উল্টো পথে রেল!

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০২১, ২০:৪২ | আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২১, ১৭:০৫

নাজমুস সালেহী

বাংলাদেশ রেলওয়ে ১৫৯ তম জন্মদিন পালন করছে। আজ থেকে ১৫৯ বছর আগে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামক কোম্পানি বাংলাদেশে প্রথম রেলপথ স্থাপন করে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেল যুগে প্রবেশ কর।

১৫৯ বছরের রেলওয়ের ইতিহাস হলেও বাংলাদেশ রেলওয়ের বয়স ৫০ বছর। এই ৫০ বছর রেলের ইতিহাস খুবই করুণ ও দুর্দশার।  মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও রেলের লোকসানা এখন প্রতি বছর গড়ে ১৫০০ কোটি৷ মাথা পিছু আয় বেড়েছে মানুষের আর অন্য দিকে প্রতি বছরই ভারী হচ্ছে রেলের লোকসানের পাল্লা৷ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও একটি দেশের রেল খাত লাভ তো দূরের কথা শিডিউল বিপর্যয় থেকেই বের হতে পারলো না। অথচ এই রেলই এক সময় ছিল জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান, অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি।

স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের রেল নিয়ে পর্যালোচনা করলে হতাশ না হয়ে উপায় নেই। যদিও বিগত কয়েক বছর আগেও রেলওয়ে ছিল একেবারেই অবহেলিত একটি খাত একথা শতভাগ সত্য। রেলের উন্নয়ন তো দূরের কথা রেল মনে হয় ভাবনাতেই ছিল না কোনো সরকারের। যদিও এখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে।

গত দশ বছরে রেল উন্নয়নের জন্য খরচ করেছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে চলছে ৪২টি উন্নয়ন প্রকল্প যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রেলকে বাজেট দেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ১২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয় রেলের বাজেট।

স্বাধীনতার সময় মোট রেল লাইন ছিল ২৮৫৮ কিলোমিটার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে তা হয়েছে ৩০১৮ কিলোমিটার। ৫০ বছরে বেড়েছে মাত্র ২০০ কিলোমিটার রেলপথ। স্বাধীনতার সময় রেলস্টেশনের সংখ্যা ছিল ৪৭০টি। ৫০ বছরে বেড়েছে মাত্র ১৩টি। বর্তমানে স্টেশনের সংখ্যা ৪৮৩টি। যার মধ্যে বন্ধ রয়েছে ১২০টি রেলস্টেশন। বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার জনবল ঘাটতি রয়েছে।

১৯৭০-৬৯ সালে রেলের ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি। বর্তমানে এর সংখ্যা ২৬৩টি। এখনও রেল চলছে ৭৫ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন আর ৬০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ লাইন দিয়ে। ৬০ শতাংশ রেল সেতুও ঝুঁকিপূর্ণ।

১৯৬৯-৭০ সালে রেলওয়েতে যাত্রীবাহী কোচ ছিল ১৬৪৩টি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বেড়ে হয়েছে মাত্র ১৭৬৪টি। বেড়েছে মাত্র ১০০টি। হিসাব বলছে, সারা দেশে রেলের জমি রয়েছে ৬১ হাজার একর। যার মধ্যে রেলওয়ের দখলে আছে মাত্র ৩১ হাজার একর। বেশিরভাগ জমির খবরই জানে না রেলওয়ে।

মোট লেভেল ক্রসিং আছে ২৫৬১টি যার মধ্যে অবৈধ ক্রসিং সাড়ে ১৪০০। ৫২তম (সর্বশেষ) টাইম টেবিলে প্রায় সব রুটেই বেড়েছে জার্নি টাইম। রেল মন্ত্রণালয় অফিসিয়ালি গতি কমিয়ে ট্রেন চালাতে নির্দেশনা দিয়েছে। কোনো কোনো রুটে ঝুঁকি বিবেচনায় চালকদের ৩০/৩৫ কিলোমিটার বেগে চালাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রতি বছরই লোকসান গুনছে রেলওয়ে। রেলের গড় লোকসান বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ তবুও লোকসান। কমছে গতি। বাড়ছে দুর্ঘটনা। যাত্রীসেবা নিয়ে অসন্তোষের শেষ নেই। ২০১২ থেকে দুই তিন দফায় রেলের ভাড়া বেড়েছে শতগুণ পর্যন্ত। শিডিউল বিপর্যয় এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। এখনও বিষণ্ণ মুখে ট্রেনের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্লাট ফরমে অপেক্ষা করেন যাত্রীরা।

চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর ও পার্বতীপুরে রয়েছে রেলওয়ের কারখানা। সেখানে রেলের বগি, ওয়াগন ও ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা হয়। এসব কারখানা কোনোমতে টিকে আছে। প্রতিটিই ৬৯/৭০ শতাংশ বাজেট ঘাটতি নিয়ে চলছে। ফলে সময় মতো মেরামত করতে পারছে না তারা। কারখানাগুলোতে রয়েছে ৭০/৮০ শতাংশ জনবল ঘাটতি। এভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে রেলওয়ের কারখানাগুলো। আগে শুধু সৈয়দপুর কারখানে উৎপাদন করা হতো উন্নত মানের কোচ আর ১২ হাজার রকম যন্ত্রপাতি, আর এখন কোচ মেরামতই বন্ধ হওয়ার পথে। বন্ধ হয়ে গেছে সৈয়দপুরের রেলওয়ে সেতু কারখানা৷

তবে সম্প্রতি রেলের বেশ কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। কিছুটা মান বেড়েছে যাত্রীসেবার। বেড়েছে বাজেট, নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প। কেনা হচ্ছে কোচ ও ইঞ্জিন। তবে এসবের বিপরীতে কেনাকাটা আর প্রকল্পে রেল কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবরও কিন্তু কম নয়। সম্প্রতি দুদকও রেলের উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে দুর্নীতিকে দায়ী করে রেলের দুর্নীতি হওয়ার ১৪টি খাতকে চিহ্নিত করেছে।

চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে হয়তো আরও ভালো অবস্থানে পৌঁছাবে বাংলাদেশের রেল। তাই বলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে এই অবস্থা থাকবে। একটা দেশের জন্য ৫০ বছর কি যথেষ্ট সময় নয়? জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে এসে রেলের এমন অবস্থাকে কি আসলেই উন্নয়ন বলা যায়? প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির লক্ষ যোজন দূরত্বকে উন্নয়ন বলবো?

রেলপথের নিয়মিত যাত্রীদের কাছেই ছেড়ে দিলাম এই হিসাব মেলানোর দায়িত্ব।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী