একটু হাসতে শিখতে হবে নির্মল হাসি, বিদ্বেষমুক্ত হাসি

মাসকাওয়াথ আহসান
 | প্রকাশিত : ২৭ অক্টোবর ২০২১, ১৭:১৭

গোটা বিশ্বেই এই মুহূর্তে বিকাশমান শিল্পের নাম স্ট্যান্ড আপ কমেডি। উচ্চশিক্ষিত মেধাবী ছেলে-মেয়েরা ন'টা-পাঁচটা চাকরির দাসত্ব ছেড়ে মুক্ত এ পেশা বেছে নিচ্ছে। অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তারা নিজের পরিচয় তুলে ধরে 'আমি একজন কমেডিয়ান।' বৈশ্বিক এই শিল্পধারায় অত্যন্ত জোরেশোরে যোগ দিয়েছে ভারতের তরুণ-তরুণীরা। শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে স্ট্যান্ড আপ কমেডির বিকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশের কোন খোঁজ নেই। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আড্ডাগুলো একসময় কৌতুকে ঠাসা থাকতো। যা কিছু সুন্দর আর নির্মল তাই-ই যেন অনুপস্থিত বাংলাদেশ সমাজে আজ।

ভারতে বিগত কংগ্রেস আমলে স্যাটায়ারে কোন বাধা ছিলো না। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর; যেহেতু সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে থাকা লোকেরা এর সদস্য; একটু বাধা দিতে উদ্যত হয়েছিলো মোদি সরকার। কিন্তু ভারতের সমাজ যেহেতু মুখে ঠুসি পরে তৈলব্রতে লেগে পড়তে প্রস্তুত নয়; মোদি আর অমিত শাহকে পিছু হটে মেনে নিতে হয়েছে সব ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ। পাকিস্তানে মোল্লা-মিলিটারি-রাজনীতিকের দুষ্টচক্রের সর্বদা উপস্থিতি থাকার পরেও ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ থেমে নেই। শ্রীলংকায় শাসকের কর্কশতা কেড়ে নিতে পারেনি ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের অধিকার।

কী হয়েছে তবে বাংলাদেশে; যেখানে সব কিছুতেই 'চুপ চুপ চুপ', ঢাক ঢাক গুড় গুড়। যে দেশের জাতির জনক ইন্সট্যান্ট স্যাটায়ারের মাস্টার ছিলেন; যে কোন অপ্রিয় কথাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের মোড়কে উপস্থাপন করতেন যিনি অনায়াসে; তাঁর ছবি টাঙ্গিয়ে রাজনীতি করা দলটি কেন আজ 'রাম গোরুড়ের ছানা' হয়ে হাসতে মানা করে দিয়েছে সবাইকে।

সাইবার সিকিউরিটি এক্ট নামের কালো আইনটির প্রয়োগ ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকায় এতো প্রকট না হলে; বাংলাদেশে কেন তার এমন বিভীষিকাময় চেহারা!

ভারতের নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী অনুদান দিয়ে "হীরক রাজার দেশে" নামের ব্যাঙ্গ চলচ্চিত্র বানানোর সুযোগ করে দিয়ে; এই চলচ্চিত্রে নিজেরি অপমান মাথা পেতে নিতে পারলে; বাংলাদেশের নেত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসে কেন নিজেকে এমন নিরস-কঠোর মানুষ হিসেবে রেখে যাবেন! তিনি তো বলেন, শেষ পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুরই মেয়ে; কিন্তু রম্যপ্রিয় বঙ্গবন্ধুর মেয়ে এমন রম্যবিরোধী কেন হলেন; এটা বুঝতে ভীষণ কষ্ট হয়।

জার্মানির নেত্রী আঙ্গেলা ম্যারকেলের মতো একজন নিরস মহিলা নিজের ক্যারিকেচার দেখে খুক খুক করে হাসেন। উত্তর কোরিয়া আর বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর সব জায়গায় অবাধে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করা যায়; এই সত্য ভাষণটি নেত্রী শেখ হাসিনার জন্য সুখকর নয়। কারণ কিম জং উনকে দেখলে; ছবি আঁকার হাত আছে যেহেতু; শেখ হাসিনার নিজেরো ঐ নিরস কিমের একটি ক্যারিকেচার আঁকতে মন চাইবে।

বাংলাদেশের সমস্যা দাঁড়িয়েছে; এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। এখানে গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আছে; যারা বিবৃতি দুগ্ধ দেয়; পরিবর্তে সরকারি খড়-ঘাস-বিচালি-খৈল আহার করে। এখানে গৃহপালিত রাজনীতিকেরা আছে যারা জ্বি হুজুর বলে মাথা দোলায়; পরিবর্তে নিজের মোটা-তাজাকরণ নিশ্চিত করে। এই খামারে সরকারি সহমত প্রাণী হবার জন্য ছাগল-গরু-মোষ একঘাটে জল খায়।

স্কুলের রচনা খাতায় বাছুরেরা লেখে, আমার জীবনের লক্ষ্য 'সহমত পশু হইতে চাই'। এইখানে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে হোলিয়ার দ্যান দাও প্রভুভক্ত পশু ও প্রাণীরা। তারাই সমাজ ও সংস্কৃতির সমস্ত বিকাশ থামিয়ে নিজেদের পশুপ্রাণী প্রজাতন্ত্রের আদলে তৈরি করেছে ভয়ের রাজ্য। শিং বাগিয়ে জনপদে একে ওকে গুঁতো দিতে বেড়ায় তারা। প্রভুভক্ত সহমত পশু ও প্রাণীরা সাইবার আইনে যেসব মামলা দেয়; সেগুলোর অভিযোগসমূহ একদিন প্রধানমন্ত্রী নিজে যদি পড়েন; উনি অভিযোগ বাতিল করে সহমত পশুদের ক্যারিকেচার আঁকতে শুরু করবেন মামলার নথিতে।

বাংলাদেশে স্ট্যান্ড আপ কমেডি বিকশিত না হবার পেছনে; সরকারি 'একটি বাড়ি একটি খামার চিন্তার পাশাপাশি রয়েছে সমাজে মনের দারিদ্র্য। ভারতের সমাজের আর্থিক দারিদ্র্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু মনে দারিদ্র্য নিশ্চয়ই কম। সে কারণেই একটা ছেলে বা মেয়ে এমবিএ বা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হতে পারে।

ভারতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের সাফল্যের গল্প নেই; প্রবাসীর নতুন বাড়ি কিনে ছবি দিয়ে গদগদ হবার প্রগলভতা নেই; দুর্নীতির টাকায় নতুন গাড়ি কিনে ডিসপ্লে করার আদিখ্যেতা নেই; ওসব আর চলে না ওখানে। স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে তাদের নিয়ে এতো ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ হয়; যে লুকিয়ে থাকে তারা। আর বাংলাদেশে প্রত্যেকদিন সকালে একটা সুসংবাদ নিয়ে হাজির হতে হয় সরকার,সহমত ভাই, বিসিএস স্যার আর প্রবাসী সফল ভাইকে। এমন সাফল্য ভিখিরী জনপদ পৃথিবীতে আর একটিও নেই।

বাংলাদেশ সমাজ মানস নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। কেন এতো সিরিয়াস সবাই। কেন রাগ দেখানো আর গম্ভীর হয়ে থাকা ব্যক্তিত্বের পরিচয় এখানে। কেন এতো ধর্মীয় ও দলীয় অনুভূতি। কেন এতো হীনমন্যতা, ইনসিকিওরিটি, কেন এতো 'পাছে লোকে কিছু বলে'; কেন এতো জাজমেন্টাল হবার বাতিক; নিজে বলদ হয়েও অন্যকে বলদ ডেকে স্মার্ট হবার চেষ্টা; কেন এতোটা আনস্মার্ট একবিংশ শতকের মানুষেরা; কেন এতো উপমানবিকতা; কী করলে একটু উপমানব থেকে সম্পূর্ণ মানুষ হওয়া যাবে।

আর কিছুই না; টেনশন কমাতে হবে; মানসম্মান-সাফল্য জাতীয় আউটডেটেড চিন্তার ভার থেকে মনকে মুক্ত করতে হবে। আনন্দে বাঁচতে শিখতে হবে। মনের গরীবী না হটালে জিডিপি গ্রোথ আর ব্যাংক রিজার্ভ দিয়ে মনের দোজখ সরানো যাবে না। একটু হাসতে শিখতে হবে; ফেসবুকের অসাড় মাঠা হাহাহা নয়; নির্মল হাসি; বিদ্বেষমুক্ত হাসি।

লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক

(ঢাকাটাইমস/২৭অক্টোবর/এসকেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :