লিবিয়ায় ‘দালালদের নির্যাতনে’ মাদারীপুরের দুজনের মৃত্যু

প্রকাশ | ২২ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৪০

মাদারীপুর প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

লিবিয়ার অভিবাসী বন্দিশালায় দালালদের শারীরিক নির্যাতনে মাদারীপুরের দুই তরুণের মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই দুই তরুণ অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় অবস্থান করছিলেন। নিহত দুই তরুণের স্বজনেরা লিবিয়া থেকে তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হন। সোমবার সকালে নিহত দুজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পরিবারে চলছে মাতম।

নিহতরা হলেন- মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্য খাগদী এলাকার আবুল কালাম খানের ছেলে সাব্বির খান (২১) ও বড়াইলবাড়ি এলাকার হাবিবুর রহমান তালুকদারের ছেলে সাকিবুল হাসান ওরফে সুরুজ (২২)।

নিহত তরুণদের স্বজন ও পুলিশ বলছে, প্রায় দেড় মাস আগে স্থানীয় দালাল সবুজ মীরের মাধ্যমে আট লাখ টাকা চুক্তিতে লিবিয়া হয়ে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন সাকিবুল। চুক্তির অর্ধেক টাকা পরিশোধ হলেও বাকি টাকা ইতালি পৌঁছানোর পরে দেওয়ার কথা। তবে লিবিয়াতে পৌঁছানোর পরেই বাকি চার লাখ টাকা জন্য দালাল চক্র সাকিবুলকে একটি বন্দিশালায় আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন চালায়। পরে শনিবার রাতে দালালদের নির্যাতনে মারা যান সাকিবুল।

অন্যদিকে সাব্বির খান চরনাছনা এলাকার দালাল কাশেম মোড়লের মাধ্যমে সাড়ে সাত লাখ টাকার চুক্তিতে ছয় মাস আগে লিবিয়া পৌঁছান। এরপরে তাকেও লিবিয়ার বন্দিশালায় আটক রাখা হয়। টাকার জন্য তাকেও শারীরিক নির্যাতন চালায় দালালরা।

সোমবার সকালে সাব্বিরের বাড়ি মধ্য খাগদী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সারা বাড়িতে মানুষ। সবার চোখে পানি। বাড়ির আঙিনায় সাব্বিরের মা, ছোট দুই ভাই, এক বোনসহ স্বজনেরা আহাজারি করছেন। প্রতিবেশী কেউ কেউ তাদের সান্তনা দিচ্ছেন। পুরো বাড়িতে মাতম।

আহাজারি করতে করতে সাব্বিরের মা নাজমা বেগম বলেন, ‘রাইতে আমি বাড়ি ছিলাম না। মেলা রাইতে ভাইর বিডি (ভাইয়ের মেয়ে) হঠাৎ ফোন দিছে, ভাবছি মায় মইরা গেছে। বাড়িতে আইসা শুনি, আমার পোলা মইরা গেছে। হায় আল্লাহ আমার পোলারে তুমি ফিরাইয়া দাও। আমার পোলা এম্মে মরতে পারে না।’

সাব্বিরের এক চাচি জানালেন, স্থানীয় দালাল আতিবার, তোতা ও কাশেম ছয় মাস ধরে সাব্বিরকে লিবিয়া নিয়ে আটকে রাখছে। লবণ ছাড়া খালি ভাত এক বেলা খেতে দিয়েছে। এত কষ্ট সহ্য করছে, তবু ওরা সাব্বিরকে মেরে ফেলল।

সাব্বিরের খালু ওবায়দুর রহমান তালুকদার বলেন, ‘সাব্বিরের মাথায় ধারালো কিছু একটা দিয়ে আঘাত করছে। এ কারণে সাব্বির মারা গেছে। সাব্বিরের সঙ্গে যারা ছিল, ওরা আমাগো ফোনে ভিডিও কলে সব দেখাইছে। সাব্বিরের মৃত্যুর জন্য যে কয়জন দালাল দায়ী, আমরা তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।’

মধ্য খাগদী থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে বড়াইলবাড়ি। সকালে সাকিবুল হাসানের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো বাড়ি সুনসান। সাকিবুলের মা নেই। বৃদ্ধ বাবাও বয়সের ভারে ঘরবন্দী। তার বড় চার ভাইকে পাওয়া গেল বাড়িতে। ছোট ভাইয়ের মৃত্যুতে চার ভাই শোকাহত। কিন্তু ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর খবর বাবার কানে গেলে সে হয়তো সহ্য করতে পারবেন না। তাই সবাই নীরব।

সাকিবুলের মেজ ভাই আরিফুর রহমান বলেন, ‘ভাইডা বিএ পড়ত। পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য পাগল ছিল। তাই আমরা আর আটকাই নাই। দালালের সঙ্গে চুক্তি ছিল, লিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছালে অর্ধেক টাকা দিতে হবে। পরে ইতালি পৌঁছে দিতে হবে বাকি টাকা। বডি কন্ট্রাক্ট ছিল। কিন্তু গেম হওয়ার আগেই এভাবে যে মারা যাইবে, তা মানতে পারছি না। যারা আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী, আমরা তাদের বিচার চাই।’

মাদারীপুরে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে (অক্টোবর পর্যন্ত) মানব পাচার আইনে ৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এরপরেও দালালদের দৌরাত্ম্য কমছে না।

এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, লিবিয়াতে মাদারীপুরের দুজন মারা যাওয়ার খবর তারা শুনেছেন। তবে এখন পর্যন্ত নিহত তরুণদের পরিবার কোনো সহযোগিতার জন্য আসেনি। এরপরও নিহত ওই দুই পরিবারের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

মানবপাচার বন্ধে পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে এসপি গোলাম মোস্তফা বলেন, ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে মামলা বা অভিযোগ দিতে তেমন একটা আসে না। আবার যারা ইউরোপে যাচ্ছেন, জেনেশুনেই এই অবৈধ পথে যাচ্ছেন। তারা জানে প্রথমে লিবিয়া হয়ে যাবে। পরে সেখান থেকে সাগরে নৌকায় করে ইতালি ঝুঁকি নিয়ে যাবেন।

তিনি আরো বলেন, এখানে সচেতনতা বা প্রচারণা করেও লাভ নেই। কারণ, বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে ইতালি যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন, তারা বেশির ভাগ ইতালি পৌঁছে ভালো আছেন। দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এটা দেখে অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছেন। তাই তাদের ফেরানো যাচ্ছে না।

(ঢাকাটাইমস/২২নভেম্বর/এলএ)