘটনার মাস কয়েক পর দেখা গেল চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্পে প্রতিটি বালিশের দাম ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৭২০ টাকা, আর বালিশের কভারের দাম ধরা হয়েছে ২৮ হাজার টাকা করে! এটা কীভাবে সম্ভব? রূপপুরের ঘটনা নিয়ে যে বিপুল হইচই হলো, এরা কি সেটা দেখেনি?  নাকি দেখেও পাত্তা দেয়নি? হয়তো ভেবেছেÑ যদি কেউ হইচই না করে তাহলে তো টাকাটা পেয়েই গেলাম। আর দেখে ফেললেই বা কী হবে? না হয় কিছুটা বদনাম হবে, চাকরি তো আর যাবে না! দেশে একবার বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়ে গেলে এই সমস্যাটি হয়। তখন আর প্রয়োজনের সময়ও ঠিকঠাক মতো বিচারটি করা যায় না।

আমার সেই বন্ধুটির দুঃখটা এখানেই। বললেন, “আচ্ছা, শেখ হাসিনা নিজে কি দুর্নীতি করেন? নিশ্চয়ই করেন না। তাহলে দুর্নীতিবাজদের ধরে ধরে দৃষ্টান্তমূলক সাজাটা কেন দিচ্ছেন না? দু-একজনকে সাজা দিলেই কিন্তু অন্য দুর্নীতিবাজরা সতর্ক হয়ে যায়।”

বন্ধুটি আরও বলেন, “বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অবস্থান এখন এমন এক জায়গায় উন্নীত হয়েছে, ওনাকে আর কারও মুখের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কারও অনুমতির অপেক্ষায় থাকতে হয় না। ওনার চেয়ে ক্ষমতাধর এদেশে আর কেউ নেই। তাহলে কেন ওনার নাম ভাঙিয়ে কিছু দুষ্ট লোক অপকর্ম করার সুযোগ পাবে?”  এমন প্রত্যাশার প্রতিফলন আমরা কোথায় কীভাবে দেখতে পাবোÑ কে জানে।

শুধু বালিশের মতো কেনাকাটাতেই নয়, দুর্নীতি কি চলছে না বড় বড় নির্মাণ কাজেও? রাস্তা, সেতু, মহাসড়কÑ প্রতিটিতেই নির্মাণ বা মেরামতে যে ব্যয় দেখানো হচ্ছে তা আশপাশের দেশ তো বটেই এমনকি অনেক সময় ইউরোপিয়ান দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এটা যে দুর্নীতি, তা বুঝতে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হতে হয় না। উন্নয়ন হচ্ছে এটা যেমন সত্য, সেই উন্নয়নে যে অর্থের নয়ছয় হচ্ছে, সেটাকেও অস্বীকার করা যাবে না। একটা গণমুখী সরকারের দায়িত্বটা আসলে কী? কেবল কি উন্নয়ন করা? নাকি সম্ভাব্য কম ব্যয়ে প্রয়োজনীয় উন্নয়নটি করা?

সরকার কিন্তু দারুণ দারুণ সব প্রকল্প হাতে নেয়। যেমন এবার কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের সময় সরকার অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কয়েক দফায় অর্থ সাহায্য করেছে। সেখানেও কিন্তু দুর্নীতি হয়েছে। এই অর্থ বিলির দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে, তারা তালিকায় নিজেদের লোকদের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এমন দুর্নীতির সংখ্যাটা আসলে তত বেশি নয়। মানলামÑ বেশি নয়, কমই হয়েছে। কিন্তু কম সংখ্যক ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের কি শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে? শাস্তি দেওয়া হলেও সেসব ঘটনা কি প্রকাশ্যে আনা হয়েছে? আমি তো মনে করি যেকোনো অপরাধের শাস্তিই দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত। এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করা উচিত, যাতে এরপর কেউ আর একই অপরাধ করার আগে পরিণতির কথাটা একবার হলেও চিন্তা করবে।

বেশ কয়েক বছর আগের একটা কথা বলি। আমি তখন যে পত্রিকায় কাজ করতাম, তার সম্পাদক একবার আমাকে বলছিলেনÑ আসলে আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা কিন্তু দুর্নীতি নয়। দুর্নীতি পৃথিবীর সব দেশেই হয়। এমন কোনো দেশ দেখাতে পারবেÑ যেখানে দুর্নীতি নেই? তার মতে, আমাদের প্রধান সমস্যা হলো শিক্ষা। শিক্ষাকে যদি সর্বজনীন করা যায় জাতি যদি শিক্ষিত হয়ে ওঠে, দুর্নীতিও তখন অনেকটাই কমে যায়। তার এই যুক্তির সঙ্গে তখন আমি একমত হইনি। কিন্তু অবস্থানগত কারণে খুব বেশি তর্কও করতে পারিনি। ‘সহনীয় মাত্রার দুর্নীতি’Ñ এই কনসেপ্টটিও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ওই যে তিনি বলেছিলেনÑ পৃথিবীর সব দেশেই দুর্নীতি হয়, তার সঙ্গে একমত হয়েও আমি মনে করি, কোনো মাত্রার দুর্নীতিই গ্রহণযোগ্য নয়। সব দেশেই যেমন দুর্নীতি আছে, আবার তেমনি সেই দুর্নীতির জন্য দৃষ্টান্তমূলক সাজার ব্যবস্থাও আছে। সেই সাজাটিকে সচল করতে হবে। সাজা মানে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় বদলি নয়, কিংবা বড়জোর ওএসডি করা নয়। দুর্নীতির সাজা হতে হবে এমন কিছু, যা দেখে অন্য একজন দুর্নীতি করতে রীতিমতো ভয় পাবে।

তবে আমার সেই সম্পাদক মহোদয়ের আর একটি কথাকে আমি বেশ গুরুত্ব দিই। তিনি বলেছিলেন, বড় কোনো কাজ হতে থাকলে সেখানে দুর্নীতির কথা বলে চিৎকার-চেঁচামেচি কোনো কাজের কথা নয়। ধরা যাক ৫০০ কোটি টাকার ফ্লাইওভার সাড়ে ৫০০ কোটি টাকায় হলো। ৫০ কোটি টাকা চুরিই না হয় হয়েছে। হইচই না করে কাজটা বরং হতে দাও। কাজটা তো হলো, একটা ফ্লাইওভার তো পেলে। পারলে পরে ধরে বিচার কর, আগে কাজটা হতে দাও। কারণ, বিচার হোক বা না হোক, ফ্লাইওভারটা কিন্তু থেকে যাবে। ওটা তো আর কেউ মাথায় করে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই কাজটা হতে দেওয়া দরকার। তার এতটুকু মানলেও আমার কিছু বাড়তি অভিমত আছে। আর তা হলো, কাজ হয়ে যাওয়ার পর দুর্নীতি হয়েছে কি হয়নি, তার মূল্যায়ন করা। দুর্নীতি হয়ে থাকলে, বিচার করা।  

দেশে নানা ক্ষেত্রেই উন্নয়ন যেমন হচ্ছে, তেমনি দুর্নীতিও হচ্ছে। উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার অর্থ বরাদ্দ দিতে কার্পণ্য করছে না, উদার হাতে দিচ্ছে। এ অর্থ জনগণেরই অর্থ। এখন জনগণের সেই অর্থ যদি অপচয় হয়, তার দায় কিন্তু সরকারের ওপরেই গিয়ে বর্তাবে। এ ধরনের দুর্নীতি বা অপচয়ের খবর মাঝেমধ্যেই আমরা পত্রপত্রিকা বা বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখি। বিষয়টি সরকারপ্রধানকেও আহত করে, সেটা বোঝাও যায়। এই তো কিছুদিন আগে, রেলের দুটি প্রকল্পে ব্যয় কমানোর জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলেন। আমার প্রশ্ন হলোÑ বাড়তি ব্যয়ের এই বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের চোখে আগে কেন ধরা পড়লো না? এক প্রধানমন্ত্রী একা কত দিকে দেখবেন? 

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বয়স এখন ৭৫ হলো। ‘৭৫’ ওনার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্ক। এক পঁচাত্তর ওনার জীবন থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। আর এক পঁচাত্তরে এসে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ হয়েছেন, দৃঢ় হয়েছেন। জীবনের এই বাঁকে এসে তিনি নতুন আর কী কী সিদ্ধান্ত নেন, সেদিকেই আমরা তাকিয়ে থাকব। কারণÑ আমরা জানি, তাঁর একটি সিদ্ধান্তই হয়তো এই দেশ ও জাতির অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারে।

 লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক