সরেজমিন কামরাঙ্গীর চর (পর্ব-২)

৩৬০ কারখানায় আবাসিক সংযোগ, মাসে লোপাট কোটি টাকা

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১০:৪৪ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১১:৩৯

কাজী রফিক, ঢাকাটাইমস

কামরাঙ্গীর চরের বাসিন্দাদের বেশিরভাগেরই রাতের বেলা গ্যাস না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবাসিক সংযোগ নিয়ে অবৈধভাবে সাড়ে তিনশর বেশি কারখানা চালানোর কারণেই লাইনের গ্যাস পান না ঢাকার এই শহরতলীর বাসিন্দারা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাতে গ্যাস সংকটের পাশাপাশি এখানকার বাসাবাড়িতে দিনের বেলাও গ্যাসের চাপ থাকে কম। এই গ্যাস সংকট তৈরি করছে রান্না ঘরের জন্য র্যা ক তৈরির কারখানা। এখানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৬০টি কারখানা। দিনের বেলা রযাা ক তৈরি করে রাতের বেলা গ্যাসের ব্যবহার করে সেগুলি রঙ করা হয়।

হিসাব করে দেখা গেছে, এসব অবৈধ লাইনে মাসে কোটি টাকার বেশি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে। তিতাস বলছে, কামরাঙ্গীর চরে তাদের বৈধ বাণিজ্যিক সংযোগ ৩৫টি। তাদের দেওয়া হিসাবে এখানে বাকি সব কারখানার সংযোগই অবৈধ। আবাসিক সংযোগ দেখিয়ে পরে সেগুলিই কারাখানায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

গ্যাসের অবৈধ এই বাণিজ্য তিতাস কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অবগত। স্থানীয় কাউন্সিলরদের ভাষ্য, তিতাসই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, আবার তাদের লোকজনই সংযোগ দেয়। যদিও অভিযোগ মানতে নারাজ সংশ্লিষ্ট তিতাস কর্মকর্তারা।

দুই দশমিক ৭৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কামরাঙ্গীর চর তিন ওয়ার্ডে বিভক্ত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে এই চরে। এর মধ্যে ৫৫ ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডেই রয়েছে প্রায় সব র্যা ক তৈরির কারখানা।

২০০১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী, কামরাঙ্গীর চরের বাসিন্দা এক লাখ ৪৩ হাজার ২০৮ জন। তবে চরে কাজ করেন আশপাশের আরও কয়েক এলাকার মানুষ।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, কামরাঙ্গীর চরে এখন অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ নিয়মিত বাসিন্দার বাস। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্যও আপদ হয়ে উঠেছে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কারখানাগুলো।

হাজীর ঘাট, মাহাদী নগর, জাউলাহাটি, উত্তর নয়াগাও, দক্ষিন নয়াগাও, নদীরপার মোহাম্মদনগর, নবীনগর, আলীনগর, হযরত নগর, ঝাউচর, সাইনবোর্ড, নার্সারি গলি, সাততলা টাওয়ার গলি, বাদশা মিয়া স্কুলের আশপাশ, তুলাতলা কবরস্তান এলাকায় রয়েছে এসব কারখানা।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, র্যা ক কারখানাগুলো দিনের বেলা রান্না ঘর থালা-বাসন রাখার তাক তৈরি করে। তবে সেগুলো রঙ করা হয় রাতে। তৈরি মালামাল রঙ করার আগে তা আগুনে পুড়িয়ে লাল করে নেওয়া হয়। এরপর তা ঠান্ডা হলে রঙ করা হয়।

এসব কারখানার রঙ করার জায়গাগুলো আলাদা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারখানার পেছনের অংশে বা অন্যত্র রঙ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেখানে রয়েছে তিতাসের গ্যাস সংযোগ।

তিতাসের ধানমন্ডি অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, কামরাঙ্গীর চরে তাদের বাণিজ্যিক সংযোগ মাত্র ৩৫টি। অর্থাৎ র্যা ক কারখানাগুলোর এই সংযোগগুলো আবাসিক। কারখানায় কর্মরত শ্রমিক-মালিকরাও সেটি মানছেন। আবাসিক সংযোগগুলোকেই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছেন তারা।

ব্যবসায়ী পরিচয়ে চরের সাততলা টাওয়ার গলি এলাকার এক কারখানায় গেলে সেখানে কর্মরত একজনের কাছে র্যা কে রঙ করার কৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রঙ করার আগে তো মাল পুড়াইতে হয়। না পুড়লে রঙ ভাল হয় না। পুড়া মালে রঙ করলে ওই রঙ বেশি দিন টিকে।’

রঙ কোথায় করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রঙ করার জায়গা আলাদা। আর রঙ হয় রাতে।’ ওই মিস্ত্রী বলেন, ‘আমরা লাইনের গ্যাস দিয়াই কাজ করি।’

আরও কয়েকটি কারখানা ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। অপর এক কারখানার মিস্ত্রী বলেন, ‘বাসা-বাড়ির লাইন দিয়েই কাজ করি। সবাইরে ম্যানেজ করা আছে। সমস্যা হয় না।’

কাদের মাধ্যমে তিতাসের আবাসিক সংযোগ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি এসব কারখানার শ্রমিকরা। তবে ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে চরের বাসিন্দা এই কাজে সক্রিয় বলে উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে শরিফ, মহিউদ্দিন, শহিদুলাহ ও সজিব গ্যাস বানিজ্য করছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

তিতাস মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও তারা পুনরায় এই সংযোগ নিয়ে দিচ্ছেন। বিনিময়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়ে প্রতি কারখানা থেকে। এই টাকার ভাগ পান রাজনৈতিক পরিচয়ধারী স্থানীয় নেতা ও তিতাসের কিছু কর্মকর্তাও।

কারখানা শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য মতে, একটি কারখানায় মাসে ৪০ জন আবাসিক গ্রাহকের প্রয়োজনের সমান গ্যাস খরচ হয়। একজন আবাসিক গ্রাহককে ডাবল চুলার জন্য তিতাসকে মাসে বিল পরিশোধ করতে হয় ৯৭৫ টাকা। সে হিসেবে এক মাসে একটি কারখানায় গ্যাস খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৯ হাজার টাকার।

আর চরের ৩৬০টি কারখানায় মাসে এক কোটি ৪০ লাখ টাকার গ্যাস জ্বলছে। এর বিপরীতে তিতাস বিল পাচ্ছে আবাসিক সংযোগের। অর্থাৎ তিন লাখ ৫১ হাজার টাকা। সে হিসেবে মাসে প্রায় এক কোটি ৩৬ লাখ টাকার গ্যাস লোপাট হচ্ছে কামরাঙ্গীর চর থেকে। যা বছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
এসব বিষয়ে অবগত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘এগুলো অনেকবার লেখালেখি হইছে, বন্ধ হয় না। আপনার কাছে কোনো ম্যাজিক বিষয় থাকলে বলেন, আমরা সেভাবে আগাই। অফিসাররা আইসা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। আবার এক শ্রেণীর অসাধু লোক আছে, যারা রাতের আঁধারে এই সংযোগগুলো আবার দেয়।’

৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে ঠিকভাবে গ্যাস থাকে না এমন অভিযোগে তিতাসের কাছে চিঠি দিয়েছেন বলে জানান ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূরে আলম। ঢাকা টাইমসকে কাউন্সিলর নূরে আলম বলেন, ‘তিতাস থেকে কাটে। কিছুদিন পর ওরাই সংযোগ দেন... ওগো সাথেই যোগাযোগ কইরাই... সব অফিসার তো এক রকম না, সব স্টাফও এক রকম না। ওরা ওরা যোগাযোগ কইরাই মনে হয় আবার লাগায়।’

কামরাঙ্গীর চরে গ্যাস চুরির বিষয়ে তিতাসের ধানমন্ডি শাখার ডিজিএম নজিবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তারা নিয়মিত অভিযান করছেন। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও পরবর্তীতে আবারও অবৈধভাবে সংযোগ নিচ্ছেন অসাধু একটি শ্রেণী।
গ্যাস মিস্ত্রী ছাড়া সাধারণ মিস্ত্রীদের পক্ষে তিতাসের সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ তিতাসের কোনো ঠিকাদার বা মিস্ত্রী এ অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে নজিবুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিস্ত্রী বা ঠিকাদাররা তো তিতাসের কর্মী না।’

এ ধরণের ঘটনায় তিতাসের ঠিকাদাররা জড়িত কিনা এবং ঠিকাদাররা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কাজের ব্যস্ততা দেখান এবং ফোনকলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।

(ঢাকাটাইমস/১৮অক্টোবর/কারই/ডিএম)