বিশ্বে গবেষণায় রোল মডেল হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৪:০১ | আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২১, ১২:২৬

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুিদ্দন আহমেদ

‘বিজ্ঞান হচ্ছে মনের পরিশ্রমের কারুকাজ’- ফ্রান্সিস বেকনের এই উক্তির সাথে আপনার দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমানে আধুনিক মানব সভ্যতা বিজ্ঞানের আশীর্বাদস্বরূপ। বিজ্ঞান আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর বিজ্ঞানের যে শাখাটি ছাড়া মানুষ বর্তমানে তার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারেনা সেটি হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। 

প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক ভীষণ নিবিড়। আর প্রাচীনকালে মানুষ চিকিৎসার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতিতে অফুরান্ত উপকারী ভেষজ উপাদান রয়েছে। কিন্তু এসব উপাদানকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ তখনকার দিনে অসম্ভব ছিল। কারণ তখন বিজ্ঞান ছিল না। ফলে দেখা যেত ডায়রিয়া, কলেরার মত যেসব রোগ নিয়ে বর্তমানে কারো কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, তখনকার দিনে এসব রোগে গ্রামের পর গ্রামের মানুষ প্রাণ হারাতো। কারো এসব রোগ দেখা দিলে তাকে একঘরে রাখা হতো। যদি লতাপাতায় কাজ না হতো তবে তাদের শেষ ভরসা ছিল পানি পড়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক, পীর, ফকির, ওঝা। এডাম স্মিথ বলেছিলেন, ‘উদ্দীপনা এবং কুসংস্কারের বিষের দুর্দান্ত প্রতিষেধক হলো বিজ্ঞান’।

বর্তমানে দৈনন্দিন জীবন হোক বা চিকিৎসা, সব ক্ষেত্রেই আমরা পুরোপুরি বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। তবে আজকের এই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বিজ্ঞানের বহু দিনের গবেষণার ফলাফল। চিকিৎসা বিজ্ঞান ও চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাস অতি সুপ্রচীন। খ্রিষ্ট জন্মের শত শত বছর আগেই দর্শন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা মাত্র একই সাথে প্রতিভাত হয়। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত এখানে গ্রিক সভ্যতা এগিয়ে ছিল। পরবর্তীকালে মিশরীয় চৈনিক মুসলিম ও ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাত ধরে চিকিৎসাশাস্ত্র এগুতে থাকে। 

অষ্টাদশ শতকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চিকিৎসা গবেষণাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক কাঠামো প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। তবে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের মানুষের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি গবেষণায় অনেক উন্নতি সাধন করেছে। যার ফলে এই মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে।

উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় বিশ্বমানের সাথে সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা গবেষণাও চলছে। উন্নতমানের চিকিৎসা প্রদান করার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরকে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে তৎকালীন সময়ে দেশের ১৩টি সরকারি ও ০৫টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং নিপসমসহ ০৫টি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের চিকিৎসক শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মান উন্নয়নের যথেষ্ট ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছিল না। বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন দেশে একটি স্বতন্ত্র ও গবেষণা সমৃদ্ধ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সকল মেডিক্যাল কলেজের স্বায়ত্বশাসন দাবি করে আসছিল।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান। এদেশের চিকিৎসক সমাজ এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে তাদের সকল প্রত্যাশা পূরণের ভরসাস্থলের সন্ধান পান। সংবিধান স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং দেশের চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন আইপিজিএমআর কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উন্নীত করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম স্বতন্ত্র পাবলিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

জাতির পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম পাবলিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ আন্তর্জাতিক মান অর্জন করে দেশের আপামর জনসাধারণের সুচিকিৎসায় নিয়োজিত হবেন এ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মাথায় ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কেবলমাত্র হীন রাজনৈতিক সংকীর্ণতায় বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে আবারো আইপিজিএমআর করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করেছিলাম তাদের বিরুদ্ধে নানাবিধ মামলা হামলা করেছিল তৎকালীন সরকারের লেজুড়ভিত্তিক চিকিৎসক সংগঠন ড্যাব ও কর্মচারী গোষ্ঠী। 

এহেন ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা কর্মচারীসহ দেশের সকল পেশাজীবী ও আপামর জনসাধারণ তীব্র ক্ষোভ ও আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। তীব্র আন্দোলনের ফলে বিএনপি-জামায়াত সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবুও ক্ষোভের বশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ফলক থেকে জাতির পিতার নাম মুছে ফেলে সংক্ষেপে বিএসএমএমইউ লিখে পরিচিতি দেয়। এমনকি তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকা থেকে গাজীপুর, টুঙ্গিপাড়া বা অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার হীন উদ্যোগ গ্রহণ করে। এদেশের জনসাধারণের বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আবারও ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সেলেন্সে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। 

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্প্রসারণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বারডেম সংলগ্ন বেতার ভবনের জমি ও হাসপাতালের উত্তর পার্শ্বের ১২ বিঘা জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেন।  বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে ৫২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ সহায়তা ও দিকনিদের্শনায় খুব দ্রুত নতুন কেবিন ব্লক সম্প্রসারণ অনকোলজি ভবন নতুন বহিঃবিভাগ, আধুনিক আইসিইউ, ওটি কমপ্লেক্স, মেডিক্যাল কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান, চাকরিসহ বিভিন্নক্ষেত্রে কোটা প্রবর্তনসহ নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এরই অংশ হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেল গঠন করা হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা, কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আলাদা কেবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ডা. এম এ কাদেরী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নিরলস পরিশ্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আধুনিক ও উন্নত মানের করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। ভাইস চ্যান্সেলর এম এ কাদরী এর আমলে যে রেসিডেন্সি কোর্স চালু করে। দেশের সকল চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম চালু হওয়ায় এখানে উচ্চতর সকল ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে কোন বিষয়ে কতজন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন সে অনুসারে উচ্চশিক্ষার প্রসার দরকার। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে অনেক দুর অগ্রসর হয়েছে। বর্তমানে দেশের সকল মেডিক্যাল কলেজসহ সকল পোস্ট-গ্রাজুয়েট চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে দেশের সকল উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষা ডিগ্রি ও কোর্স সমূহকে একই মানে উন্নীত করা হয়েছে। ফলে দেশের উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষার ব্যাপক উন্নয়ন ও প্রসার ঘটেছে। একই সাথে সেবার মান বেড়েছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অধ্যাপকদের প্রতিষ্ঠানিক বৈকালিক প্র্যাকটিস, ২৪ ঘণ্টা ল্যাবরেটরি সুবিধা চালুর মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষ স্বল্প অর্থ ব্যয় করে উন্নত বিশ্বের ন্যায় আধুনিক ও মান সম্পন্ন সেবা পাচ্ছে। জরুরি বিভাগ চালুকরা, শিক্ষক-চিকিৎসকদের ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের ব্যবস্থা করা, শুধু মাত্র অপশন প্রদানকারী সকল চিকিৎসকদের প্রানোদনা ভাতা প্রদান, শিক্ষকদের যানবাহন প্রদান করা, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।

সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কোরিয়া সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১০০০ শয্যা বিশিষ্ট কোরিয়া মৈত্রী বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যা এ সরকারের আরও একটি সফল্য।

প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে দেশে গবেষণা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে বর্তমানে আমরা গবেষণায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি, যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ এর জেনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। গবেষণায় দেখা গেছে মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কোভিড-১৯ এর টিকা গ্রহীতাদের উপর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। সেখানে দেখা গেছে টিকা গ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের উপর গবেষণা চলমান রয়েছে। 

উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান, উন্নত চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সংযুক্তির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এই প্রত্যাশা সবার। সবাই মিলে যার যে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এই মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সফল হবেই। 

লেখক: অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা