চিকিৎসক সমাজ, আন্দোলন ও শহীদ ডা. মিলন

প্রকাশ | ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০৯:০৩

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ

প্রতি বছর ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশে শহীদ ডা. মিলন দিবস পালিত হয়। ১৯৯০ সালের এই দিনে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন নিহত হন। এই শোকাবহ ঘটনার স্মরণে ১৯৯১ সাল থেকে শহীদ ডা. মিলন দিবস পালিত হয়ে আসছে। ডা. মিলনের মধ্য দিয়ে তখনকার স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। পরের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পতন ঘটে এরশাদ সরকারের।

হাজারো সংগ্রাম, অসংখ্য আত্মত্যাগ ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত সুপরিচিত চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় ঐতিহাসিক সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। চিকিৎসক ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, মুমূর্ষু মানুষের সেবায় সদাব্যস্ত এ সংগঠনের সদস্যরা। এ দেশের মানুষের কাছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পথিকৃৎ বিএমএ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ঢাকা মেডিক্যালের পাশে সুউচ্চ শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, ৬৯-এর গণ আন্দোলন এবং ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এ সংগঠনের সংগ্রামী সেনারা নির্ভীক আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রক্তদানকারী চিকিৎসকরা দেশের স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ের বড় অংশীদার। সেই গৌরবময় ইতিহাস ও পূর্বসূরিদের অনুপ্রেরণায় ডা. শামসুল আলম খান মিলনসহ আমরা সেই বিএমএর সদস্য হতে পেরে সত্যিই গর্বিত।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্র উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দেশের ছাত্র-যুবক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ সব পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তে জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। এরই ধারাবাহিকতা চলে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় ও পুরো আশির দশক।

১৯৯০ সালে ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সব মতের, পেশার মানুষ। লক্ষ্য একটাই- ‘স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রের উত্তরণ’। তাই ঢাকা শহর সে সময় পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ২৩ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচারের দোসর ডা. জাফরুল্লাহ গংদের সহায়তায় ১৯৯০ সালে জনগণের ওপর টিক্কা খান সরকারের মতো চাপিয়ে দেওয়া হয় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে অন্য সব পেশাজীবির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনকে আরো বেগবান করে।

অতঃপর এলো ২৭ নভেম্বর ১৯৯০। সারা দেশে স্বৈরাচার সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা দেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যায়লয়) চলছিল বিএমএ আহূত চিকিৎসক সমাবেশ। এতে যোগদানের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে রিকশাযোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশে যাত্রা করেন তৎকালীন বিএমএর মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও যুগ্ম-সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন।

পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমকালে তাদের রিকশা লক্ষ্য করে গুলি চালায় সামরিক জান্তার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা। বুকে গুলি লেগে রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. মিলন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে রিকশায় করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে। সেখানে জরুরি চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে। সবাইকে কাঁদিয়ে তার প্রিয় মেডিক্যাল কলেজেই শহীদের বেশে তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। এই কলেজেই তিনি পড়েছেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে, পড়িয়েছেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে।

ডা. মিলন শহীদ হওয়ার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান হয় এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। সার্থক হয় মিলনের আত্মদান।

শহীদ ডা. মিলন এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম। ১৯৫৭ সালের ২৯ জানুয়ারি বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেন তিনি। ঢাকা মেডিক্যালে ইন্টার্নশিপ চলাকালীন তিনি ইন্টার্ন চিকিৎসক সংগঠনের আহ্বায়ক হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন বিএমএ নির্বাচনে মিলন যুগ্ম-সম্পাদক ও আমি দপ্তর সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। সেই থেকে একই সঙ্গে সংগঠনের হয়ে কাজ করতাম। দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে আমরা নির্বাচিত হলেও বিএমএর কাজে বা পেশাগত কোনো বিষয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। একে-অপরের সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে পেশার জন্য অটল থেকে কাজ করেছি। চিকিৎসকদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি, যা তার নির্বাচিত হয়ে আসা থেকেই প্রতীয়মান হয়।

১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিএমএর বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি ও  স্বৈরশাসকের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদে সব চিকিৎসক সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। তখন মঞ্চ থেকে নেমে আমি আর মিলন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ওই সময় বিবিসি রেডিও থেকে টেলিফোনে বিএমএ নেতাদের একটি সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসি রেডিওতে আমার যে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়, তাতে মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয় কথা বলতে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন।

শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ২৭তম শাহাদাত বার্ষিকীতে আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। তিনি ছিলেন একজন সমাজসচেতন মানুষ। এদেশের হাজার হাজার চিকিৎসকের প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল।

মাঝেমধ্যে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বয়স আজ ২৯ বছর। ডা. মিলন যে আদর্শ ধারণ করে, যে লক্ষ্য সামনে রেখে সংগ্রাম করতে করতে আত্মাহুতি দিয়েছেন, অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিন মেয়াদে দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার তার অনেকটাই বাস্তবায়ন করেছে। ইতিমধ্যে গণমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১২ প্রণয়ন, ১৩৬২ আইএসটি শিক্ষক-চিকিৎসকদের চাকরি নিয়মিত করা, ডিপিসির মাধ্যমে হাজার হাজার চিকিৎসক-শিক্ষক-কর্মকর্তার পদোন্নতি, নতুন নতুন পদ ও বিভাগ সৃষ্টি, বেকার চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি, উচ্চতর ও উন্নত চিকিৎসা শিক্ষার প্রসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ চট্টগ্রাম-রাজশাহীতে আরো দুটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ, নতুন নতুন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বিশেষায়িত মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট-নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিশু-মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা এর মধ্যে অন্যতম।

বলা যায়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে। সম্প্রতি সরকার সব জনগণের জন্য স্বাস্থ্যবীমা ও মেডিক্যাল হেলথ কার্ড প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সার্বিক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে নতুন জাতীয় ঔষধ নীতিও প্রণয়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান আরো বৃদ্ধির লক্ষ্যে অচিরেই জাতীয় অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড কাজ করবে।

ডা. মিলন দিবসে প্রত্যাশা- বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োজিত প্রায় ২৫ হাজার চিকিৎসক কর্মকর্তার সঙ্গে অন্যান্য পেশার বা ক্যাডারের মধ্যে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করবে। কর্মস্থলে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান প্রয়োজন ও চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণসহ স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন। তাতে গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট উন্নত চিকিৎসাসেবা আরও সহজলভ্য ও সম্প্রসারিত হবে। মিলনের বিদেহী আত্মা শান্তিতে থাকুক, এই কামনা নিরন্তর।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়