বাঘের গর্জন শুনে একটু বিপদেই পড়েছিলাম বৈকি

নুরুজ্জামান লাবু
| আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪৮ | প্রকাশিত : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪৪

সুন্দরবনে গিয়ে দলবেঁধে সবাই জামতলা সৈকতে গিয়েছিলাম। বিকেলে। অনেকেই না করেছিলেন। এই বিকেল বেলায় জামতলা সৈকতে গিয়ে ফিরে আসা সম্ভব নয়, অন্ধকার হয়ে যাবে। ফেরার পথে গহিন বনের হিংস্র প্রাণীরা আক্রমণ করতে পারে। সুন্দরবনে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত যাতায়াতকারী মোহসীন-উল হাকিম ভাইও না করলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে বসলো আমাদের। আমরা সংখ্যায় কম নয়। প্রায় ১৮-২০ জন। এত লোকজনের কাছে হিংস্র প্রাণী কাছে আসা তো দূরের কথা, দৌড়ে পালাবে। এই সাহস বুকে নিয়ে হাঁটা দিলাম।

প্রায় এক ঘণ্টার পথ। ওয়াচ টাওয়ার পেরিয়ে বনের মধ্যে সুদৃশ্য একটি মাঠ। তারপর বনের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথ। গহিন বন পেরিয়ে ওপাশে জামতলা সৈকত। জামতলা সৈকতে আমি আগেও গিয়েছিলাম একবার, ২০০৭ কিংবা ২০০৮ সালে। সেবার সঙ্গে ছিলেন চ্যানেল আই বাংলালিংক বাংলার পথে ট্রাভেল শো'র টিঙ্কু ভাই আর তার দলবলও ছিল। এই সৈকতেই বুয়েটের এগার শিক্ষার্থী একসঙ্গে ভেসে গিয়েছিল সাগরের জলে।

জামতলা সৈকতে পৌঁছাতে আমাদের শেষ বিকেল হয়ে এলো। সূর্যাস্তের সময়। অপরূপ সৈকত। নিসঃঙ্গ। আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ নেই সৈকতে। ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এক ঘেয়েমি জীবন। জনমানবহীন নিঃসঙ্গ ফাঁকা সৈকত পেয়ে আমরা যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এটাই আমাদের জীবনে কাল হয়ে এসেছিল প্রায়।

আমি আর নুরুল আমীন পর্যটন জাহাজের এক রুমের সাময়িক বাসিন্দা। তো যথারীতি নুরুল আমীন আর আমি সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে উদাস ভঙ্গিতে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি খেয়ালই করিনি। এদিকে সূর্য মামা টুপ করে ডুবে গিয়েছে। গোধূলি বেলা বিদায় নিয়ে অন্ধকার নামবে নামবে করছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি ওরা কেউ নেই। দূর থেকে আবছা দেখা যাচ্ছে সঙ্গীরা বনের ফেরার পথে ঢুকে যাচ্ছে।

আমরা যেন সংবিৎ ফিরে পেলাম। হায় হায় এ কি করেছি আমরা! এক পলক আমি আর নুরুল আমিন একে অপরের দিকে তাকালাম। দুজনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে, ভয়ে। কালবিলম্ব না করে দিলাম ছুট।

আবছা আলোয় বনের পথ ধরে হাঁটছি। পাখির ডাক, বাতাসে গাছের মরমর আওয়াজ। কখনো বা অচেনা শব্দ, হবে হয়তো নাম না জানা কোনো প্রাণীর ডাক। সন্ধ্যার পরপরই নাকি শেয়ালের মতো সব প্রাণীই ডাকাডাকি করে। ভয়ে আমাদের গা শিউরে উঠছে। অজানা আতঙ্কে বুক ধরফর করছে। মনে পড়ছে জাহাজে বসে মোহসীন ভাই গল্প করছিলেন বন্য শূকরের কথা। এরা নাকি দল বেঁধে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনই হয়। বিপদের সময় নানারকম ভয়ার্ত গল্পগুলো মনে আসে বেশি।

নুরুল আমীন আমার সামনে। আমি পেছনে। পেছন ফিরে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। অন্ধকার পথ। মোবাইলের আলোতে আবছা পায়ে চলা পথটুকু কোনোভাবে একটু-আধটু দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাততালি দিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। হাঁটছি দ্রুত গতিতে। হঠাৎ একটা গর্জনের শব্দ কানে এলো। আমরা দুজনেই থ' মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম। এটা কি বাঘের গর্জন? দুজনেই ভয়ে একটু কুঁকড়ে গেলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। সামনে আগানো উচিত হবে কি না? সামনে না আগালে পুরো রাত এখানেই কাটাতে হবে। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। ফোন যে করবো তারও উপায় নেই। নুরুল আমীন বললেন, ভাই আপনি সামনে যান। আমি একটু সাহসী ভূমিকায় গেলাম বৈকি, বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। তারপরও দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করলাম। যেভাবেই হোক গহিন বন ছেড়ে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এর মধ্যেই আবার শুনতে পেলাম আরেকটা গর্জন। বাঘ কি না জানি না। কাছেই শুকনো পাতার মরমরে আওয়াজ এলো। মনে হলো কোনো প্রাণী বুঝি জায়গা বদল করলো। জোরে জোরে হাঁটছি। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি আর সাহস ধরে রাখার চেষ্টা করছি। তবুও আমার পা কাঁপছে। পেছনে নুরুল আমীন। আমার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে হাঁটছে। ভয় দুজনকেই গ্রাস করে ফেলেছে।

মনের ভেতর নানা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। যদি কোনো প্রাণী, বাঘ বা বন্য শূকর আক্রমণ করে তাহলে কি হবে? মনে মনে চিন্তা করছি যেভাবেই হোক আক্রমণকারী প্রাণীর গলাটা টিপে ধরতে হবে। অমূলক চিন্তা। অদ্ভুত সাহসী ভাবনা। হয়তো আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেন্সলেস হয়ে যাবো। আরাম করে বনের আরো ভেতরে নিয়ে ওরা আমাদের ভোজন করবে। এমন নানামুখী চিন্তা করতে করতেই দেখি গহিন বন শেষে ফাঁকা একটা মাঠে এসে দাঁড়িয়েছি।

ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে মনে হলো এই জীবন, কংক্রিটের শহরে বেঁচে থাকা, নিত্যসঙ্গী যানজটের শহরে বেঁচে থাকা, পাওয়া না পাওয়ার নানারকম বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বেশি আনন্দের। একটা চিৎকার করে উঠলাম আমি, সজোরে। নুরুল আমীন পাশ থেকে ধাক্কা দিল। তন্দ্রাচ্ছন্নটা কেটে গেল। আমি পর্যটন জাহাজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে, দুপুরের সুস্বাদু খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। পাশেই নুরুল আমীন। বলছেন- ভাই চলেন সবাই বনে ঢুকবে, চলেন।

আমি বললাম, আমি তো মাত্র গহিন বন থেকে বের হয়ে এলাম। নুরুল আমীনের ফ্যাকাশে মুখ, যেমনটা দেখেছিলাম জামতলা সৈকতের শেষ প্রান্তে, গোধূলি বেলায়, তেমনটা দেখাচ্ছে।

[সুন্দরবনে একদিন]

লেখক: নুরুজ্জামান লাবু, সংবাদকর্মী

(ঢাকাটাইমস/৯নভেম্বর/এসকেএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :