দুবলারচরে অতন্দ্র প্রহরী র‌্যাব, লোকালয় ছেড়ে যোজন যোজন দূরে

সিরাজুম সালেকীন, সুন্দরবন থেকে ফিরে
| আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২১, ১২:০১ | প্রকাশিত : ১৬ নভেম্বর ২০২১, ১০:০১

নোনাজল আর ঘন অরণ্য। লোকালয় থেকে বহুদূরে। যেখানে প্রাণ বলতে কেবল পশু-পাখি। খাবারের নেই সুব্যবস্থা। দূর-দূরান্ত থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হয় মাসকাবারি খাদ্য। মিঠাপানির জন্য কেবল একটা পুকুরই ভরসা। মোবাইল নেটওয়ার্ক কখনো আছে, কখনো নেই। জনজীবন বিচ্ছিন্ন সুন্দরবনের এমনই দুর্গম চরে অতন্দ্র প্রহরী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র‌্যাব) সদস্যরা।

সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করেছে র‌্যাব। কাজটি ছিল চ্যালেঞ্জিং, প্রায় অসাধ্য। কিন্তু বিশেষ এই বাহিনীর চৌকস নেতৃত্বে যা সম্ভব হয়েছে। এখন দস্যুমুক্ত ভূখন্ডকে রক্ষা করাও কম কষ্টসাধ্য নয়। নগরসভ্যতা থেকে যোজন যোজন দূরে পরিবার-পরিজন ছেড়ে সেই কষ্টসাধ্য কাজটিই করে যাচ্ছে র‌্যাব ও কোস্টগার্ড সদস্যরা।

সম্প্রতি দুবলারচরে সরেজমিনে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের প্রচেষ্টা। দুর্গম বনের এক চরে তাদের যাপিত জীবনের দুঃখ-দুর্দশা মুখে না বললেও সহসা ধরা পড়ে চোখে। হেমন্তের শেষ থেকে বসন্ত পর্যন্ত মৎস্যজীবীদের দেখা মেলে। যারা মাছধরা আর শুঁটকি ব্যবসাকে পেশা করে বেঁচে আছে যুগের পর যুগ। মূলত তাদের নির্বিঘ্ন পেশাজীবন নিশ্চিতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চরে পড়ে আছে আইনশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্যরা। কারণ একটা সময় জলদস্যুদের নৈরাজ্যে প্রাণ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারত কম সংখ্যক জেলেরা। সুন্দরবনের বাদাবন ছিল যেন এক মরণ ফাঁদ। যদিও এ সবই এখন অতীত।

অন্যদিকে সুন্দরবনে পর্যটকদের আনাগোনাও কমবেশি বছরজুড়েই। একটা সময় অপহরণ-হত্যার কথা প্রায়ই ভেসে আসতো নোনাপানির বন থেকে। এখন তেমনটি নেই বললেই চলে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দুর্গম এই ক্যাম্প ঘুরে ও র‌্যাব সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘আশ্রয় সেন্টার’ হিসেবে আমেরিকা সরকারের সহযোগিতায় ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানেই র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের ক্যাম্প। র‌্যাব সদস্যদের জন্য অন্য একটি ক্যাম্প থাকলেও তা ঝড়ে ভেঙে গেছে। তাই দুর্গম এই এলাকার নিরাপত্তা ও শান্তি বজায় রাখতে ভবনটিতে র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা একসঙ্গে থাকেন। সেখান থেকেই র‌্যাব সদস্যরা তাদের ‘টহল বোটে’ সুন্দরবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।

সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত হিসেবে ধরে রাখতে র‌্যাবের এসব সদস্য সব সময় কাজ করছেন। মোংলা ও শরণখোলা উপজেলার লোকালয় থেকে ৭৫ নটিক্যাল মাইল দূরের চরটিতে প্রতিবছর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ বা নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি তৈরির কাজ। বছরের বাকি সময় থাকে প্রাণহীন। এ সময় চরটিতে (দুবলারচর) বছরের বাকি আট মাস র‌্যাব ও কোস্টগার্ডের দুই ডজন সদস্য ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না। একজন ডিএডি’র নেতৃত্বে র‌্যাব সদস্যরা সেখানে দায়িত্ব পালন করেন।

কাঁটাতারে ঘেরা ক্যাম্পটিতে আছে একটি মিঠাপানির পুকুর। সেখানেই র‌্যাব সদস্যরা গোসল, কাপড় ধোয়া ও অন্যান্য কাজ করেন। আর ভবনটির নিচে সদস্যদের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্না করা হয়। চরে যখন জেলেদের আনাগোনা থাকে তখন স্থানীয় বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় বাজারঘাট করেন তারা।

মাহবুবুর রহমান র‌্যাবের একজন এসআই। বলেন, ‘আমরা র‌্যাব-৬ থেকে এই ক্যাম্পে এসেছি। এক মাস করে আমাদের এখানে ডিউটি থাকে। এরপর আবার অন্য টিম আসে। যেহেতু দুর্গম পথ তাই বিদ্যুৎ নেই। সোলার বা জেনারেটর ব্যবহার করতে হয়। তবে সেটাও বেশ কিছুদিন ধরে নষ্ট। বর্তমানে আমরা কোস্টগার্ডের জেনারেটর দিয়ে চলছি। তাছাড়া খুলনা থেকে আসার সময় আমরা খাবার পানি বোতলজাত করে নিয়ে আসি। তবে পানি শেষ হয়ে গেলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখা হয়। সেটাই খাওয়া হয়।’

শফিকুল ইসলাম নামের একজন র‌্যাব সদস্য মাছ কেটে পুকুরে ধুয়ে নিচ্ছিলেন। এসময় তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। শফিকুল জানান, তিনি তিন সপ্তাহ আগে চরের এই ক্যাম্পে এসেছেন। দুর্গম হওয়ায় প্রথম দিকে ভয়ে থাকতেন। তবে মাছ ধরার মৌসুম আসায় চরে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। এতে নিজের মনের ভয় কেটে গেছে।

তিনি জানান, স্থানীয় বাজার থেকেই তাদের প্রতিদিনের বাজার করা হয়। জেলে বা মৎস্যজীবীরাও তাদেরকে সম্মান করেন। কারণ, তাদের (র‌্যাব) কারণেই এই চরে দস্যুতা বন্ধ হয়েছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ বন্ধ হয়েছে।

র‌্যাব সদস্যরা জানান, দুর্গম পথ। মোংলা পোর্ট থেকে এখানে আসতে ছয়-সাত ঘন্টা সময় লাগে। সেখান থেকে কাঁচা শাক-সবজি আনলে ১০ দিনের মতো রাখা যায়। ফ্রিজ থাকলে আমরা সেখানে খাবার সংরক্ষণ করে রাখতে পারি। কারণ এখানকার সামুদ্রিক মাছ সব সময় খাওয়া যায় না, আবার ফ্রিজ না থাকলে সংরক্ষণও করে রাখা যায় না।

এলিট ফোর্সের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্গম এই অঞ্চলে টেলিটকের মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকলেও প্রতিমাসে দুই-তিন দিন বন্ধ থাকে। এসব টাওয়ার জেনারেটরের মাধ্যমে চালানো হয়। ফুয়েল বা তেল শেষ হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষকে জানানোর মতো কোনো সুযোগ থাকে না। তাই জেলা শহর থেকে তেল এনে পুরনায় চালু করতে দুই দিন লেগে যায়। এতে পরিবারের সদস্যরা সব সময় চিন্তায় থাকেন।

নজরুল ইসলাম নামে একজন র‌্যাব সদস্য ঢাকাটাইমসকে জানান, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ শুধুমাত্র টেলিটক সিমের মাধ্যমে সম্ভব। প্রায় প্রতিমাসে দুই-তিন দিন করে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ থাকে। দুবলারচরে যে নেটওয়ার্ক আছে, সেটা বন্ধ থাকলে আমাদের এই সমস্যার মুখে পড়তে হয়। সুন্দরবনের কটকা থেকে দুবলারচর, সেখান থেকে হিরণ পয়েন্টে নেটওয়ার্ক সংযোগ আছে। দুবলারচরে সমস্যা হলে কটকার লাইন সচল থাকে। তবে কটকায় সমস্যা হলে দুবলারচর ও হিরণ পয়েন্টের নেটওয়ার্ক অচল হয়ে যায়। দুর্গম এই চরের মোবাইল নেটওয়ার্ক সব সময় সচল রাখার দাবি জানান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই সদস্য।

সুন্দরবন ঘিরে র‌্যাবের দুটি অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। সবশেষ গত ২ নভেম্বর দুবলারচর ক্যাম্প পরিদর্শন করেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এডিজি, অপারেশনস) কর্নেল কে এম আজাদ। এসময় তিনি দুর্গম এই ক্যাম্পের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। তারাও এডিজির কাছে তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। পরদিন (৩ নভেম্বর) সদস্যদের সমস্যা সমাধানে র‌্যাবের আরেকটি দল ক্যাম্পটি পরিদর্শন করে।

একইদিন দুপুরে র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমে জানান, দস্যুমুক্ত সুন্দরবন ধরে রাখতে স্থায়ী দুটি ক্যাম্প পাচ্ছে এলিট ফোর্স র‌্যাব। এতে সুন্দরবনে র‌্যাবের সক্ষমতার পাশাপাশি নিয়মিত নজরদারি আরও বাড়বে। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনে র‌্যাবের দুটি অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা শিগগির দুটি ক্যাম্প পাবো। যার মাধ্যমে নিয়মিত নজরদারি করতে পারব। পাশাপাশি এখন সুন্দরবনে অনেক পর্যটক আসেন, জেলেরা মাছ ধরেন তারা আরও নিরাপদে সুন্দরবনে আসতে পারবেন এবং এটি তাদের জন্য অভয়ারণ্য হবে।’

র‌্যাবের হাত ধরে যেভাবে দস্যুমুক্ত সুন্দরবন

২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে র‌্যাব মহাপরিচালককে প্রধান সমন্বয়কারী করে সুন্দরবনের জলদস্যু দমনের টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে জলদস্যু মুক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। লিড এজেন্সি হিসেবে র‌্যাব ২০১২ সাল থেকে সুন্দরবনে জোরালো অভিযান পরিচালনা শুরু করে। অবশেষে র‌্যাবের তৎপরতায় ২০১৬ সালের ৩১ মে বিনাযুদ্ধে প্রথম দাপুটে জলদস্যু মাস্টার বাহিনী আত্মসমপর্ণ করে। বাকি দস্যুবাহিনীগুলো মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে, মাস্টার বাহিনীর সবাই র‌্যাবের হাতে মারা পড়বে। যখন মাস্টার বাহিনীর একটি লোকও মারা যায়নি বরং তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তখন বাকি দস্যুবাহিনীগুলো যোগাযোগ শুরু করে।

মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাহিনী একে একে আত্মসমপর্ণ করে। তারা নিজেদের অন্ধকার জীবন ফেলে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়। মোট ৩২টি দস্যুবাহিনীর মধ্যে সিংহভাগই র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখন সুন্দরবন আনুষ্ঠানিকভাবে দস্যুমুক্ত।

বর্তমানে আত্মসমর্পণকারী জলদস্যুরা পুনর্বাসিত হয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও র‌্যাবের পক্ষ থেকে সাবেক জলদস্যুদের প্রত্যেককে নগদ এক লাখ টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। এছাড়া আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের ঘর, দোকান, নৌকা, জাল ও গবাদিপশু হস্তান্তর করা হয়েছে, যা তাদের স্বাবলম্বী হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণকারী সব জলদস্যু ও বনদস্যুর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর ও গুরুতর অপরাধের (হত্যা ও ধর্ষণ) মামলা ছাড়া অন্যান্য সব সাধারণ মামলা সহানুভূতি সহকারে বিবেচনার বিষয়টি চলমান রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/১৬নভেম্বর/এসএস/এইচএফ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :