সাম্প্রদায়িকতার আস্ফালন বন্ধে চাই সংস্কৃতির জাগরণ

আপেল মাহমুদ
| আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০৮:২৪ | প্রকাশিত : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০৮:২৩

"আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম,

আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান,

মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম।"

- শাহ আবদুল করিম

শাহ আবদুল করিমের জন্মস্থান সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লা অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যগত অনুভূতিই হয়তো তাঁকে উৎসাহিত করেছিলো এরকম একটা গান লিখতে। কিন্তু সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অনেকাংশেই আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে। সারা বাংলাদেশের অন্তরীণ চিত্রের এক সাম্প্রতিক প্রতিচ্ছবি কুমিল্লা। সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর পুড়েছে, পুড়েছে গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর। কক্সবাজারের রামু থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা জেলায় এই দৃশ্য এখন চিরাচরিত। ধর্ম প্রচারের নামে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে। যেই বীজ ক্রমশ বেড়েই হুমকি হয়ে যাচ্ছে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর জন্য। এই বিধ্বংসী পথ থেকে উত্তরণের জন্য চাই সংস্কৃতির জাগরণ। নতুবা ভয়াল সাম্প্রদায়িকতার আঁচড় থেকে আমরা কেউ বাঁচতে পারবো না।

বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় তাঁর লোকজ সংস্কৃতির দর্শন। বাংলাদেশের সাহিত্য, জীবনবোধ, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনাচরণ লোকসংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে৷

সাধারণ মানুষের ভাষা, জীবনবোধ, বিনোদন, সাহিত্য, পেশা – এ সব নিয়েই গড়ে ওঠে ‘লোকসংস্কৃতি'৷ এই সংস্কৃতির মধ্যে থাকে সহজিয়া সুর৷ কোনো কৃত্রিমতা থাকে না লোকসংস্কৃতিতে৷ এটা সহজাত, সহজিয়া আর স্বাভাবিক বহতা নদীর মতো৷ পোশাকি সংস্কৃতির বিপরীতে এক শক্তিশালী সোঁদা মাটির গন্ধ ভরা স্বকীয় সংস্কৃতি৷ এর কোনো বিনাশ নাই৷ আছে আধুনিক সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার উদারতার ইতিহাস৷ তাছাড়া এই সংস্কৃতির ভাষাও লোকজ৷ যাকে বলা হয় লোকভাষা৷ সাধারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মুখে, কথায়, ভাষার ব্যবহারে, লেখায় এর প্রকাশ৷

গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্য, জীবনবোধের প্রকাশ৷ তাঁদের পোশাক, খাবার, প্রার্থনা, পূজা-পার্বণ, ফসল, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বাসস্থান, বাহন, জীবন সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব, বিরহ – এ সবই লোকসংস্কৃতিকে রূপ দেয়৷ লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে তার সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে৷ লোকগানে, কবিতায়, সাহিত্যে, উৎসবে, খেলাধুলাতেও প্রকাশ পায় লোকসংস্কৃতি৷

খুবই নিকট অতীতে বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রাম বাংলা ছিলো উৎসবমুখর। নবান্নের ধান তুলা, হালখাতা কে কেন্দ্র করে মিষ্টিমুখ। পিঠা পুলি গ্রাম বাংলার আবহ কাল থেকেই এক উৎসবের নাম।

ময়মনসিংহ-সিলেট অঞ্চলের ভাটিয়ালি, পালাগান, জারি-সারি, রাজশাহী-চাপাইনবয়াবগঞ্জের গম্ভীরা, রংপুরের ভাওয়াইয়া-চটকা সহ সারা বাংলা জুড়ে ছিলো সংস্কৃতির এক মহোৎসব।

দেশব্যাপী যাত্রাপালা, কবিগানের আসর, পুঁথি পাঠ, বাউলগানের আসর সহ সারাবছর ধরে উৎসবমুখর থাকতো গ্রামবাংলার প্রতিটা ঘর।

মৈমনসিংহ-গীতিকায় স্পষ্টত আছে সংস্কৃতি পাগল এক জাতির উৎসাহ উদ্দীপনার ইতিহাস।

কিন্তু আজকের বাংলাদেশ ভিন্ন পথে হাঁটছে। প্রতিটা উপজেলায় আধুনিক স্থাপত্যশৈলী মসজিদ- মন্দির হচ্ছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যগত বাংলাদেশ যেনো ক্রমশ আরো পিছিয়ে যাচ্ছে। মডেল মসজিদ- মন্দিরের মধ্যকার আন্তসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য হলেও সংস্কৃতির জাগরণ আবশ্যক। নতুবা এগুলো কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, হৃদয়ে ধর্মের শীতল স্পর্শ ছুঁতে পারবে না।

সংস্কৃতি চর্চার বিকাশকেন্দ্র আগের মতো শুদ্ধতা ছড়াচ্ছে না গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে। আধুনিকায়নের যুগে সমৃদ্ধ কাঠামোকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। পাশাপাশি অবশ্যই সংস্কৃতির সকল দোয়ারকেও প্রস্ফুটিত হতে দিতে হবে। নতুবা ধর্মগত বিদ্বেষ এমন এক জায়গায় পৌঁছাবে, যা সমগ্র সমাজ ব্যাবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে। হয়তোবা সামগ্রিক লোকজ ঐতিহ্যকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারবো না, সংস্কৃতির শ্রোতধারার নিয়ম অনুযায়ীই নতুন কিছুর সাথে আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে। তবে অবশ্যই আমাদের সামগ্রিক দায় আছে সংস্কৃতিমনা একটা সমাজ কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য।

লেখক: এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :