থামছে না রেলের অনিয়ম-দুর্নীতি

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৫৪

দুর্নীতি দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে নানা পদক্ষেপ নিলেও কিছুতেই যেন থামানো যাচ্ছে না রেলওয়ের দুর্নীতি। নানা অনিয়মের তদন্তে দোষী প্রমাণিত হয়েও থাকছেন বহাল তবিয়তে বা দুর্নীতির মামলায় জেল খেটেও আবার আসীন হয়েছেন স্বপদে, এমন ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। আবার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন এমন একজন যিনি প্রমাণিত অপরাধী।

মাঝে-মধ্যে দুয়েকজনের হালকা-পাতলা শাস্তি হলেও এটাকে আইওয়াশ হিসেবেই দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় অনিয়ম বন্ধের সকল প্রচেষ্টাই যেন ভেস্তে যাচ্ছে। তবে দোষীদের ছাড় না দেওয়ার বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রীর কঠোর হুশিয়ারিকে গতানুগতিকও বলছেন তাঁরা। সঠিক বিচার না হওয়ায় মন্ত্রনালয় থেকে নথি গায়েব করারও দুঃসাস দেখিয়েছেন কেউ।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রথম ঢেউয়ে সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির ঘটনায় রেলওয়ে পুর্বাঞ্চলের ২৯ কর্মকর্তার অনিয়মের সাথে জড়িত থেকে অতিরিক্ত সরকারি অর্থ খরচ করার প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। তবে অপরাধের মাত্রা বেশি হওয়ায় ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার আগ্রহ প্রকাশ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ওই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ অফিসারদেরই শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।

দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ২১ জনের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপা.) সরদার সাহাদাত আলী, পূর্বাঞ্চলের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) রুহুল কাদের আজাদ, অতিরিক্ত সিসিএস মো. আনোয়ারুল ইসলাম বর্তমানে ইনভেন্ট্রি কন্ট্রোল সেলের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান, এসিওপিএস সাহেব উদ্দিন, মজিবুল হক, এসিসিএম আর খায়রুল করিম, বর্তমানে সহকারী ট্রাফিক সুপারিন্টেন্ডেন্ট (টিকেট চেকিং) মো. এমদাদুর রহমান, মো. জাহিদ হাসান, মো. মারুফ, প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ফারজানা উম্মে খানম, গৌতম কুমার কুন্ড, সুকেন্দ্রনাথ হালদার, মহিউদ্দিন আহমেদ, কাজী নাজিম উদ্দিন, ফাতেমা আক্তার, মো. রাহিদ হোসেন ও ফরিদ আহমেদের নাম। তবে কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে অভিযুক্ত ২১ কর্মকর্তাকে গোপনে অব্যাহতি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দেশের বাইরে থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে গত ৩০ আগস্ট এক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম সহ্য করি না। করোনা সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রিপোর্টও পেয়েছি। এসব নথিপত্র গায়েব হতে পারে না। আমি বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। নথি গায়েব হলে সংশ্লিষ্ট কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ আর যদি সত্যি সত্যিই কেউ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে তবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি এস এম নাজের হোছাইন বলেন, দুর্নীতির লাগাম টানতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী একথা যেমন সত্য, দুর্নীতির মাত্রা দিনকে দিন চরম পর্যায়ে পৌছেছে এটাও তেমন সত্য। আমাদের মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা এবং আমলারা এমন সুন্দর করে বক্তব্য দেন, তাতে মনে হয় দেশে যেন কোনো অনিয়ম নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রমোশনের সময় তাদের নামটাই আগে চলে আসে।

এস এম নাজের হোছাইন বলেন, প্রকৃত অপরাধীর বিচার না হওয়ায় তারা দিনের পর দিন আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রত্যেক অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে শাস্তির বদলে পুরস্কৃত করা হয় বলে অপরাধে উৎসাহী হয়ে ওঠে।

এসব ব্যপারে কথা বলতে রেলের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদারের মোবাইলে ফোন ও বার্তা দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

গত বছর করোনা সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির জন্য পূর্বাঞ্চল রেলের ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে রেলওয়ের তদন্ত কমিটি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে গত বছরের ৫ নভেম্বর রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। প্রকৃত মূল্যর চেয়ে বেশি দরে কেনাকাটার প্রমাণ পেয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এপ্রিল-মে’তে কেনাকাটায় ৭৭৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকার থার্মোমিটার ১২ হাজার ৩০০ টাকা, আট টাকার গ্ল্যাভস ৩২ টাকায়, ১০ টাকার মিনি সাবান ২৫ টাকায়, ১২০ টাকা কেজির ডিটারজেন্ট ১৮৮ টাকায়, ১২০ টাকা কেজির ব্লিচিং পাউডার ১৯৩ টাকায়, ১৩০ টাকার হেক্সিসল ৩৮৪ টাকায়, ১২০ টাকার প্লাস্টিক চশমা ৩৯৭ টাকায়, ১৫০ থেকে ৪০০ টাকার চীনের তৈরি কেএন-৯৫ মাস্ক ৭২৭ টাকায় এবং ট্রলি ও ফ্লুমিটারসহ প্রতিটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হয় ৪১ হাজার টাকায়।

কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলে অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো এবং প্রতিযোগিতামূলক দর পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে তা না করে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।

এছাড়া সুপারিশে বলা হয়, সিসিএস দফতর ও সিওএস দফতরের ২৯ কর্মকর্তা ক্রয় কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যেমন সত্য, উচ্চমূল্যে কেনাকাটার বিষয়টিও প্রমাণিত। কমিটি ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করে ভবিষ্যতে তাদের এ ধরনের কেনাকাটার কাজ না দেয়ার সুপারিশ করেছে।

কিন্তু অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাতো নেওয়া হয়নি বরং এই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কিছুদিন পরে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রেলওয়ের যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান ফারুকীকে বদলি করা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/৩০নভেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :