দেশটাতে মানুষ নেই আর, সবাই হিন্দু-মুসলমান!

বাপ্পী রহমান
 | প্রকাশিত : ২০ অক্টোবর ২০২১, ১৮:৩৪

আবারো সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ক্ষত-বিক্ষত প্রিয় স্বদেশ। ইসলাম অবমাননার অপ্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে সারাদেশে দুর্গাপূজার প্রতিমা ও মণ্ডপ ভেঙে ক্ষান্ত হয়নি হায়েনার দল। রংপুরের পীরগঞ্জ রামনাথপুর ইউনিয়নের তিন গ্রামে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ২৫টি ঘরবাড়ি। বসতবাড়ির স্বর্ণালঙ্কারসহ লুট করা হয়েছে। পীরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও এক রাতেই নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারগুলো। এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন তাদের।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নতুন কোনো ঘটনা নয়। ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু বিচার হয় না৷ ফলত থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের গবেষক মোহাম্মদ রফি তাঁর গবেষণায় জানান দিয়েছেন, অত্যাচারের কারণে অনেক সময় হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। তবে, নির্যাতনের জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়ার যে ধারা, তা বন্ধে কোনো সরকারই কার্যকর উদ্যোগ নেয় না।

রফি তার গবেষণাগ্রন্থ Can We Get Along? An Account Of Communal Relationship In Bangladesh-এ দেখিয়েছেন, ২০০১ সালে নির্বাচনের মাস অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২০টি উপজেলায় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে, হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবাদ না জানিয়ে দেশ ছাড়ে বলে সম্পত্তি দখলের জন্য তাদের ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা হয়। অথচ সরকারগুলো সংখ্যালঘুদের দেশ ছেড়ে যাওয়া বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয় না।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত তার গবেষণায় দেখিয়েছেন স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে ৪৫ শতাংশ ভূমির মালিক ছিল হিন্দুরা। অর্পিত সম্পত্তি আইনের সুযোগ নিয়ে অনেকে এই জমিগুলো গ্রাস করেছে। ফলে দেশ ছাড়তে হয়েছে অনেক হিন্দু পরিবারকে।

সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হেলা করা মোটেও যৌক্তিক নয়। এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে। তাই সরকারকে কেবল ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রতিশ্রুতি’ না দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে একথাও সত্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধের ব্যর্থতা কেবল সরকারের নয়। নাগরিক সমাজেরও কিছু দায় রয়ে গেছে। মনে রাখা জরুরি, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধ শতক পরেও প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক চেতনা নির্মাণে আমরা সক্ষম হয়নি।

‘ধম্মং শরণং গচ্ছামি’। ধর্মের নামে অশান্তি ডেকে আনার এই ঘনঘোর সংকটে এবং ধর্মকে খুব সহজেই রাজনীতির বর্শায় বিদ্ধ এক শিকার হতে দেখেও শেষতক আমি ধর্মেরই শরণ নিলাম!

‘হে ঈমানদারগণ! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবদেবীর-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা শিরক থেকে আরো অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে’ (সূরা আনআ’ম, ৬:১০৮) ।

একইভাবে বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ মহানবী (সা.)- বলেন, ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় সংখ্যালঘু অমুসলিমরা হলো পবিত্র আমানত। কোনো মুসলিম যদি সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায় তা হলে কেয়ামত দিবসে আমি সেই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে মামলা দায়ের করব’।

ইসলাম মানে শান্তির জন্য আত্মসমর্পণ। হাদিস শরিফে আছে, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে বা কষ্ট না পায়। ইসলামী ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনকে অপরিহার্য করে দিয়েছে।

পক্ষান্তরে যেসব বিষয় মানুষের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য, হিংসা- বিদ্বেষ, হানাহানি, খুন খারাপি, নিপীড়ন এবং স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরায়, ইসলাম এ সকল বিষয়কে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। একই সাথে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য ইসলাম বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে।

পণ্ডিত সলিমুল্লাহ খান তার বয়ানে বলছেন ‘এই দুনিয়ায় ধর্মের সহিত ধর্মের কোন বিরোধ নাই। বিরোধ যদি থাকে তো তাহা কেবল লোকের সহিত লোকের। এই বিরোধ স্বার্থের সহিত স্বার্থের-পরমার্থের সহিত পরমার্থের মোটেও নহে।’

‘সর্বে সুখিনা ভবন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়া’। আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া মন্দির কিংবা বিশ্বাস, কোনোটাই আর ফিরে আসবে না জানি। তারপরও প্রার্থনা করলাম, জগতের সকল প্রাণী অন্তত একবারের জন্য সুখি হোক!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :