আন্দোলনের জন্য কতটা প্রস্তুত বিএনপি?

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০২১, ০৯:২৬ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১১:৫৯

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

শুধু দলীয় কর্মসূচি নিয়ে এত দিন সময় পার করলেও সম্প্রতি নানা ইস্যুভিত্তিক দাবি নিয়ে মাঠে সক্রিয় বিএনপি। সবশেষ গুরুতর অসুস্থ দলীয় চেয়ারপারসনের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়ার অনুমতির দাবিতে দেশজুড়ে দফায় দফায় কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।

কর্মসূচি থেকে মাঠ পর্যায়ের নেতারা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার জন্য কঠোর আন্দোলনের দাবি তুলছেন। শীর্ষ নেতারাও আন্দোলনের দাবিতে সায় দিয়ে কর্মীদের প্রস্তুত হতে বলছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে- অতীতের মতো এবারও আন্দোলনের হুংকার দিয়ে তা বাস্তবায়নে কতটা প্রস্তুত এক যুগের বেশি ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি?

এদিকে বিএনপির নেতাদের হুংকারকে আমলে নিচ্ছে না সরকার। শুধু তাই নয়, আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে সরকারের তরফে।

এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে আলাপে আন্দোলন ডেকে নেতাদের মাঠে না থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। এবারের আন্দোলনে মাঠে না থাকলে নেতাদের কর্মীদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলেও মনে করছেন তৃণমূলের নেতারা। 

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখনো যেসব নেতা মাঠে নামবেন না, সেটা তাদের বেঈমানি হবে। কর্মীদের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আমি মনে করি মাঠের কর্মীরা প্রস্তুত। কিন্তু কর্মসূচি ডেকে মাঠে নেতারা থাকবেন কি না সেটা নিয়ে অনেকের সংশয় থাকতে পারে।’

চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবিতে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সামনে আমাদের কোনো পথ খোলা নেই। পথ একটাই- আন্দোলন আন্দোলন আন্দোলন।’

এর আগে গত শনিবার গণঅশন কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার শপথ করিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব। আন্দোলনে সফল না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফেরা যাবে না বলেও মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।

অন্যদিকে বিএনপির নেতাদের সরকার পতনের আন্দোলন নিয়ে আওয়ামী লীগের কিছু যায় আসে না বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘বিএনপি এক দফা অথবা দশ দফা আন্দোলন করুক, তাতে আওয়ামী লীগের কিছু যায় আসে না। আওয়ামী লীগ আন্দোলনে ভয় পায় না।’ বরং বিএনপি গত ১২ বছরে আন্দোলন করতে পারেনি, তারা এখনো পারবে না বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, বিএনপির আন্দোলন লিপ সার্ভিস আর ফেসবুকে।

বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কিছু দিন ধরে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার আলোচনা ছিল। তবে হঠাৎ বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আন্দোলনের গতিপথ কিছুটা বদলে গেছে। এই মুহূর্তে তাকে বিদেশে চিকিৎসা করানোর দাবি জোরদার করাই মুখ্য হয়ে উঠেছে বিএনপিতে। আগামীকাল এই দাবিতে সব জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেবে দলটি।

একই সঙ্গে দল এবং অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও চলবে বিএনপির। দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে কিছুদিন আগে ঢাকা মহানগরে নতুন কমিটি দেয়া হয়েছে। কিছু জেলা কমিটিও করা হচ্ছে। ছাত্রদল ছাড়া বাকি অঙ্গসংগঠনের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ইউনিটের কমিটি হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ওয়ার্ড থেকে থানা সব পর্যায়ে দ্রুত কমিটি কীভাবে করা যায় সে নিয়ে কাজ করছি। সবই আন্দোলন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে। সেখানে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে।’

বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে আমরা ভবিষ্যতে কী করব। কিন্তু এখন চেয়ারপারসনের জীবন বাঁচানোর জন্য যা যা করণীয় তা-ই করতে হবে। সেভাবে সব পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে আন্দোলন ছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তনের সম্ভাবনাও খুব কম।’

২০১৪ সালে 'দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাও আন্দোলন' এবং পরের বছর সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজপথের জোরালো আন্দোলন থেকে এক রকম সরে আসে দলটি। পরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিলেও সেখানে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়নি।

এমনকি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া কিংবা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও দলটি রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। এ সময় তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে প্রাধান্য দেয়।

তবে দলটির তরুণ ও অধিকাংশ নেতা মনে করছেন, এ ধরনের শান্তিপূর্ণ আর নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দিয়ে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

বিএনপির তরুণ নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন এক অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা আমাদের নেত্রীর সুচিকিৎসার জন্য যে আন্দোলন করছি সেটার ফল পেতে চাই। আপনারা আপনাদের কাঁথা-বালিশ নিয়ে তৈরি হন, বাড়ির কথা ভুলে যান, রাস্তায় স্থায়ীভাবে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেন। তাহলে আন্দোলনে সফল হব।’

আরেক তরুণ নেতা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু নেতাদের হুঁশিয়ারি করে বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনে রক্ত দিতে হবে। তাকে বাঁচাতে না পারলে রাজনীতি করার কারো অধিকার থাকবে না।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা টইমসকে বলেন, ‘সরকার খালেদা জিয়াকে তিলে তিলে মারতে চায়। কিন্তু তার মুক্তি ও বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে তার অনুসারীরা জীবন ও রক্ত দিতে প্রস্তুত। দাবি পূরণে যত সময় যাবে তত কর্মসূচির ধরন বদলাবে। ঘরে ফেরার সুযোগ নেই।’

দুর্নীতির মামলায় দ- নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার পর পরিবারের আবেদনে গত বছরের ২৫ মার্চ নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। তবে তাতে শর্ত ছিল, তাকে দেশেই থাকতে হবে।

মুক্তির পর থেকে খালেদা জিয়া বাসায় থাকলেও করোনা আক্রান্ত হলে এ বছরের মাঝামাঝি তিনি প্রায় দুই মাস হাসাপাতালে চিকিৎসা নেন। এর চার মাসের মাথায় আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল তাকে। ২৬ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাসায় ফেরার পাঁচ দিন পর গত ১৩ নভেম্বর তাকে পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এর আগে কয়েকবার প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর তাকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে গত ১১ নভেম্বর ভাই শামীম এস্কান্দার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, যেহেতু দন্ড স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেহেতু তাকে এখন বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার সুযোগ আইনে নেই। তিনি যদি কারাগারে ফিরে গিয়ে নতুন করে আবেদন করেন, সরকার তখন তা বিবেচনা করতে পারে।

এদিকে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে তার কিছু করার নেই। এটা এখন আইনের ব্যাপার। তিনি বরং প্রশ্ন তুলেন, খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দেওয়া হচ্ছে, চিকিৎসা করতে দেওয়া হচ্ছে এটাই বেশি নয় কি না।

আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে দেওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই।

 (ঢাকাটাইমস/২৩নভেম্বর/মোআ)