এইডস প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

সুব্রত বিশ্বাস (শুভ্র)
 | প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৪৩

আজ ১ ডিসেম্বর সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব এইডস দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর বিশ্ব এইডস দিবস পালন করা হয়। এই রোগ সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন করার জন্যই দিনটি পালন করা হয়। এইডস বা এইচআইভি ‘মানব প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস’ নামক ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট একটি রোগলক্ষণসমষ্টি, যা মানুষের দেহে রোগ-প্রতিরোধের ক্ষমতা বা প্রতিরক্ষা হ্রাস করে।

১৯৮৮ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক এইডস সোসাইটি এবং সে বছরই ১ ডিসেম্বরকে বিশ্ব এইডস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে দিবসটি পালনের সূচনা। প্রতি বছর বিশ্ব এইডস দিবসের একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ হয়ে থাকে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো- ‘Ending the HIV Epidemic: Equitable Access, Everyone’s Voice.’

এইডস (অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিয়েন্সি সিনড্রোম) হলো এক ধরনের ভাইরাস দ্বারা গঠিত রোগ। এই রোগ এইচআইভি নামক ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। এইচআইভি একটি ভাইরাস যা মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। তাছাড়া ভাইরাসটি রক্তের সাদা কোষ (শে^তকণিকা) নষ্ট করে দেয়, যার ফলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে পড়ে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হওয়ার চূড়ান্ত পরিণতি হলো এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়া। তবে এইচআইভি এবং এইডস কিন্তু একই বিষয় নয়। এইচআইভি একটি ভাইরাস এবং এইডস একটি অসুস্থতা, যা এইচআইভির কারণে হয়।

এইচআইভি সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই এইডস হয় না। শুরুতে ক্ষেত্রবিশেষ ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় উপসর্গ দেখা যেতে পারে। এরপর বহু দিন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। এইচআইভি ভাইরাসের আক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্র দুর্বল হতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণ সংক্রমক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। এমনকি সংক্রামক ব্যাধি বা টিউমারের শিকারও হতে পারেন, যেগুলো কেবল সেসব লোকেরই হয় যাদের দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ করে না। এইচআইভি সংক্রমণের এই পর্যায়কে এইডস বলা হয়।

এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীই কোনো লক্ষণ ছাড়া এই রোগ বহন করে। তবে কখনো কখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ৬ থেকে ৭ সপ্তাহ পরে কিছু কিছু নির্দষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন- জ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যাথা, মুখের অভ্যন্তরে ঘা, দীর্ঘমেয়াদি কাশি, স্বাস্থ্যের অবনতি, লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠা ইত্যাদি। এসব লক্ষণ কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সেরে যায়, যার কারণে রোগী এই ভাইরাস সম্পর্কে বুঝতে পারেন না। এইচআইভি ভাইরাস কোনো রকম লক্ষণ ছাড়াই সর্বোচ্ছ ১০ বছর মানুষের শরীরে বাস করতে পারে।

বর্তমানে এইডস একটি ভয়াবহ রোগ হিসেবে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক হয়ে আছে। সর্বপ্রথম ১৯৮১ সালে আমেরিকায় এই রোগ শনাক্ত হয়। ১৯৮৫ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রক্ত পরিসঞ্চালনের আগে রক্তে এইচআইভি ভাইরাস জীবাণুমুক্ত কি না স্ক্রিনিং করে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল রক্ত সরবরাহ করার পরামর্শ দেয়। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য ছিল একসময়, তখন এই রোগকে ঘাতক রোগ বলা হতো।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, মানবদেহে বিভিন্নভাবে এইডস রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা বীর্য বা জরায়ু রসের সংগে যদি সুস্থ কোনো ব্যক্তির রক্ত, শরীর রস বা মিউকাস আবরণের সংস্পর্শ ঘটে, তাহলে এইচআইভি তথা এইডস রোগের বিস্তার ঘটে। এসব সংস্পর্শ নানাভাবে ঘটতে পারে। যেমন- কনডম ব্যবহার না করে অবাধ যৌন সহবাস, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত শরীরে ধারণ বা গ্রহণ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা দাঁতের চিকিৎসা বা অপারেশনসহ আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহার। এমনকি সংক্রমিত গর্ভবতী নারী থেকে শিশুর দেহে পর্যন্ত এ রোগ ছড়াতে পারে।

এইডস রোধকল্পে উন্নত দেশসহ তৃতীয় বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিকারের বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলে এইডসের ছোবল থেকে মানুষ মুক্ত থাকতে পারবে নিশ্চিত। যেমন- অবাধ যৌনাচার থেকে বিরত, নিরাপদ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, যৌনমিলনের ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহার নিশ্চিত করা, রক্ত সংগ্রহের আর্গে রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষা করা, গর্ভাবস্থায় মায়ের এইডস ছিল কি না তা পরীক্ষা করা, সূচ-সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা, মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা, এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারমাধ্যমকে সক্রিয় করা।

এইচআইভি নামক ভাইরাস সর্বপ্রথম আমেরিকায় বিজ্ঞানীদের কাছে ধরা পড়লেও রোগটি আফ্রিকা থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়। এইডসের বিস্তার ইতিমধ্যে মহামারি রূপ নিয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন দেশ ভারত, মিয়ানমার ও নেপালে ইতিমধ্যে এইডস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনো মৃদু আক্রান্তের দেশ হিসেবে বিবেচিত, তথাপি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমারে এ রোগের দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। সেই হিসাবে বাংলাদেশও ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ জন ব্যক্তি এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত, আর ঝুঁকিতে আছে আরো প্রায় ১৫ হাজার জন।

এইডস থেকে নিজেকে, সমাজকে এবং মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। এজন্য ব্যক্তিসচেতনতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা আমাদের আবাসভূমি নতুন প্রজন্মের জন্য সব ধরনের রোগব্যাধি থেকে মুক্ত রাখব, এই হোক আগামী দিনের জন্য অঙ্গীকার।

লেখক: সমন্বয়ক, মিডিয়া সেল টু ভাইস-চ্যান্সেলর। কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :