বৈষম্য-নির্যাতন এবং প্রতিবন্ধী নারী

প্রকাশ | ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১২:২০

এনাম আহমেদ

আমাদের দেশের নারীরা এখনও বিভিন্ন শৃঙ্খলের মাঝে বেড়ে ওঠে। লিঙ্গ বৈষম্য সমাজ থেকে এখনও দূর করা সম্ভব হয়নি। ফলে নারীদের অনেকক্ষেত্রেই অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার হতে হয়। তবে সুস্থ ও স্বাভাবিক নারীদের চেয়ে আরো করুণ অবস্থা আমাদের প্রতিবন্ধী নারীদের। তারা পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি পদে বৈষম্য এবং বিভিন্ন ঘটনার শিকার হচ্ছেন। প্রতিবন্ধিতার কারণে একে তো তাদের জীবনযাপন অনিশ্চয়তায় কাটছে। অন্যদিকে তাদের প্রতিবন্ধিতাকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ। চালাচ্ছে তাদের উপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন।

 

স্ত্রূমতে, ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী দেশে প্রতিবন্ধি নারীর সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ (১২ মিলিয়ন)। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারীই দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। কেবলমাত্র ১ শতাংশ বা এরও কম সংখ্যক প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

গত বছরের ২৩ নভেম্বর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এসডিজি ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারনীতির আলোকে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় এ গবেষণা করা হয়। গবেষণার জন্য পাঁচ হাজার প্রতিবন্ধীর ওপর জরিপ চালানো হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ হাজার জনের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ নারী ও মেয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ১০ দশমিক ৩ শতাংশ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। প্রতিবন্ধী মেয়েদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৪ শতাংশের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়েছে।

এর আগে ২০১৫ সালে করা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর অপর একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, দেশের শতকরা ৭৮ ভাগ প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়ে শিশু যৌন ও শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয় শুধুমাত্র বাধা দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত বলে। এদের মধ্যে আবার ১৮ ভাগ প্রতিবন্ধী নারী বারংবার নির্যাতনে শিকার হয়।

প্রতিবন্ধী নারীদের সামাজিক অবস্থানঃ বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে নারীরা স্বাভাবিক সমস্যার পাশাপাশি অনেকক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক এবং সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে সহিংস ঘটনার শিকার হচ্ছে। ফলে তাদের জীবনযাপনে আরো বেশি বিপর্যয় নেমে আসছে। সহিংস ঘটনার শিকার হয়েছে এমন প্রতিবন্ধীদের ঘটনার দিকে যদি তাকাই আমরা দেখতে পারবো-

ঘটনা-১ঃ বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কামারপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী কিশোরী শাম্মী। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের শিকার হন। ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে শাম্মী’র বাবা রাজমিস্ত্রি শামীম সরকার জানান, তার মেয়ে জন্ম থেকেই বুদ্ধি ও শারীরিক দুই ধরণের প্রতিবন্ধকতাতেই আক্রান্ত। শুধুমাত্র একটি হাত আর একটি পায়ে পূর্ণ শক্তি পায় শাম্মী। ঘটনার দিন তাদের পাশের বাসায় এক দম্পতির কলহ চলছিল। চিৎকার চেচামেচি শুনে শাম্মী সেখানে যায়। এরপর ফেরার পথে একই গ্রামের জালাল উদ্দিন ছেলে ২৩ বছর বয়সী নিপু তার মেয়েকে ধর্ষণ করে। পরে ঐ দিনই থানায় মামলা করা হলেও আসামী গ্রেফতার হয় ৬ মাস পর। গ্রেফতারের ৩ মাস পর আসামী জামিনে মুক্ত হয়। ধর্ষক এখন জামিনে আছে। তিনি জানান, তাদের মামলাটা কচ্চপ গতিতে এগোচ্ছে। এখন স্বাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বছরে দুটি করে মামলার তারিখ দেয়া হচ্ছে। গত অক্টোবরের ২৭ তারিখে তাদের মামলার শেষ তারিখ ছিলো। পরবর্তী তারিখ দেয়া হয়েছে ২০২২ সালের ১৩ মার্চ। ধর্ষিতার বাবা শামীম সরকার আরো জানান, সম্প্রতি দুর্ঘটনায় মেয়েটি চলাচলে সক্ষম পা’টিও ভেঙে গেছে। যার কারণে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হচ্ছে শাম্মীকে। গত ২ মাস আগে তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর মেয়ের জন্য একটি হুইল চেয়ারের আবেদন করলেও এখনও পাননি।

ঘটনা-২ঃ বগুড়ার সদর উপজেলার সাবগ্রাম ইউনিয়নের প্রতিবন্ধী নারী আতিয়া আক্তার কনা। অজ্ঞাত রোগে তার এক পা বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে ১০ বছর আগে। এর আগে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। ঐ ইউনিয়নের জিগাতলা গ্রামের এক যুবকের সাথে কনা’র বিয়ে হয় ২০১১ সালে। বিয়ের সময় কনা’র বাবা যৌতুক হিসেবে ৬ লাখ টাকা দেন ছেলের পরিবারকে। বিয়ের পর সব কিছু ভালোই চলছিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই কনা’র একটি পায়ে সমস্যা দেখা দেয়ায় ঠিকমত হাঁটা চলা করতে পারে না। ফলে অসুবিধা হয় কাজকর্ম করতেও। প্রতিবন্ধী হওয়ার পর কনা’র সাথে তার শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের আচরণও পরিবর্তন হতে শুরু করে। এক সময় প্রতিনিয়তই তাকে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের কাছে কটু কথা শুনতে হয়। শুধুমাত্র প্রতিবন্ধিতার কারণেই গর্ভবতী অবস্থায় কনাকে তার স্বামী ডিভোর্স দেয়। ৮ বছরের মেয়েকে নিয়ে কনার জীবন এখন অনিশ্চয়তার মাঝে কাটছে।

সাম্প্রতিক ঘটনাঃ  চলতি বছরের জুলাইয়ে গাজীপুরের টঙ্গীতে এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়। তিনজন ধর্ষক যুবক ঐ প্রতিবন্ধী কিশোরীর ভাইয়ের বন্ধু হওয়ার সুবাদে তারা কিশোরীর বাড়িতে যাওয়া আসা করতো। এর এক পর্যায়ে ধর্ষকরা কিশোরীকে রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোর কথা বলে টঙ্গীর বড়দেওরা এলাকার একটি ফাঁকা বাসা নিয়ে মুখ চেপে ধর্ষণ করে। এরপর কিশোরীকে রিকশায় তুলে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। ঘটনা জানার পর পরিবার থেকে টঙ্গী পশ্চিম থানায় মামলা করলে পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত রফিকুল, মনিরুল ও নাঈম নামের তিনজনকে গ্রেফতার করে। এছাড়া চলতি বছরের আগস্টে নওগাঁর ধামইরহাটে প্রতিবন্ধী গৃহবধূ এবং সেপ্টেম্বরে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে এক গৃহবধূ ধর্ষণের শিকার হয়।

প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার এবং তাদের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে উইমেন উইথ ডিজএ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ)। প্রতিবন্ধী নারীর প্রতি সহিংসতা এবং বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি জানান, প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য যে বিচার ব্যবস্থা সেটা আমার মনে হয় যথেষ্ট না। মামলা যেগুলো করা হয়েছে দেখা গেছে সেগুলোর অধিকাংশই কখনই তারা বিচার পায়নি। কারণ মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা। অধিকাংশ মামলা দেখেছি ১ যুগ বা দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে। আর নির্যাতনের শিকার প্রতিবন্ধী নারীদের বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের। এই পরিবারগুলোর কিন্তু ১ যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে মামলা চালানো সম্ভব হয় না। আমরা চাই দ্রুত বিচারের জন্য যেমন স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন বা এসিড দগ্ধদের জন্য। প্রতিবন্ধী নারীদের জন্যও যদি এরকম স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুযোগ বা নির্দেশনা দিতো আইনে মাধ্যমে তাহলে কিন্তু প্রতিবন্ধী নারীরা কিন্তু বিচার পেত। এছাড়া  আমরা সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় যেটা আবেদন করেছি, সেটা হলো নারী ও নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল যে আইন আছে সেই আইনে প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য বিশে একটি অধ্যায় সংযুক্ত করার।  যেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের বিচার প্রক্রিয়াটা কেমন হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করা। ঘটনার শিকার হয়ে মামলা করার পর প্রায়ক্ষেত্রে দেখা যায় বাকপ্রতিবন্ধী নারী যদি আদালতে যান সেখানে আইনজীবী বা বিচারককে ঠিকমত তার সমস্যার কথা বোঝাতে পারছেন না। এক্ষেত্রে বিচারক রায়’ই বা কিভাবে দেবে। যে কারণে আমাদের দাবী আইনে যদি লেখা থাকতো বাকশ্রবণ প্রতিবন্ধী হয় তাহলে ইশারা ভাষা থাকবে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের স্বাক্ষ্যগ্রহণের সময় তাদের পরিবারের সদস্যদের সংযুক্ত করতে হবে।

প্রতিবন্ধী নারীদের জীবনমান উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলেন, জাতীয় বাজেট যখন ঘোষণা করা হবে তখন বাজেটটা যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। আমরা দেখি বাজেটের একটা বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় শিক্ষাখাতে। এই অংশের মধ্যে যদি ১০% বা ১৫% যদি শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তির জন্য হয় তাহলে প্রতিবন্ধীরা  নির্বিঘ্নে তাদের শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে। আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখি সেখানো সরকারের থোক বরাদ্দ থাকে জাতীয় বাজেট থেকে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধীরা এখনও হুইল চেয়ার নিয়ে প্রবেশের সময় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এছাড়া প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য আলাদা উপকরণ দরকার হয়।  উপকরণের ক্ষেত্রে বলতে একজন স্বাভাবিক মানুষ যে বইটি পড়তে পারে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিন্তু সেই বইটি পড়তে পারছে না। সেক্ষেত্রে তাকে কিন্তু ডিজিটাল টকিং বই বা ব্রেইন বই পড়তে হচ্ছে। এই যে উপকরণ এটা তো একটু ভিন্ন। এরকম ভিন্ন উপকরণের জন্য এই বাজেটটা বরাদ্দ হবে। এছাড়া যাতায়াত খাতে যে বরাদ্দ হবে সেখান থেকেও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১০% প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হবে। মোট কথা আমরা চাই প্রতিরক্ষা খাত বাদ দিয়ে অন্যান্য সবখাতেই প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রাখলে প্রতিবন্ধীদের জন্য আসলেই কিছু করা হবে।

 লেখক : সাংবাদিক