ফের রক্তাক্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, নেপথ্যে কারা?

প্রকাশ | ২২ অক্টোবর ২০২১, ২২:২৬ | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২১, ২২:২৮

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
ফাইল ছবি

আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার রক্তাক্ত হলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। শুক্রবার ভোরে উখিয়ার ১৮ নম্বর ক্যাম্পে গুলিতে মারা গেছেন সাতজন। এই ঘটনার পেছনে কারা সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধারণা করছে, একটি চক্র রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখতেই এই হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, যারা চায় না রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাক তারাই এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা জিইয়ে রাখছে।

শুক্রবার ভোররাত ৪টার পর উখিয়ার এফডিএমএন ক্যাম্প-১৮ এইচ-৫২ ব্লকের ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় এই গুলির ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে চারজন ঘটনাস্থলে আর বাকি তিনজন হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান বলে নিশ্চিত করেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহমেদ সনজুর মোরশেদ।

নিহতরা হলেন দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসার শিক্ষক ক্যাম্প-১২-এর ব্লক-জে-৫-এর বাসিন্দা হাফেজ মো. ইদ্রিস (৩২), ক্যাম্প-৯-এর ব্লক-২৯-এর মৃত মুফতি হাবিবুল্লাহর ছেলে ইব্রাহীম হোসেন (২৪), ক্যাম্প-১৮-এর ব্লক-এইস-৫২-এর ভলান্টিয়ার শিক্ষার্থী আজিজুল হক (২২), মো. আমীন (৩২), ক্যাম্প-১৮-এর ব্লক-এফ-২২-এর মাদ্রাসার শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫), ক্যাম্প-২৪-এর মাদ্রাসার শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫), নুর মোহাম্মদের ছেলে নুর কায়সার (১৫)।

এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লাম্বাশিয়া শিবিরের ডি ব্লকের ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন মুহিবুল্লাহ (৪৮)। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। হামলার জন্য মিয়ানমারের সশস্ত্র গ্রুপ ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি’ আরসা (আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত) দায়ী করা হয়েছিল। এ সময় আরসার কয়েকজন অস্ত্রধারীর নাম প্রচার করা হয়। এ ঘটনায় পরদিন মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে।

এবারের এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত সে ব্যাপারে এখনো পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তবে একটি সূত্র জানায়, মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের তোপের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ে কথিত ‘আরসা’র পরিচিত সদস্যরা। তারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে টেকনাফের হ্নীলার নয়াপাড়া মুছনি ক্যাম্পের পাহাড়ি এলাকায় স্থানীয় কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের আশ্রয়ে রয়েছে। ফয়েজউল্লা নামে এক ‘আরসা’র সদস্যকে সম্প্রতি বালুখালী ক্যাম্প থেকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয় রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনপ্রত্যাশী রোহিঙ্গারা একাট্টা হওয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে দেখে ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতার ছক তৈরি করে দুর্বৃত্ত রোহিঙ্গারা। এরই অংশ হিসেবে এই হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শিহাব কায়সার খাঁন জানান, এই ঘটনার পেছনে কারা তা তারা এখনো শনাক্ত করতে পারেননি। তবে ঘটনার পর অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। এ পর্যন্ত মুজিবুর রহমান নামের একজনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে।

এদিকে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনেকটা অগ্রগতি হলেও কিছু লোক চায় না তারা নিজ দেশে ফেরত যাক। তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে। আগে মুহিবুল্লাহ হত্যা এবং এখন ক্যাম্পে মারামারি করে মানুষ খুন করার পেছনে এদের হাত থাকতে পারে। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সরকার।’

মন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর ও বাইরের আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের লক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা করছে অনেকে। এসব বন্ধে সরকার কঠোর হবে।’ এ সময় তিনি জানান, এসব বন্ধে প্রয়োজনে গুলি চালানো হবে।

গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি একজন বিদেশি দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও তারা এখন আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যাবাসন ছাড়া এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অপরাধ দিনে দিনে বাড়ছে। গত চার বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে এক হাজার ৩০০ মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে দুই হাজার ৮৭০ রোহিঙ্গা। অপরাধের মধ্যে রয়েছে- হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানবপাচার, পুলিশের ওপর হামলা ইত্যাদি।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চার বছরে ৭৬টি খুনের মামলা হয়েছে। এসময়ে ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। অন্যান্য অপরাধে হয়েছে ৮৯টি মামলা। গেলো ৪৯ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৩৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩৬০ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৩টি, আসামি ৬৪৯ জন। আর ২০২০ সালে ১৮৪টি মামলায় হয়েছে, আসামি ৪৪৯ জন।

(ঢাকাটাইমস/২২অক্টোবর/জেবি)