আমি অচল আমি অপ্রয়োজনীয় আমি উপেক্ষিত

রেজাউল মাসুদ
 | প্রকাশিত : ০৫ নভেম্বর ২০২১, ১০:৪৫

গ্রামের বাড়ি গেলেই এক অসহায় মাকে না দেখে আসিনা আমি। তার সঙ্গে কথা বলে বেশ লাগে আমার। বয়স তার আশির ঘরে। সেই সময়ের ম্যাট্রিক পাস। অনেক বিষয়েই বিচক্ষণ এবং সমসাময়িক নানা ইস্যুতে বাস্তবধর্মী নলেজ রাখেন তিনি, সেটা রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা যেকোনো শাখাই হোক। তাই তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলা যায়। অল্পসময় কিংবা অসময়ে দরদী এই মায়ের কাছে গেলেও উনার হাতের খাবার না খেয়ে আসতে পারিনা কখনো।

‘আচ্ছা তুমি তো পুলিশের বড় অফিসার, তোমাদের কাজের ব্যস্ততা নেই নাকি!’ আমি থতমত খেয়ে যাই তার কথায়! “প্রতি ঈদেই কয়েকদিনের ছুটিতে জামালপুর আসো তুমি! আবার দুতিন মাস পরপরই গ্রামে আসো। বিশেষ উৎসবেও চলে আসো মাঝে মাঝে।” কয়েকদিন আগে উনার সাথে দেখা করতে গিয়ে এমন কথায় হতচকিত হয়ে যাই, সম্বিত ফিরে পেয়ে দ্রুত এই মায়ের ভাষা বুঝতে পারি। উনার চার ছেলে দুই মেয়ে। রত্নগর্ভা বলা যেত এক সময়। সন্তানরা সবাই গ্রাজুয়েট। পদপদবীতেও বেশ সম্মানজন পজিশনে। বিসিএস ক্যাডার ইঞ্জিনিয়ার এক সন্তান পাশ্ববর্তী জেলায় কর্মরত। পূত্রবধু কলেজ শিক্ষক। এই মা কথা প্রসঙ্গে জানায় তার এই সন্তানটা অসম্ভব মেধাবী। একটা সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা যতনা কষ্টের তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট তাকে মানুষ বানানো! শিক্ষক বাবা তার পড়ালেখায় এতটা কেয়ারিং ছিল যে অন্যকিছু খেয়াল না করে প্রায়সময়ই মাসের পুরো বেতন তার নামে মানি অর্ডার করত।

কঠিন পড়ালেখার অবসরে যখন ছুটিতে আসতো আমি পথপানে দাঁড়িয়ে থাকতাম, যাওয়ার সময় মন আনচান করতো আমার, বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতাম তাকে উঠিয়ে দিতে। সে উচ্চশিক্ষিত হলো, ভাল চাকরি পেল। কিন্ত আফসোস মানুষ তো হলো না! আজ এই ছেলে মহাব্যস্ত। ব্যস্ততা তার চাকরি সংক্রান্ত, কখনো সেটা ছেলেমেয়ের পড়ালেখা কিংবা পরীক্ষা সম্পর্কিতও। আবার শ্বশুর-শাশুড়ি স্ত্রীর নানামুখী ব্যস্ততা তো রয়েছেই। মাকে দেওয়ার সময় নেই তার। গত পনের বছরে একদিনের জন্যও গ্রামের বাড়িতে থাকেনি সে। মানুষ এতটা অকৃতজ্ঞ হয় কি করে! হঠাৎ করে কখনো সে এক-দুই ঘণ্টার জন্য বাড়ি আসে, তা কেবল দায়িত্বকর্তব্যের তাগিদে। আবেগ কিংবা ভালোবাসা তাকে তাড়িত করে না কখনো। ‘তুমি শুনলে অবাক হবে আমার এই উচ্চশিক্ষিত ছেলেটা দুই মাসে মাত্র চারবার ফোন করেছে আমাকে, ব্যস্ততার অজুহাতে কথাও বলেছে মাত্র কয়েক মিনিট।

আমি এই মায়ের কথা শুনে যেন তলিয়ে যাচ্ছিলাম। আগ্রহ নিয়ে জানতে পারি তার বড় ছেলে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। তার জন্য অন্তপাগল এই মা। তার বিয়েতে গ্রামের কয়েক একর জমি বিক্রি করে দেয় মা। শহরের স্ট্যাটাস ঠিক রাখতে বড় ছেলের ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করেন এবং ঢাকায় জমিও কিনে দেন। পরবর্তিতে জমির মালিকানা নিয়ে বিবাদে জড়ান ছেলেরা। সবার কাছে মা হন অপাঙক্তেয়। তাই গত ষাট দিনে একটি বারের জন্যও বড় ছেলে ফোন করেনি মাকে। এই মায়েরই এক মেয়ে যিনি রাজশাহী থাকেন স্বামী সন্তান নিয়ে, গত কয়েক মাসে তিনিও অসহায় এই মায়ের একটিবারের জন্যও খবর নেয়নি, ফোন করে কখনো বলেনি, “মা গো তুমি কেমন আছো?”

চরম অসহায় আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার ছোট ছেলের কথা বলেন যাকে দায়িত্বশীল হিসাবে সবাই জানে। মায়ের প্রতি তার দরদও ছিল বেশ, মায়ের অনেক আদরের সে। কিন্ত ইদানিং সেও কোনো খোঁজখবর রাখে না। কয়েকমাসে মাত্র একবার কথা বলেছে। ছেলেবউরাও তেমন, দুমাসে কেউ একবার, কেউ দুবার কথা বলেছে। হায়রে রত্নগর্ভা মা তিনি এখন পরিবারে অচল, উপেক্ষিত, অপ্রয়োজনীয় ও অসহায় মানুষে পরিণত হয়েছেন। সন্তানদের তাকে সঙ্গ দেওয়ার সময় নেই।

ডায়াবেটিস ব্লাড প্রেসারসহ নানান রোগ এখন নিত্যসঙ্গী তার। একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন এই মা, তাকে পাশ্ববর্তী জেলার ভাল হসপিটালে নেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। কিন্ত তারাতো ভীষণ ব্যস্ত, মাকে নিয়ে ভাববার সময় কই, ফোনে খবর পেয়েই দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আমি আমার ছোট ভাইকে পাঠাই সেই অসহায় মায়ের কাছে। বাবার মৃত্যুবার্ষিকী আহ! সন্তান! তারিখটাও হয়তবা মনে নেই, ভাইবোন কখনো একত্র হওয়া নেই! বাবার আত্মীয়স্বজন আপনজনদের খোঁজখবর করা নেই! দোয়া দরুদ নেই! যাকাত নেই! দান খয়রাত নেই! কবর জিয়ারতও নেই!

কথিত আছে, এক সন্তান তার পিতাকে মারতে মারতে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। এরপর পিতা তার সন্তানকে বলে, তুমি থামো! কেননা আমিও আমার পিতাকে মারতে মারতে এতটুকু পর্যন্ত নিয়ে এসেছিলাম।

যারা পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্য এবং বৃদ্ধ বাবা-মাকে অবহেলা করে, অশ্রদ্ধা করে, বোঝা মনে করে, একদিন তাদেরও বার্ধক্য আসবে, শরীর অচল হবে, তারাও উপার্জনে অক্ষম হবেন। দেমাগ গরিমা কমে যাবে! তাদের সন্তানরাও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করবে!

লেখক: বিশেষ পুলিশ সুপার, সিআইডি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :