‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না'

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৪৫ | আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১৮:০৭

রফিকুল ইসলাম রনি

‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না' বলে একটা কথা আছে। কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশকিছু স্থানে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে চলেছে। অতি স্পর্শ কাতর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করাও কঠিন। সাদা চোখে একথা বলতেই পারি, যা ঘটছে তা সন্ত্রাস। আর এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের কোনো ধর্ম নেই, তাদের কোনো রাষ্ট্র নেই। সন্ত্রাসীকে সন্ত্রাসী হিসেবেই দেখতে হবে। যারাই ধর্ম অবমাননা করেছে (সে যে ধর্মেরই হোক) সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী সবোর্চ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আর এ তদন্তের জন্যও সময় দেওয়া দরকার। হুট করেই কাউকে দোষী বলা যায় না বা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো যায় না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি। এ দেশে সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবেন-এটা সংবিধানেই বলা আছে। আবার সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবেন সেটাও উল্লেখ আছে সংবিধানে। জাতির পিতাই এটা করে গেছেন। 

ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম, যা আমাদের সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। স্বয়ং আল্লাহ স্পষ্টতই বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবদেবীর পূজা-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা শিরক থেকে আরো অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে। ’ 

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুন্ন করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি মুহাম্মদ ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব। ’ সুনানে আবু দাউদ : ৩০৫২।  তিনি (সা.) আরও বলেছেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেই ওই ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। ’ সহিহ বোখারি : ৩১৬৬।

তাহলে প্রশ্ন কেন সহিংস হয়ে উঠছি? আমরা কি রাষ্ট্রকে মানি না? আল্লাহ ও নবী রাসুলের পথে চলছি না? কুমিল্লার ঘটনার পর ব্যাপকভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। দোষী যেই হোক, উপযুক্ত শাস্তি পাবে-এটা আমি বিশ্বাস করি। কারণ এত বড় ঘটনা ঘটিয়ে এই সরকারের আমলে কেউ নিরাপদে থাকবে আমি বিশ্বাস করি না। বিষয়টি অতি স্পর্শ কাতর। সেজন্য সরকারকেও সময় দিতে হবে। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু তা না করেই আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে অপরের ধর্মের আঘাত করছি, আঘাত হানছি। আর এটাকে পুজি করে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি নারকীয় তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছেন। এটা মানবতার শত্রু, জাতির শত্রু, দেশের শত্রু। এরা সন্ত্রাসী, এদের কোনো ধর্ম নেই, এদের কোনো দেশ নেই।

এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও একে অপরে দোষারোপ করছেন। এখন সন্ত্রাসী গোষ্ঠির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময়। এসি রুমে বসে দোষারোপের রাজনীতি না করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময়। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এটা অনেকেই ভালোভাবে দেখছে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজকে উন্নয়নের মহাসড়কে। বিশ্বের বিস্ময়। এটা কারও কারও ভালো লাগতে নাও পারে। সেজন্য ‘তৃতীয় পক্ষ’ নতুন খেলায় মেতে উঠেছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। সব পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, সবার আগে দেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জাতির পিতা দিয়েছেন বলেই আমি-আপনি বাঙালি। দেশটাকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও সকলের। এক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দোষারোপ করলেও চলবে না।

দেশের নাগরিক কত কোটি? আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কতজন? একটি থানায় কতটি গ্রাম? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে কতজন? একে অপরকে যদি নিরাপদ রাখতে না পারি, নিজেরা যদি সহনশীল না হই তাহলে কিন্তু দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ বাড়বেই। কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছে, যা মোটেও কাম্য নয়। এখন রাজনৈতিক দোষারোপ বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজ হিন্দুদের মন্দির, ঘর-বাড়ি জ্বলছে। কাল যে আপনাদের রাজনৈতিক অফিস, সরকারি দপ্তর কিংবা আমার-আপনার বাড়িতে আগুন জ্বলবে না, এটার কি নিশ্চয়তা আছে? প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। দোষারোপের রাজনীতি না করে সবাইকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

একটি কথা বলা দরকার, আজকে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। ফোনে ফোনে ইন্টারনেট। আওয়ামী লীগ সরকারই এই সুযোগ করে দিয়েছে। এখন মানুষ সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয়। এর মধ্যে অধিকাংশই সময়ই ‘অকাজে’ ব্যয় করেন তারা। আর একটি চক্র গড়ে উঠেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ‘অপকর্মের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট্র, একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো, মিথ্যাচার করছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের একটি ‘কর্তৃপক্ষ’ আছে। এই ‘কর্তৃপক্ষে’র কম্ভু ঘুম এখনো ভাংছে না। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে, সরকারের শুভাকাঙ্খি ব্যক্তি, সমাজের বিশিষ্টজন, এমনকি গণমাধ্যমের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে কর্মীদের বিরুদ্ধেও ঢালাও ভাবে মিথ্যাচার করে চলেছে। হয়ত সোস্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রকারী ‘কর্তৃপক্ষ’র কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খুব মজা করে দেখেন বা দেখে আসছেন। তাই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে বিদেশে বসে ‘অনলাইন প্রস্টিটিউট’রা সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে চলেছেন। এগুলো বন্ধের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

এর ধারাবাহিকতায় এখন চলছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতন, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, জানমালের নিরাপত্তা বিনষ্টকরণ এবং সামাজিক দুর্বৃত্তায়ন, মানবিক বিপর্যয় ও অনিষ্ট সাধনকে সমাজে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করা দরকার। এ জন্য দেশের জনগণকে হতে হবে মানবাধিকার সচেতন। যেন মানুষ আর মনুষ্যত্ব না হারায়; বরং সবাই মনুষ্যত্ব অর্জনে হয়ে ওঠে তৎপর ও সচেষ্ট এবং হৃদয়ে গর্জে তোলে মানবতার হাতিয়ার। আবালবৃদ্ধবনিতা, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজন সবাই সমবেত কণ্ঠে ঘোষণা করুক, ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের কোনো ক্ষতিসাধন করবে না; বরং পারলে অন্যের উপকার করবে!’

কেননা অহেতুক অমুসলিমদের ওপর জোর-জবরদস্তি বা জুলুম-নির্যাতন করা মহাপাপ। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করে, তবে আমি কিয়ামতের দিন সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী হব।’ (আবু দাউদ)

লেখক: গণমাধ্যম কর্মী