ডার্কওয়েবে অর্ডারে দেশে প্রথম আমদানি

এলএসডি উদ্ধারে গিয়ে মিলল আরও ভয়ানক ‘ডিওবি’

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০২১, ২২:২৬ | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২১, ২২:৪১

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, এক ব্যবসায়ীর কাছে এলএসডি মাদক আছে। এই এলএসডি ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারে খুলনায় অভিযান চালান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। একজনের কাছে কিছু এলএসডি উদ্ধারের পর অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দারা। আর এতেই দেশে প্রথমবারের মতো 'ক' শ্রেণির মাদক ডাইমেথক্সি ব্রোমোঅ্যামফেটামাইন-ডিওবি (Dimethoxy bromoamphetamine-DOB) সন্ধান মিলল। উদ্ধার করা হয় ৯০ ব্লটার ডিওবি। এসব মাদক ডার্কওয়েবে অর্ডার করে দেশে আনা হয়েছিল।

মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকসেবীদের কাছে প্রতি ব্লট (পিস) ডিওবি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এই মাদক সেবনে তৃতীয় নয়ন খুলে যায় বলে দাবি সেবীদের। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ক্যামিকেল বিশেষজ্ঞরা জানান, ডিওবি সেবন করার পর সেবনকারীকে যেকোনোভাবে প্রভাবিত করা যায়। ফলে সেবনকারী নির্দেশিত কাজ করতে উদ্যমী হয়ে ওঠেন। এরজন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করতে হয়। বেশি পরিমাণে সেবন করলে মৃত্যু ঘটতে পারে।

এই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তারা হলেন- আসিফ আহমেদ শুভ ও তার বন্ধু অর্ণব কুমার শর্মা। এছাড়া সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের খুলনা বয়রা বাজার শাখার ম্যানেজার মামুনুর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খুলনায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।  

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, এই ডিওবি আমাদের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত নিষিদ্ধ মাদক। ডিওবি অনেকটা এলএসডির মতো দেখতে হলেও ডিওবি আরও বেশি ক্ষতিকর। অতিরিক্ত সেবনে মৃত্যুও হতে পারে।

পোল্যান্ড থেকে শুভর বাসায় ডিওবি পার্সেল

মাদক কেনার জন্য ডার্ক ওয়েবসাইট থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে ২০০ ব্লট ডিওবি কেনেন খুলনার যুবক আসিফ আহমেদ শুভ। অর্ডার করার পর ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চালানটি সরাসরি তার বাসায় পৌঁছায়।

মাদকের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, বিমানবন্দরগুলোতে উন্নতমানের স্ক্যানার না থাকায় কুরিয়ারে আসা ডিওবি ধরা পড়েনি। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে এই মাদক অর্ডার করার পর এক মাসের ব্যবধানে শুভর বাসায় কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে যায়।

স্ক্যানারে ধরা না পড়লেও বিদেশ থেকে এলএসডির মতো মাদক আসতে পারে এই ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য ছিল। গত আগস্ট মাসে কি-ওয়ার্ড ‘syash’ শব্দটি পান গোয়েন্দারা। এরপর চলে অনুসন্ধান। তিন মাসের বেশি সময় অনুসন্ধান করার পর এই মাদকের সন্ধান মিলেছে বলে জানিয়েছেন মাদক ঢাকা মেট্রো উত্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান।

তিনি বলেন, বিমানবন্দরগুলোতে শক্তিশালী স্ক্যানার নেই, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের নজরদারি ছিল। নজরদারি থাকার কারণে এই মাদক আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি।

ডিওবির ক্রেতা খুলনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

গ্রেপ্তারের সময় শুভর বাসায় এলএসডি পাওয়া যায় আর অর্ণবের বাসায় পাওয়া যায় ডিওবি। পোল্যান্ড থেকে কিনে ডিওবির ব্লটগুলো (প্রতিপিস) অর্ণবের বাসায় রাখেন শুভ।

জিজ্ঞাসাবাদে শুভ জানান, তিনি দুমাস আগে ২০ ব্লট ডিওবি নিয়ে আসে। যেগুলো তিনি নিজে সেবন করতেন এবং সেবীদের কাছে বিক্রি করতেন। নতুন ক্রেতা তৈরি করতে কিছু ব্লট বিনামূল্যেও দিয়েছেন তিনি।

অভিযানে থাকা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন বলেন, শুভ পোল্যান্ড থেকে দুই শতাধিক ডিওবি এনেছিলেন। আমরা অভিযানের সময় তার কাছে পেয়েছি ৯০টি। বাকিগুলো বিক্রি ও সেবন করেছে।

খুলনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ডিওবি বিক্রির জন্য শুভর সেলার রয়েছে বলে জানান হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫-৬ জন সেলার আছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে একজন সেলার। 

এলএসডি ও ডিওবি পাচারে জড়িত কুরিয়ার সার্ভিস কর্মকর্তা

খুলনা থেকে মাদক ব্যবসায়ী দুজনের সঙ্গে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস খুলনা বয়রা শাখার ম্যানেজার মামুনুর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পার্সেল পাঠাতেন।

গোপনে ক্রেতা সেজে পাঁচ ব্লট এলএসডির অর্ডার করেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। খুলনা থেকে কোনো বাধা ছাড়াই রাজধানী এলিফেন্ট রোড সুন্দরবন শাখায় পার্সেলটি পৌঁছায়।

প্রযুক্তির সহায়তায় প্রেরক শুভর সন্ধান পান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তবে যিনি পার্সেলটি পাঠিয়েছেন তার মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র রাখেননি খুলনা বয়রা শাখার দায়িত্বশীলরা। আর তা করা হয়নি মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মামুনুর রশীদের যোগসাজসের কারণে।

মাদ দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, নিয়মানুয়ী প্রেরকের মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র রাখার কথা কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হয়নি।

কাগজের পাতায় এলএসডি পার্সেলের বিশেষ চেম্বার

ঢাকা থেকে অর্ডার করা এলএসডির পার্সেলটি পৌঁছানোর পর গোয়েন্দারা ওই পার্সেলে খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কোথায় রাখা হয়েছে এলএসডি। কারণ যে পার্সেলে এলএসডি পাঠানো হয়েছে, তাতে এসেছে কয়েকটি পেজ। যার মধ্যে কোথাও এলএসডির ব্লট নেই।

তবে এই পেইজগুলো অধিকতর যাচাই বাছাই করার পর একটি পেইজে বিশেষ চেম্বার খুঁজে পান কর্মকর্তারা। যার মধ্যে পাঁচ ব্লট এলএসডি লুকানো ছিল। কাগজের পাতার মতো পাতলা এবং সিম কার্ডের মতো ছোট হওয়া ওই বিশেষ চেম্বারে লুকানো ছিল এলএসডির ব্লটগুলো।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা পার্সেলটি পাওয়ার পর হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ এর মধ্যে এলএসডি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওরা কয়েকটি পেইজ পাঠিয়েছিল। যেগুলো একটিতে বিশেষ চেম্বার করে এলএসডি লুকানো ছিল।

বিমানবন্দর এবং কুরিয়ার সার্ভিসগুলো উন্নতমানের স্ক্যানার থাকলে এ ধরনের মাদক দেশে পৌঁছার পর বিমানবন্দরেই ধরা পড়তো।

মাদকের অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, বিমানবন্দর এবং কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে উন্নত স্ক্যানারে স্থাপনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানিয়েছে। দেশে মাত্র একটি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের স্ক্যানার রয়েছে। বাকিদের কাছে যেধরণের স্ক্যানার আছে, তা দিয়ে এ ধরণের মাদক ধরা পড়ে না।

(ঢাকাটাইমস/২৩নভেম্বর/এসএস/ইএস)