ক্রীড়া খাতের সংস্কার ও ক্রীড়া কমিশন গঠন প্রসঙ্গে

এ এস এম আলী কবীর
 | প্রকাশিত : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১৪:০৫

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিভিন্ন বিষয়ে দেশে নানা ধরনের অনেক কমিশন গঠিত হয়েছে। এর কোনো কোনোটি স্থায়ী, কোনোটি সরকারি সংস্থার মতো। আবার অধিকাংশই জাতীয় কোনো ইস্যু নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অস্থায়ী কোনো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির ন্যায় যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে তাদের সুপারিশ পেশ করে তাদের কর্ম সম্পন্ন করে থাকে। স্থায়ী কমিশনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন, দুদক, পরিকল্পনা কমিশন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আর অস্থায়ী কমিশনের মধ্যে বেতন কমিশন, আদমশুমারি কমিশন ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়।

অস্থায়ী কমিশনগুলোর অধিকাংশই নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য বা বিষয়ে মতামত/সুপারিশ প্রদানের জন্য গঠন করা হয়ে থাকে। ওদের মধ্যে রয়েছে নানা তদন্ত কমিশন ও বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারমূলক কমিশন। এগুলোর মেয়াদ সর্বনিম্ন ৩ মাস হতে সর্বোচ্চ ১ বছরের পর্যন্ত হতে পারে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষা কমিশন, বেতন কমিশন, আদমশুমারি কমিশন থেকে শুরু করে ছোট-বড় অনেক রকম কমিশন গঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে কয়েকটি চাকরি ও বেতন কমিশন, একাধিক আদমশুমারি (Census) কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু ব্যাপক গণদাবির মুখে এখন পর্যন্ত একবারও জাতীয় ক্রীড়া কমিশন গঠিত হয়নি। অথচ ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমূল সংস্কারের দাবি বহুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। এই আমূল সংস্কার একটি জাতীয় কমিশনের সুপারিশ ছাড়া করা সম্ভব নয়।

আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে, ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার ও পরিবর্তন ছাড়া খেলাধুলায় প্রার্থিত মানোন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

ক্রীড়ায় দেশবাসীর প্রত্যাশা বাস্তবতা

দেশের খেলাধুলা থেকে জনগণের প্রত্যাশা অনেক, প্রায় গগন চুম্বট। তারা যেকোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের জন্য স্বর্ণ প্রত্যাশা করে। কিন্তু এই স্বর্ণপদক অর্জনের জন্য কি কি করতে হবে সে সম্পর্কে জনগণের কোনো ধারণা নেই। এমনকি অধিকাংশ ক্রীড়া সংগঠক/কর্মকর্তা এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।

কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস আমরা আন্তর্জাতিক ক্রীড়ার আসরে দেশের খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ সাফল্য কামনা করলেও এ জন্য যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও অর্থ ব্যয় করতে রাজি নই। আমরা প্রায় কেউই বুঝতে চাই না যে, খেলাধুলার জন্য ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি করা ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ক্রীড়ায় অগ্রসর পৃথিবীর অন্যান্য দেশকে অনুসরণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

ক্রীড়ায় ঈপ্সিত সাফল্য অর্জন করতে চাইলে দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ও সংস্কার করতে হবে। এই পরিবর্তন ও সংস্কার কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে এবং প্রতিটি ভাগকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এই বিভাগগুলো হতে পারে নিম্নরূপ:

১) ক্রীড়া পরিকাঠামো: দেশের সরকার সমর্থিত ছোট ও দুর্বল ক্রীড়া সহায়ক সংগঠক যথা- জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, বিকেএসপি ও ক্রীড়া পরিদপ্তরকে একীভূত করে ভারতের স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (ঝঅও) আদলে একটি একক ও শক্তিশালী সরকারি ক্রীড়া সহায়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। দেশের ৮টি বিভাগে এর সেন্টার ও ৬৪টি জেলায় সাব-সেন্টার থাকবে এবং সকল উপজেলা লেভেল পর্যন্ত এর কার্যালয় থাকবে।

২) ক্রীড়া অবকাঠামো: একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তার আওতায় দেশের ক্রীড়া অবকাঠামো ও সুবিধাদি নির্মাণ করতে হবে। এই মহাপরিকল্পনার বাইরে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র ক্রীড়া সুবিধা নির্মাণ করে দেশের জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা নষ্ট করা যাবে না।

৩) ক্রীড়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ: দেশের ক্রীড়ার জন্য বাজেট বরাদ্দ বর্তমানে প্রয়োজনের তুলানায় অপ্রতুল। এটিকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। এক সময় বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেট শুরু হয়েছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা দিয়ে। এখন সেই বার্ষিক বাজেটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লক্ষ কোটি+ টাকায়। কিন্তু বার্ষিক বাজেটের তুলনায় দেশের ক্রীড়া বাজেট তেমন বৃদ্ধি পায়নি। ক্রীড়া বাজেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি না পেলে সাংবাৎসরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা এবং বৈদেশিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে দেশের খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণের মতো ব্যয়বহুল কর্মসূচিগুলো অধরাই থেকে যাবে। তাই বাৎসরিক রাজস্ব বাজেটের ১% এবং উন্নয়ন বাজেটেরও ১% যুব ও ক্রীড়া খাতে ব্যয় করার বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। কারণ আমাদের খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্তির পাশাপাশি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ও বৈশ্বিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলো আয়োজনের কথাও আমাদের ভাবতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।

৪) ক্রীড়া উন্নয়নের জন্য আইনি কাঠামো বৃদ্ধি: বর্তমানে ক্রীড়া খাতে জাতীয় সংসদে পাস করা একটি মাত্র আইন রয়েছে। এটি হচ্ছে ১৯৭৪ সালের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আইন । এটিও ঠিক ক্রীড়া সহায়ক আইন নয়, এটি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা সংক্রান্ত আইন। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (ইকঝচ) প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা সংক্রান্ত একটি আইন রয়েছে। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই ক্রীড়ার মানোন্নয়ন বা সার্বিকভাবে ক্রীড়া সহায়ক আইন নয়। তাই ক্রীড়া খাতে বহুমুখী তৎপরতায় সহযোগিতা প্রদান করার জন্য বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন:

ক) জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনসমূহ প্রতিষ্ঠা পরিচালনা, অর্থায়ন ও নির্বাচন আইন;

খ) স্থানীয় সরকার (বিভাগ, জেলা ও উপজেলা) ক্রীড়া সংস্থা আইন;

গ) ক্রীড়া খাতে আর্থিক ও অন্যবিধ সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত আইন;

ঘ) বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়াবিদ কোটায় চাকরি প্রদান সংক্রান্ত আইন;

ঙ) ক্রীড়াবিদ কল্যাণ তহবিল ও পেনশন আইন;

চ) সরকারি ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ক্রীড়া খাতে আর্থিক সহায়তা প্রদান আইন;

ছ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া সুবিধাদি ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আইন;

জ) ক্রীড়া সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ক্লাব প্রতিষ্ঠা এবং নিবন্ধন আইন।

জাতীয় ক্রীড়া সংস্কার কমিশন

দেশে ক্রীড়ার মানোন্নয়ন সবাই চান। বহু বছর এ নিয়ে প্রচুর আলাপ-আলোচনা এবং সেমিনার-ওয়ার্কশপ-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাস্তব অগ্রগতির কোঠা শূন্য না হলেও উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।

এখানেই একটি জাতীয় ক্রীড়া কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। কারণ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এ সম্পকির্ত মতামত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কখনোই হবে না। কিন্তু সরকার যদি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে দেন, তাদের সুপারিশ সবাই মেনে নেবেন বলেই মনে হয়। সর্বাগ্রে সেই সুপারিশগুলো সরকারের কাছেই পেশ করা হবে বলে সেগুলো সরকারের বিবেচনা, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রশ্ন আসবে যে দায়িত্ব দেশের অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করতে পারে না।

অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠান অনূর্ধ্ব ১০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। দেশের বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক, ঊর্ধ্বতন ক্রীড়া কর্মকর্তা, বিশিষ্ট ক্রীড়া প্রশিক্ষক, বিচারক, ক্রীড়া লেখক/সাংবাদিক ও বিচারকদের মধ্য হতে ১ জন করে সদস্য নিয়ে কমিশনটি গঠিত হতে পারে। কমিশনের আয়ুষ্কাল হবে ৬ মাস। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কমিশনকে সাচিবিক সহায়তাসহ সকল সহায়তা প্রদান করবেন।

কমিশন সরকারের নিকট তাদের সুপারিশসহ রিপোর্ট পেশ করবেন। সরকার এটি বিবেচনা করে অনধিক ৬ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও আদেশ জারি করার ব্যবস্থা গ্রহণসহ কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবেন।

সরকার প্রয়োজন মনে করলে কমিশনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করার আগে এগুলোর ওপর জনসাধারণের অভিমত গ্রহণ করবেন।

আশা করা যায় যে, এমন একটি কমিশন গঠন করে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে তা দেশের ক্রীড়ার মানোন্নয়নে সহায়ক হবে, একটি ক্রীড়াবান্ধব জাতি গঠনের অন্তরায়গুলো দূরীভূত হবে এবং সর্বোপরি দেশের ক্রীড়ার আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়ার পথ খুলে যাবে।

লেখক: চেয়ারম্যান (সরকারের সচিব) জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সভাপতি বাংলাদেশ এথলেটিকস ফেডারেশন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :