উ ন্ন য় ন

ভুবনজোড়া শেখ হাসিনার আসনখানি

জাফর ওয়াজেদ
 | প্রকাশিত : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০৯:০৯

ভূগোলের গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি নিজেকে প্রসারিত করেছেন বিশ্ব ভাবনায়। দেশজ ভাবনার সীমারেখা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বভাবনাকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত জানাতেও পিছপা নন। বিশ্বজুড়ে দ্বন্দ্ব, হানাহানি, সংঘাত, সংঘর্ষ, অস্ত্র ও বারুদের ঝনাৎকারের বিপরীতে শান্তিবার্তা তিনি ছড়িয়ে দিতে চান। তাই দেখা যায়, স্বদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রটি সম্প্রসারণ করেছেন। তেমনি ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও থেকেছেন সচেষ্ট। বিভিন্ন সময়ে মতামত তুলে ধরে তিনি দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। এমনকি দেশে দেশে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলেরও তিনি ঘোর বিরোধী। বিশ্ব দরবারে এর বিরুদ্ধে নিজস্ব অবস্থানও তুলে ধরেছেন। এমনকি নিজ দেশের সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্তও করেছেন। দেখতে পাই, বিশ শতকের শেষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তাদের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সংহতির কথা তুলে ধরেছিলেন, যা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। বিশ্বের সামরিক জান্তা শাসকরা যেমন, পাকিস্তানে তখন ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তা শাসক পারভেজ মোশাররফ এ বক্তব্যকে ভালোভাবে নেননি। বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসবে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেননি। নিজ দেশের সামরিক জান্তাদের দুঃশাসনে জনজীবন কীভাবে পদপিষ্ট হয়েছে তা শেখ হাসিনার জানা। তাই নিজ দেশের সংবিধানেও সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বলবৎ করেছেন। মূলত শান্তির সম্প্রীতিকামী শেখ হাসিনা সব সময় হিংসাকে পরিহার করে এসেছেন। প্রতিশোধের মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে নিজেকে নির্মমতার প্রতীক করে তোলেননি কোনোভাবেই। হিংস্রতার বিপরীতে শান্তির বার্তাই তিনি প্রচার করে আসছেন। হিংসাকে জয় করতে সব সময় তিনি সচেষ্ট। মানুষকে ভালোবাসার মধ্যেই রয়েছে হিংসার মুক্তি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘বাংলা অভিধান ছাড়া আর কোনো ভাষার অভিধানে পরশ্রীকাতর শব্দটি নেই।’ আর শেখ হাসিনা চাইছেন বাংলা অভিধান থেকেও যেন মুছে যায় এই শব্দটি। কিন্তু যে সমাজ বিদ্যমান, সেখান থেকে এসব ঝেঁটিয়ে বিদায় করা সহজ নয় যদিও। রবীন্দ্রানুরাগী শেখ হাসিনা কবিগুরুর মতো বিশ্বাস করেন, ‘পৃথিবীজুড়ে একটি দেশ, পৃথিবীর সব মানুষ মিলে একটি জাতিÑএটি মেনে নিলে পৃথিবীর সব মানুষই এক দেশের, এক জাতির মানুষ হবে। দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে বৈরিতা থাকবে না।’ অবশ্য শেখ হাসিনা এটাও জানেন, এ কথা শুনতে যত সহজ, কাজে তত নয়। খুব উঁচুদরের শিক্ষা-সংস্কৃতি থাকলেই তবে লোকে এ কথার মর্ম বুঝবে।

দুই দশক আগে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ‘দেশিকোত্তম’ গ্রহণকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে দেশে কালে কালে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির ভাব গড়ে তোলার জন্য নিবেদিত হওয়ার কথা বলেছিলেন। রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে নিজেকে সমাসীন করার জন্য পর্ব সমাপন করে সম্মুখে শান্তি পারাবার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। গত দেড় দশক ধরে বিশ্বের গণমাধ্যমে তিনি একটি প্রশংসিত নাম। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর জোটেও তিনি সমাসীন হয়ে আসছেন। আর গণমাধ্যমজুড়ে তিনি একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নত হওয়ার পথপরিক্রমাকে সামনে তুলে ধরছেন।

শেখ হাসিনা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং তা বাস্তবায়নও করেন। তাই বিশ্ব গণমাধ্যম অনায়াসে তুলে আনে সেই দৃশ্যপটÑ বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে। শুধু দেখা নয়, সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পথ নির্দেশিকা এবং সঠিক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যাত্রাপথ মসৃণ না হলেও, স্বপ্নপূরণের পালায় চড়াই-উতরাই ভেঙে বেরিয়ে আসছে উন্নতির অগ্রযাত্রায়। বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার চৌহদ্দি স্বদেশ ছাড়িয়ে এখন বিশ্বসভায় পৌঁছে গেছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং আর্থ-সামাজিক সূচকে ‘উন্নয়ন বিশ্বময়’ হিসেবে সত্যিকারার্থেই উত্থান ঘটেছে দেশটির। তাই দেখা যায়, উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশ। আর দেশটির এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতিশীল নেতৃত্বের কারণে বিশ্ব নেতৃত্বের কাছেই শুধু নয়, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজস্ব ইমেজ সৃষ্টি করতে পেরেছেন। হতদরিদ্র অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে আজ বাংলাদেশ। বিশ্ব উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ তার অবস্থানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা অভাবনীয় মনে হয়েছে অনেক দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের কাছে। অবিশ্বাস্য, একটি পশ্চাৎপদ দেশকে উন্নয়নের কাতারে শামিল করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা যে অবস্থানে পৌঁছেছেন, বিশ্বের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রগুলো এক দশক ধরে তা অবলোকন করে আসছে। এমনকি নানা প্রতিবেদনও ছেপেছে।

দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের কাছে শেখ হাসিনা গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছেন তার ‘ক্যারিশম্যাটিক’ ভূমিকার কারণে। মিলেছে একের পর এক সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব, দায়িত্বশীল পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ডিগ্রি পুরস্কার সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্র পেয়েছে।

টাইম সাময়িকীর বিবেচনায় শেখ হাসিনা বিশ্বের প্রভাবশালী দশ নারী নেত্রীর একজন মনোনীত হয়েছিলেন। বিশ্ব সততার জরিপে তিনি ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শীর্ষের তিন নেতার একজন হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ‘পিপলস অ্যান্ড পলিটিকসের গবেষণা প্রতিবেদনে। যা গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে, সেখানেও দেখা গেছে বেতন ছাড়া শেখ হাসিনার সম্পদের স্থিতিতে কোনো সংযুক্তি নেই। গোপন সম্পদও নেই। দেশের ৭৮ ভাগ মানুষ মনে করেন তিনি সৎ এবং ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল লিখেছিল ২০১৭ সালে অং সান সু চি পশ্চিমা বিশ্বে অধিক পরিচিত একজন ব্যক্তি। তিনি শান্তিতে নোবেলও পেয়েছেন। কিন্তু আজ তিনি সারা বিশ্বে নিন্দিত এবং তারই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে প্রশংসিত।

রোহিঙ্গা ইস্যুর ধকল পোহাচ্ছে বাংলাদেশ। গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছিল, ২০১৭ সালের আগস্টে ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বিশাল মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিরল। তিনি যে একজন হৃদয়বান রাষ্ট্রনায়ক, তা তিনি আগেও প্রমাণ করেছেন, এবারও প্রমাণ করলেন।’ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-খাদ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বনন্দিত হয়েছেন। বিশ্বের সব গণমাধ্যম শেখ হাসিনার মানবিক ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতার জননী বা মাদার অব হিউম্যানিটি আখ্যায়িত করেছে কয়েকটি ব্রিটিশ গণমাধ্যম। ইন্ডিয়া টুডে-এর অনলাইন প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার হৃদয় বঙ্গোপসাগরের চাইতেও বিশাল। যেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ে কার্পণ্য নেই।’

আর্থসামাজিক উন্নয়ন, গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং বিশ্বশান্তি স্থাপনে অবদান রাখার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি তাঁকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে সম্মানিত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী বিজনেস সাময়িকী ফোবর্স অভিহিত করেছে ‘লেডিস অব ঢাকা।’ সংযুক্ত আরব আমিরাতের পত্রিকা খালিদ টাইমস উপাধি দিয়েছে ‘প্রাচ্যের নতুন তারকা।’ শ্রীলঙ্কার গার্ডিয়ান পত্রিকা উল্লেখ করেছে, ‘জোয়ান অব আর্ক।’ রাষ্ট্র পরিচালনায় বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়ে অনন্য ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা। বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বের দৃঢ়তা দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে নতুন যুগে পা রেখেছে। তার হাত ধরে কূটনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের মতো সব ক্ষেত্রেই সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধন তৈরি করেছেন বিশ্ববাসী। অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে নজরকাড়া সাফল্য হিসেবে দেখা দিয়েছে পদ্মা সেতু। অথচ এই সেতু নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকে সরগরম করে তুলেছিল বিশ্বব্যাংক। নানা অভিযোগে অর্থায়ন বন্ধ, মোড়লদের চোখ রাঙানি সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সক্ষমতাকে প্রমাণ করেছে। তাঁর পরিকল্পনাতেই বাংলাদেশ এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই ডিজিটাল। পাওয়া যাচ্ছে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ। প্রযুক্তিবান্ধব কৃষিনীতির কারণেই বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পর রপ্তানির সক্ষমতাও অর্জন করেছে। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে সরে গিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বকে বাংলাদেশ থেকে শিখতে বলেছিলেন। একুশ শতকে এসে শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও বিশ শতকে তাঁর যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। গত চল্লিশ বছরের বেশি তিনি রাজনীতিতে শুধু নন, আওয়ামী লীগের সভাপতিও। এমন বিরল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশ্বে বিরল। দেশি গণমাধ্যমের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গত এক দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকাকালে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করেছেন। দেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছেন। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়ার বিকাশ ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন।

কিন্তু যখন তিনি রাজনীতিতে অবতীর্ণ হলেন, তার পূর্বাপর সময়ে বিশ শতকের দুই দশকে গণমাধ্যমের সহায়তা তেমন মেলেনি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। নব্বই সাল পর্যন্ত টানা পনেরো বছর সামরিক জান্তা শাসকরা ক্ষমতা দখল করে দেশ থেকে গণতন্ত্রসহ স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নেয়। তাদের মূল লক্ষ্যই ছিল ইতিহাস বদলে দেওয়া। বঙ্গবন্ধুর নাম-গন্ধ সবকিছু থেকে মুছে ফেলা হয়। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর তিনি হয়ে ওঠেন কতিপয় সংবাদপত্রের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। একই সঙ্গে তাঁর জীবননাশও হয়ে ওঠে জান্তাদের লক্ষ্য। তাই তাঁকে বহুবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। জান্তা শাসকদের নিয়ন্ত্রিত ও সমর্থিত সংবাদপত্রগুলো এসবের বিরুদ্ধে প্রবল কোনো ভূমিকা নেয়নি। এমনকি অনুসন্ধান চালিয়ে কারা এর নেপথ্যে সেসব তথ্যও উদঘাটন করেনি। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করার জন্য নানামুখী অপপ্রচার চালানো হয়েছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন নিয়ে অজস্র মিথ্যাচারে পূর্ণ থাকত সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাগুলো।

১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেতা তখন থেকে গণমাধ্যম তার ‘প্যারালাল’ হিসেবে ক্ষমতা দখলকারী ও রাজাকার পুনর্বাসনকারী জান্তা শাসকের স্ত্রীকে দাঁড় করায়। সামরিক জান্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি তাদের শক্তিমত্তায় মাঠে নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার সব অর্জন পঁচাত্তরের পর ধূলিসাৎ হতে থাকে। আর গণমাধ্যম হয়ে ওঠে তাদের নোটিশ বোর্ড। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরেন তিনি। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই রাজনৈতিক নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছেন। একই সঙ্গে ছিল প্রাণনাশের হুমকি এবং বারবার তা প্রয়োগের অপচেষ্টা। বলা যায়, দফায় দফায় প্রাণনাশের চেষ্টার মধ্যে তার বেঁচে থাকাটাই মিরাক্কেল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার যে বীভৎস প্রচেষ্টা চালানো হয়, তা জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। রাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। ক্ষমতা দখলকারী সেনাশাসক জিয়া প্রায় ৬ বছর তাঁকে ভারত ও ইংল্যান্ডে নির্বাসিত জীবনযাপনে বাধ্য করেন। বাবা-মাসহ পরিবারের নিহত সদস্যদের কবর জিয়ারতের সুযোগটুকুও দেয়নি। শেখ হাসিনার প্রথম বন্দিজীবন ১৯৮৩ সালের ২৯ নভেম্বরে। তখন নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল সামরিক শাসন প্রত্যাহারসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করায়। এই সময়ে সংবাদপত্রগুলো স্বাধীন সত্তার প্রকাশ ঘটাতে পারেনি। আবার দেখা যায়, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি আইন জারির পর শেখ হাসিনাকে বন্দি রেখে আওয়ামী লীগ ভাঙার জন্য নানা চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কাছে হার মানতে হয়। সে সময় এক পত্রিকার সম্পাদক লিখেছিলেন, ‘দুই নেত্রীকে সরে যেতে হবে।’ শেখ হাসিনাকে সরিয়ে ফেলার জন্য অন্য নেত্রীর কথা বলা হয়েছিল।

সে সময় শেখ হাসিনার ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ সালে (যখন শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা), তখন থেকে গণমাধ্যমে তার ‘প্যারালাল’ হিসেবে ক্ষমতা দখলকারী ও রাজাকার পুনর্বাসনকারী জান্তা শাসকের স্ত্রীকে দাঁড় করায়। সামরিক জান্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি তাদের শক্তিমত্তায় মাঠে নামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার সব অর্জন পঁচাত্তরের পর ধূলিসাৎ হতে থাকে। আর গণমাধ্যম হয়ে উঠে তাদের নোটিশ বোর্ড।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হয় ইমেজ ক্ষুণ্ন করার জন্য শুধু নয়, দেশবাসী যাতে তাঁর ওপর বিরূপ ধারণা পোষণ করে, সেই উদ্দেশ্যই প্রতিফলিত হয়েছিল। দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করে তাদের দিয়ে জোরপূর্বক দলপ্রধানের বিরুদ্ধে বানোয়াট কথা বলানো হয় এবং তা ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। শেখ হাসিনাকে বিদেশে আসা-যাওয়ায় বাধা দেওয়ার সময় গণমাধ্যমগুলো বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল বলা যায়। যদিও জরুরি অবস্থার বিধিনিষেধ। ইংরেজি এক দৈনিকের সম্পাদক তো পরবর্তীকালে স্বীকার করে নিজ পত্রিকায় লিখেছেন যে, তার সাংবাদিকতা জীবনে তিনি একটা ভুল করেছেন এই যে, গোয়েন্দাদের পাঠানো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ছাপিয়েছিলেন। এই স্বীকারোক্তিতে স্পষ্ট হয়, সে সময় গোয়েন্দা সংস্থা কী ভূমিকা নিয়েছিল। গণমাধ্যম পরবর্তীকালে তা তুলেও ধরেছে।

জি-সেভেনের ২০১৬ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও ইতালি জি-সেভেনের সদস্য। এই সম্মেলনে শেখ হাসিনা ছিলেন মধ্যমণি। সদস্য দেশগুলোর সংবাদপত্র ও টিভিতে শেখ হাসিনার ভূমিকায় ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছিল। সম্মেলন উপলক্ষে জাপানের দ্য জাপান টাইমস পত্রিকায় শেখ হাসিনার একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। যাতে লিখেছিলেন, ‘বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নত দেশ থেকে অধিকতর সহায়তা উন্নয়নশীল দেশের অনুকূলে সংকলন, উন্নত দেশসমূহের বাজার অনুন্নতের জন্য অধিকতর মাত্রায় উন্মুক্তকরণ এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিজাতকরণে উন্নত দেশসমূহকে বিশ্বব্যাপী অধিকতর কার্যক্ষম পদক্ষেপ নেওয়া ও উন্নয়নশীল দেশ বিশ্ব উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে অধিকতর বিনিয়োগ করার বিষয়টি গুরুত্ববহ।’ এই সম্মেলনে শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃত্বের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উন্নয়নের তার নিজস্ব কৌশল ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ভাবনাগুলো তুলে ধরেন। উন্নত অবকাঠামো বিনির্মাণ, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ে তার বৈশ্বিক চিন্তা উপস্থাপন করেছিলেন। ‘কানেক্টিভিটিকে’ সামনে রেখে অবকাঠামোতে উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আর পরিবেশ ইস্যুতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল উল্লেখ করেছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম শেখ হাসিনার বক্তব্যকে গুরুত্বসহকারে প্রচার ও প্রকাশ করেছিল।

২০১৮ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-সেভেনের সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘একটি উন্নততর বিশ্ব আরও উন্নত একটি গ্রহ এবং শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বব্যবস্থার জন্য জাপানের জীবনকে রূপান্তর করতে আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আমরা এ অঞ্চলের ব্যক্তিদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাই।’ ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই বক্তব্য ঠাঁই পেয়েছিল।

বিশ্ব গণমাধ্যম শেখ হাসিনাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদন ছেপে আসছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে রাখাইন থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এই রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছে, যা সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সমস্যার এখনো কার্যকর সমাধান হয়নি। জাতিসংঘ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় হলেও তাদের দেশ হীন মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে শেখ হাসিনা চার দফা প্রস্তাবও রেখেছিলেন। ২০২০ সালে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকটকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকি উল্লেখ করে এর স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘এ সংকটের তিন বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও মিয়ানমার এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। এ সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধান তাদেরই করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, সুরক্ষিত ও সম্মানের সঙ্গে স্বেচ্ছায় রাখাইনে নিজ গৃহে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনা এতকাল যত ভাষণ, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তা ফলাও করে ছাপা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু চলমান থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে শেখ হাসিনা তা তুলেও ধরেছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান ও রাজনীতিকদের চোখে শেখ হাসিনা প্রতিভাত হয়েছেন এমনভাবে যে, স্পষ্ট হয় ভুবনজোড়া তাঁর আসনখানি। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর থেকে অদ্যাবধি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চোখে শেখ হাসিনা ‘ক্যারিশম্যাটিক’ নেতা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছেন। জাতিসংঘের বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা স্থাপনে শেখ হাসিনার ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এশিয়ার একটি মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ আর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তো বাংলাদেশকে ‘নাম্বার ওয়ান উন্নয়নশীল’ দেশ বলেছিলেন। কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী মেরি ক্লদ বিবেউ শেখ হাসিনাকে অভিহিত করেছিলেন ‘নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার স্তম্ভ’। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ঢাকা সফরকালে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছে।’ সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন কমনওয়েলথ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং স্থায়ী গুরুত্বের সামাজিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য তিনি বিশ্বের বুকে অনুকরণীয়।’ ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক ঢাকায় সফরকালে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা বৈশ্বিক নেতাদের জন্য প্রগতিশীলতায় আদর্শ এবং তার সরকারের শিশু অধিকার বিশেষত মেয়েশিশুদের অধিকার সংরক্ষণে প্রশংসিত।’ ইউনেসকোর সহপরিচালক ইরিনা বোকোভা উল্লেখ করেছেন, ‘শেখ হাসিনা একটি বৈশ্বিক সাহসের নাম, যে সাহস বিশ্বের নারী ক্ষমতায়নের জোরালো কণ্ঠস্বর।’ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জিম বলজার বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা তার সুদক্ষ নেতৃত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে এমডিজির লক্ষ্যগুলো অর্জনে বাংলাদেশকে সক্ষম করেছেন এবং অনুকরণীয় হিসেবে পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’

শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসার কারণে রানি এলিজাবেথের দ্বিতীয় কন্যা প্রিন্সেস অ্যান বলেছেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূল এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনা বিশ্বের বুকে প্রশংসিত।’ এটা তো স্পষ্ট যে, শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ দমন ও নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রেখে আসছেন। এক্ষেত্রে তাঁর জিরো টলারেন্সের বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের ‘হলি আর্টিজান’ বেকারিতে হামলার ঘটনার পর জঙ্গি দমনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশ। দশজন ব্রিটিশ এমপি সন্ত্রাসবাদ দমনে শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন, যা ব্রিটিশ গণমাধ্যম গুরুত্বসহকারে ছেপেছিল। ভারতের লোকসভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান শশী থাররু ভারতীয় লোকসভায় বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি অস্বীকার করেননি বরং তার সরকার তাদের গ্রেপ্তারও করেছে।’

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। বিদেশি গণমাধ্যমে যেমন তেমনি দেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বসহকারে। এর মধ্যে পরিবেশের নোবেল হিসেবে আখ্যায়িত জাতিসংঘের পরিবেশ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পেয়েছেন তিনি। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার। জাতিসংঘ তাকে ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার'ও প্রদান করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য।

বাস্তবতা যে, গণমানুষের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা অর্জন করেছেন অসংখ্য সম্মাননা ও স্বীকৃতি। জনগণের ক্ষমতায়নে আলোকিত প্রিয় স্বদেশ শেখ হাসিনার কর্মেই আজ সারা বিশ্বে সমুজ্জ্বল। বিদেশি মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রতিবেদন আর প্রকাশ করে না। তবে স্বাধীনতাবিরোধী ও একাত্তরের পরাজিত শক্তির ধারক-বাহকরা গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে হেয় করার জন্য মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। অসম্পাদিত এই সব মাধ্যম আর যা-ই হোক ধোপে টেকে না। বিশ্ব গণমাধ্যম তার সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে মাদার অব হিউম্যানিটি খেতাবে ভূষিত করেছে।

শুধু গণমাধ্যম নয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি এবং বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছে। গণমাধ্যমে তাই শেখ হাসিনার ছিল নানামুখী উপস্থিতি। জাতিসংঘের ভাষণই বাংলাদেশ সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে অনুকরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে এমডিজির ‘রোল মডেল।’ যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০১৮ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের একত্রিশতম দেশ হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব আজ জানতে চায় সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশে এমন কী ঘটেছে, যার ফলে এখানে দারিদ্র্যের হার নব্বইয়ের দশকের ৫৬ দশমিক ৭ থেকে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ১৩ শতাংশ নেমে এসেছে। যাতে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। গড় আয়ু বেড়েছে অনেক। শিশু মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে এ অভাবনীয় সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন করেছে। শিক্ষার হারও বেড়েছে। যে বিদেশি গণমাধ্যমগুলো এক সময় হতাশা ছড়াত, তারাই এখন প্রশংসাসূচক লেখা লেখে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, অর্থনীতির বিস্ময়, টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নানা প্রতিবেদন লিখেছে।

বিশ শতকে যারা শেখ হাসিনার অযথাই সমালোচনা করতেন রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্যে আদর্শগত কারণে, তাদের সেই লেখনী আর দেখা যায় না। মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ যখন নিজেদের উন্নত বিশ্বের স্তরে ভাবতে শুরু করেছে, তাতে বিশ্ববাসীও সে মর্যাদা দিতে এগিয়ে আসছে। ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ সিঙ্গাপুর বোটানিক গার্ডেনের ন্যাশনাল অফিস গার্ডেনে শেখ হাসিনার নামে একটি অর্কিডের নাম রাখা হয়। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবেই মূল্যায়ন করে আসছে গত এগারো বছর ধরেই। শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার ক্ষেত্রে দক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রথম আসেন ১৯৬৯ সালে ইডেন কলেজের নির্বাচিত ভিপি হিসেবে। বিজয়ের পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে তার ওপর সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। মহিলাদের পত্রিকা সাপ্তাহিক ললনা ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে তার সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। তখন নাম ছিল হাসিনা শেখ। সেখানে তিনি দুই পাকিস্তানের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বৈষম্য তা তুলে ধরেছিলেন। শেখ হাসিনা এরপর গণমাধ্যমে আসেন পঁচাত্তরে ১৫ আগস্টের পর। বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অবস্থান এবং আস্থা জানার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু ক্ষমতা দখলবাজি সামরিক জান্তারা দেশবাসীকে তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই প্রদান করেনি। গণমাধ্যমগুলে ও ছিল নিশ্চুপ, নির্বিকার।

১৯৭৫-এর ১৮ আগস্ট জার্মানির ডি ভেল্ট পত্রিকায় ক্লাউস কর্ন ও উলরিশলুকের যৌথ নামে তিনটি ছবিসহ চার কলামের একটি সংবাদ ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল ‘বনে শোকাগ্রস্ত শেখ মুজিবের কন্যারা।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন ছাপা হয় ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট। তখন তারা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন-এ অবস্থান করছিলেন। এর আগে তারা ব্রাসেলস থেকে এখানে আসেন। সেখানকার পত্রিকা ডি ডেজ তিনটি আলোকচিত্রসহ চার কলামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘বলে শোকাগ্রস্ত শেখ মুজিবের কন্যারা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ ‘বাংলাদেশের সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নিজের সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আরও নিহত হয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো শেখ মুজিবের দুই কন্যা কোথায় তা নিয়ে অনুসন্ধান করেছে।’ দুই সাংবাদিক ক্লাউস কর্ন ও উলরিশলুকের যৌথ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ‘আমরা ডিভেল্ট পত্রিকার পক্ষ থেকে দুই কন্যার সঙ্গে কথা বলেছি। গত শুক্রবার তাঁদের বাবা নিহত হওয়ার পর থেকেই তাঁরা উভয়ই বন-এ এ্যাম লেবিং সড়কের ছয় নম্বরে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কোয়েনিগসভিন্টারের বাসায় অবস্থান করছেন। সাদা রঙের ভিলাসদৃশ্য বাড়িটিতে রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী মাহজাবিন চৌধুরীও বাস করেন। বাড়িটির সামনে দিয়ে পিটার্সবার্গ কুর হোটেল যাওয়ার মূল রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে শত শত গাড়ি চলাচল করছে। কিন্তু এই গাড়ির আরোহীরা কেউ জানে না যে, সবুজ ঝাউঘেরা ভিলা বাড়িটাতে দুটি মেয়ে গত শুক্রবার তাঁদের বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শোকে মুহ্যমান হয়ে রয়েছে। বড় মেয়েটির নাম হাসিনা, বয়স ছাব্বিশ আর তাঁর চেয়ে দশ বছরের ছোট বোনটির নাম রেহানা।’ প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মীর কোলে শিশুকন্যা পুতুল, পাশে শিশু জয়। নিচে রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে দুই সাংবাদিক। (তথ্যদূত প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন, সরাফ আহমেদ)।

পঁচাত্তরের ২৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পৌঁছেছেন বন থেকে। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকাকালে শেখ হাসিনা আকাশবাণীর বাংলা সার্ভিসের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। সাংবাদিক বিবেক শুক্লা লিখেছিলেন যে, প্রণব মুখার্জি আকাশবাণীর বাংলা সার্ভিসের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে যুক্ত করে দেন। যাতে তিনি অপরিচিত দিল্লি মহানগরে সময় কাটাতে পারেন। শেখ হাসিনা সেখানে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্যাকেজগুলোতে অংশ নিতেন। তবে স্বনামে অংশ নেননি। দ্য পাইওনিয়ার পত্রিকায় এই সাংবাদিক শেখ হাসিনার প্রতি প্রণব মুখার্জির পরিবারের সম্পর্কের গভীরতাও উল্লেখ করেছেন। ‘এই মুহূর্তে ডটকম’-এর সন্দীপ সিনহাও উভয় পরিবারের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন। ধারণা করা যায়, আকাশবাণীতে কর্মরত থাকাবস্থায় শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ইয়র্স হলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সম্পর্কে আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি ছিলেন, যা ছিল লন্ডনে প্রথম রাজনৈতিক সভা। লন্ডনের স্থানীয় বাংলা কাগজগুলোতে তা ছাপা হয়েছিল। ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হন। কাউন্সিলের আগে দেশের সংবাদপত্রে শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। তারও আগে সামরিক জান্তা শাসকদের নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা দিল্লি প্রবাসী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছিল, তাতে শেখ হাসিনা যা বলেননি তা-ও সন্নিবেশিত ছিল। শেখ হাসিনাকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনাধর্মী অনেক প্রতিবেদনই ছাপা হয়েছিল সে সময়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকায় আসেন সামরিক শাসকদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। ক্ষমতা দখলকারী জান্তারা তাঁকে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করেছিল পরিবারের সদস্যসহ। পিতা-মাতা-স্বজনদের কবর জিয়ারত ও ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের জন্য দেশে আসার সুযোগ দেয়নি। এতই নির্মম, নিষ্ঠুর ছিল। শেখ হাসিনা যেদিন দেশে ফেরেন এর পরদিন সংবাদপত্রগুলোতে কোথাও প্রথম শিরোনাম কোথাও দ্বিতীয় শিরোনাম হয়েছিল। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ক্রন্দন-মথিত তাঁর ভাষণ সংবাদপত্রে পাঠ করে পাঠক আপ্লুত হয়েছিল পিতৃমাতৃহীন স্বজন হারা শেখ হাসিনার জন্য। সেদিন রাজপথে মানুষের ঢল নেমেছিল। শাসকরা গতিরোধ করতে পারেনি। রাস্তার দু’পাশে ছিল মানুষের ঢল। মিছিলে স্লোগান। ট্রাক, গাড়ি, বাস, মোটরসাইকেলে সারিবদ্ধ শোভাযাত্রা। দেশে ফিরেও তিনি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতে পারেননি। মা-বাবা-ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যদের স্মৃতি স্পর্শ করতে পারেননি, দোয়াও নয়। শেখ হাসিনা রাস্তার ওপর বসেই দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া পড়েন। ১৯৮১ সালের ১২ জুন বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। সে সময় অনেক পত্রিকার প্রতিবেদন ছিল মর্মস্পর্শী। জিয়া হত্যার পর বিচারপতি সাত্তার সরকারের সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তিরাশি সালে শেখ হাসিনাকে আটক করা হয়। সামরিক যোদ্ধার সেন্সরশিপ থাকলেও সাহসী সংবাদপত্রগুলো প্রতিবাদ মিছিল ও সমবেদনার ছবিও ছেপেছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের একটি অংশ শেখ হাসিনার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনার প্যারালাল এক জেনারেলের স্ত্রীকে নিয়ে আসার জন্য প্রগতিশীল বলে পরিচিত সংবাদপত্রগুলোও ভূমিকা পালন করেছিল। মিডিয়া ক্যু মার্শাল ক্যুর মাধ্যমে নির্বাচনী আসন ছিনিয়ে নিয়েছিল শাসকরা। শেখ হাসিনার ভূমিকা গুরুত্ব পেয়েছিল সংবাদপত্রে।

প্রায় চার দশকের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনাকে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বলিষ্ঠ ভূমিকায় তিনি সপ্রতিভূ এখনো। বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে দৃঢ়তার সঙ্গে তার লক্ষ্যকে তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ দেখা যায়, কোভিড-১৯-এর প্রকোপ বিশ্বজুড়ে যখন তীব্র বাংলাদেশও তার থেকে মুক্ত ছিল না। জাতিসংঘের ভার্চুয়াল অধিবেশনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এ মহামারির কারণে আজ সারা বিশ্বের মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির সম্মুখীন। কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে আমাদের সবার ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যেমন জাতিসংঘ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ওপর গুরুত্ব আরোপের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, তেমনি এই মহামারিও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।’ প্রধানমন্ত্রী করোনার টিকা ভ্যাকসিন যাতে সব দেশ পায়, সে জন্য ঔষধ প্রস্তুতকারী দেশগুলোর প্রতিও আহ্বান জানিয়েছিলেন। করোনাকালে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা শুধু নয়, বিনা মূল্যে করোনার দুই ডোজ টিকাদানেরও ব্যবস্থা করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলো এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিচের দিকে। শেখ হাসিনা করোনাকালে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ইতিবাচকভাবেই এসেছে।

লেখক: মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :