নারীহীন ৪০ হাজার পুরুষের বাস যে চরে!

প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৩৬ | আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৯

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস

গভীর সমুদ্র ও নদী থেকে নৌকা আসছে ছোট ছোট খালে। সেখান থেকে টেনে তোলা হচ্ছে জাল। জালে আটকানো মাছ ছাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ঝুড়িতে। কেউ কাঠের ছোট্ট জেটি পার হয়ে ‘মাছভর্তি ঝুড়ি’ চরে নামাচ্ছেন। সেসব মাছ চলে যাচ্ছে আড়তে। চারদিকে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

সুন্দরবনের ভেতরে প্রায় ৮১ বর্গমাইলের সর্ববৃহৎ শুঁটকিপল্লী দুবলা। বঙ্গোপসাগর উপকূলে পাঁচটি চর নিয়ে এই পল্লীর অবস্থান। চর ঘেঁষে বয়ে গেছে কুঙ্গা ও মরা পশুর নদ।

মোংলা ও শরণখোলা উপজেলার লোকালয় থেকে ৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরের চরটিতে প্রতিবছর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ বা নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে মাছ আহরণ ও শুঁটকি তৈরির কাজ। বছরের বাকি সময় থাকে প্রাণহীন।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলারচর, আলোরকোল, নারকেলবাড়িয়া, শেলারচর ও মেহেরআলীর চরে অস্থায়ীভাবে প্রায় ৪০ হাজার জেলে ও বহরদার বন বিভাগকে নির্ধারিত রাজস্ব দিয়ে অস্থায়ী শুঁটকি পল্লীতে ‘অস্থায়ী ঘর’ করে বাস করেন।

এ সময় জেলেরা প্রায় ৩০ ধরনের জাল দিয়ে সামুদ্রিক সাদা মাছসহ চিংড়ি ও কাঁকড়া আহরণ করেন। কার্তিক থেকে চৈত্র পর্যন্ত দুবলারচরের এই কর্মব্যস্ততাকে জেলেদের ভাষায় বলা হয় মাছের 'গোন'।

চরজুড়ে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের বসবাস থাকলেও সেখানে নেই কোনো নারী। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ করেন পুরুষরা। এ চরের পুরুষরা ঘরের কাজে খুবই পারদর্শী।

কার্তিকের এক সকালে চর ঘুরে এখানকার মানুষের জীবনের প্রভাব বিস্তার করা নানা কুসংস্কারের কথা জানা গেল। এই চরে কোনো নারীকে আনা হয় না বা থাকতে দেওয়া হয় না। চরের অস্থায়ী বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন, নারীরা সেখানে গেলে চরটি ঘিরে মাছ তোলার যে বিশাল আয়োজন, তাতে ভাটা পড়বে।

শুঁটকিপল্লীতে দেখা গেল, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জেলেরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। সমুদ্রমোহনা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ শেষে দুবলাচরের ঘাটে আনছেন। এসব মাছ চলে যাচ্ছে আড়তে। পাইকাররা সেখান থেকে মাছ কিনে চরের নিউমার্কেট-এর পাশের শুঁটকিপল্লীতে নিয়ে তা রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করেন। সেখানে ছোট ছোট ঘরে থাকেন জেলেরা।

দুবলার চরে গড়ে ওঠা বিশাল শুঁটকিপল্লীতে লইট্টা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা, খলিসা, ইছা, ভেদা, পোঁয়াসহ অন্তত ১০০ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি করা হয়। গত তিন বছর দুবলার চরের শুঁটকিপল্লিতে দস্যুদের চাঁদাবাজি বন্ধ রয়েছে। অনেকটা উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে দুবলার চরে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হচ্ছে।

বিচ্ছিন্ন এই চরটি মূলত জেলে ও শুঁটকিপল্লী হিসেবে পরিচিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পুণ্যস্নানের জন্য এর আলাদা পরিচিতি আছে। প্রতি বছর কার্তিক থেকে পরবর্তী পাঁচ মাস জেগে থাকে দুবলারচর। বঙ্গোপসাগর ছাড়াও সুন্দরবনসংলগ্ন নদী থেকে শিকার করা মাছ ঘিরে চলে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এরপর আবার 'মরে' যায় এই চর। বছরের বাকি সময় থাকে প্রাণহীন।

সাত্ক্ষীরা থেকে আসা ষাটোর্ধ্ব গাউছ গাইন লইট্যা মাছ শুকাতে ব্যস্ত। তাজা লইট্যা বাঁশের মাচায় বেঁধে দিচ্ছিলেন। মাসে ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে পাঁচ মাসের জন্য শুঁটকি বানানোর কাজ নিয়েছেন। মূল ব্যবসাটি তার জামাতা শফিকের। গাউছ গাইন বলেন, 'গ্রামে কাজ কম। অর্থকষ্টে আছি। এবারই প্রথম শুঁটকির কাজ নিয়েছি। বয়স হয়ে গেছে। সবাই সব কাজ দিতে চায় না।'

গাউছ জানান, প্রতি মণ কাঁচা লইট্যা গড়ে এক হাজার ৬০০ টাকায় কেনা হয়। শুকাতে চার-পাঁচ দিন লাগে। এরপর কেজি দরে তা নিয়ে যান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে আসা পাইকার বা তাদের লোকজন। মণপ্রতি লইট্যার শুঁটকি ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

প্রায় ৮১ বর্গমাইলের দুবলারচরের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকলে দেখা যায় নানা ধরনের মাছ শুকানোর কর্মযজ্ঞ। এখানে চিংড়ি, রূপচাঁদা, ছুরিসহ সামুদ্রিক নানা প্রজাতির মাছ শুকানোর কাছে ব্যস্ত শত শত মানুষ।

খুলনার ডুমুরিয়া থেকে আসা নারায়ণ বিশ্বাস এই চরের চার দশকের বাসিন্দা। শুঁটকির ব্যবসা ছাড়াও তার রয়েছে মাছ ধরার নিজস্ব ট্রলার। দুই ছেলেসহ তার ব্যবসায় যুক্ত আটজন।

নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চরে জেলেদের দিন কাটে। অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রাম্য চিকিৎসক থাকলেও প্রয়োজনে তারা খুব একটা কাজে আসেন না। হাসান মণ্ডল নামে চরের মৎস্যজীবী জানান, সংকটাপন্ন কাউকে দ্রুত চর থেকে ডাঙায় নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য দ্রুতগামী জলযানের ব্যবস্থাও নেই। এমন পরিস্থিতিতে জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় নৌকায়। অন্তত পাঁচ মাসের জন্য সরকার এখানে অস্থায়ীভাবে হাসপাতাল বা মেডিকেল ক্যাম্প করে দিলে তাদের অনেক দুর্ভোগ কমবে।

এ ছাড়া এখানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে নিরাপদ স্থাপনায় থাকার মতো ব্যবস্থা নেই। সুপেয় পানির জন্য চরে পুকুর খনন করা দরকার।

দুবলারচরে মোবাইল ফোন সেবাদাতা টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও তা খুবই দুর্বল। এসব টাওয়ার জেনারেটর দিয়ে চললেও তেল সমস্যা প্রতি মাসে প্রায় ‘দুই দিন’ নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন থাকে।

দুবলারচরে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, র‌্যাবের কাছে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণে পর থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে এখন আর বড় কোনো সমস্যা নেই। তবে বিশাল এই জলরাশি দস্যুমুক্ত হলেও প্রভাবশালীদের হাত থেকে মুক্ত হয়নি। বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে অনেকটাই বন্দি জেলেরা। সাগরমোহনার অনেক অংশে চাঁদা না দিলে সাধারণ জেলের মাছ ধরার সুযোগ নেই।

(ঢাকাটাইমস/ ১১নভেম্বর/মোআ)