প্রতারণার বাজারে নিত্যনতুন আইডিয়া!

প্রকাশ | ০৪ নভেম্বর ২০২১, ১৪:২০

বোরহান উদ্দিন

পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। সঙ্গে পাল্টাচ্ছে মানুষের চিন্তাভাবনাও। কেউ ভালো চিন্তা করে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদ পাতছে। অসহায়ত্বের মিথ্যা কথা বলে কামাই করছে টাকা। সাধারণ মানুষও সরল মনে এদের দান-খয়রাত দিচ্ছে। অথচ প্রতারকদের পুরো গল্পটা যে মিথ্যা দিয়ে মোড়ানো আমরা তার খবর রাখি না। আপত দৃষ্টিতে সহায়তার অংকটা বেশ অল্প হলেও বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করলে অংকটা বেশ বড়। প্রতারণার এমন দুটো ঘটনা শেয়ার করছি। একজনও যদি সতর্ক হই, প্রতিবাদ করি সেটাও কম কিসে।

ঘটনা-১. অন্যদিনের মতো মঙ্গলবার (০২ নভেম্বর) বাসে অফিস যাচ্ছি। আজমেরী পরিবহনের বাসটি তাঁতীবাজার পার হওয়ার সময় দুই তরুণ গাড়িতে ওঠে। একজনের হাতে বাসের কন্ডাক্টরের মতো করে ১০/২০ টাকার অনেকগুলো নোট। কম হলেও ৩-৪শ টাকা হবে। গাড়িতে ওঠে একজন জোরে জোরে বলা শুরু করলো, ‘ভাই ট্রাক চাপায় একজন ভ্যানওয়ালা মারা গেছে। লাশ বাড়ি নেয়ার জন্য সহযোগিতা করেন।’ ননস্টপ কথাগুলো বলতে বলতে একজন বাসের পেছন পর্যন্ত চলে গেছে। খেয়াল করে দেখলাম পাশের একজন মহিলা যাত্রী ১০ টাকা বের করে দিয়েছে। আরও দুই একজন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

লোক দুটোকে দেখে সন্দেহ হওয়ায় বললাম- কখন কে মারা গেছে? প্রশ্নটা শুনেই দুজনের চেহারা কিছুটা আতঙ্ক লক্ষ্য করলাম। কারণ সাধারণত এমনভাবে কেউ এদের কাছে কিছু জানতে চায় না। ওদের চেহারা দেখে আরেকটু কনফার্ম হলাম- যে ঘটনা খারাপ। এরা স্রেফ আবেগ নিয়ে খেলতে বাসে উঠছে। দিন শেষে যা পায় তা দিয়ে নিজেরা চলে। পারলে নেশাপানিও করে। কারণ চেহারার রঙঢঙ সে কথাই বলে।

বললাম- কোন জায়গায় মারা গেছে? কি হয় আপনাদের? বললো- বাবুবাজার ব্রিজের কাছে। বললাম লাশ কোথায় দাফন করবেন? বললো- গ্রামে নিয়ে যাবো। বললাম- ব্রিজের ওখানে রেখে এখানে কেন আসছেন? থানায় জানালে তারা ব্যবস্থা করবে। একের পর এক প্রশ্ন শুনে অনেকটা ঘেমে যাওয়া শুরু এদের৷ ততক্ষণে দেখলাম যারা টাকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারাও টাকা পকেটে রেখে আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলা শুরু করলেন এমন হুটহাট প্রতারণা মুখে পড়ার কথা।

এদিকে বেচারাদের অবস্থা তো কাহিল। দ্রুত বাস থেকে নামতে পারলে বাঁচে৷ ঠিকই কোন ফাঁকে নেমে গেছে তা খেয়ালও করতে পারিনি।

খেয়াল করে দেখবেন- আপনার/আমার চলার পথে এমন ঘটনা মাঝেমধ্যেই নজরে আসবে। দেখবেন কাহিনিগুলো পুরোপুরি এক। শুধু ঘটনাস্থল আর মৃত্যু ব্যক্তিটির কথা এরা আলাদা করে বলবে। কেউ হয়তো ফার্মগেটে বাসে উঠে বা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বলবে- ঢাকা মেডিকেলে মা/বাবা/আত্মীয় মারা গেছে বাড়ি যাবো লাশ নিয়ে টাকা দেন। কখন,  কোন ওয়ার্ডে মারা গেছে, তাদের বাড়ি কোথায় এমন প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর না দিয়ে সামনে যাবে৷ অথচ এমন বিপদ সত্যি হলে কার না উপকার করতে ইচ্ছা করে? কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে মারা যাওয়া স্বজনকে রেখে সর্বোচ্চ শাহবাগ পর্যন্তই সহযোগিতা চাওয়া মানা যায়। চানখারপুল বা বকশিবাজারে দাঁড়ালেই তো কয়েক হাজার টাকা সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব!

ঘটনা-২. বুধবার (০৩ নভেম্বর) রাতে বাসায় ফেরার পথে আজমেরী পরিবহনে জিপিও থেকে উঠলাম। আকারে বড় বাসটির অনেক আসন ছিল ফাঁকা। ফোনে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম একজন দীর্ঘদেহী যুবক বাসে উঠেই যাত্রীদের কাছে সহযোগিতা চাচ্ছেন। কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছেন না। কারণ তার চেহারা দেখে সহযোগিতা চাওয়ার মানুষ মনে করার খুব বেশি কারণ নেই। এক আঙ্কেল বললেন- কী জন্য সহযোগিতা লাগবে? বললো- ‘বাসে খুলনা যাবো ভাড়া নেই।’  তিনি বলেন- ‘তুমি বাসে যাও। বলো ভাড়া নেউ দেখবে ওরা বিনা ভাড়ায় নিয়ে যাবে।’

মূহুর্তে কথাটা কানে লাগলো। ধরে নেই এ আরেক প্রতারক। কারণ সদরঘাট এলাকা থেকে তো খুলনায় কোনো বাস যায় না। তাহলে উনি এদিকের বাসে কেন? এরমধ্যে আমার কাছে সহযোগিতা চাইলেন সুঠাম দেহের লোকটি।

বললাম- কোথায় যাবেন আপনি? বললো- খুলনা যাবো। বললাম- এই বাস তো সদরঘাট যায়, এটায় কেন উঠছেন? বললো- গুলিস্তান থেকে উঠছি। ভাড়ার টাকা হলে চলে যাবো। বললাম- খুলনার গাড়ি কোথা থেকে ছাড়ে? বললো- গাবতলি....এ কথা বলতে বলতে বেচারা পরিস্থিতি খারাপ দেখে নেমে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করে দিলো। ডেকে বললাম- যে ধান্দা নিয়ে আসছেন তা ধরে ফেলছি কিন্তু। দেখতে শুনতে তো মাশাল্লাহ। এসব ছাড়বেন কবে? ধান্দার কথা শুনে প্রথমে কিছুটা রিয়্যাক্ট দেখানোর চেষ্টা করে পরক্ষণে বললো- আমার নাকে একটা অপারেশন করতে হবে তো, অনেক টাকা লাগবে। বললাম- খুলনা ট্যুর কী তাহলে ক্যান্সেল করে দিলেন? মুচকি হেসে বললো- না যাবো, অপারেশনটাও করতে হবে৷ আসলে আমার নাকটাতে অনেক সমস্যা। বললাম- আসলেই সমস্যা হলে অবশ্যই হেল্প করবো আমরা। কিন্তু নয়ছয় করে তো ধরা খেয়ে গেলেন আপনি।

এরমধ্যে বাসের আরও কয়েকজনের হুঁশ ফিরলো। তারাও প্রতিবাদ করা শুরু করলেন। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে ‘নব্য বাটপার’ বাস থেকে নেমে পড়ল।

নামার সময় বয়স্ক একজন যাত্রী বললো- ‘মিয়া তোমার যে শরীর কাম করলেও তো দিনে ৫০০-১০০০ কামাইতে পারো। ধান্দা করা লাগে!’ কিন্তু এত কথা তো তার শোনার সময় নেই। কারণ অন্য বাসে বা পথচারীর কাছ থেকে ঠকবাজি করে কিছু পকেটে ভরতে হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী