পুলিশের ভুল তথ্যে ‘নিরপরাধ রাকিব’ কারাগারে!

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:১১

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের রাথুরা গ্রামের বাসিন্দা রাকিব (২৫)। মাদকের একটি ‘মিথ্যা মামলায়’ গত ২২ দিন ধরে তিনি জেল হাজতে। পরিচয় না থাকা আসামির খোঁজ নিতে গিয়ে ভুল তথ্য দেয় পুলিশ। ফলে নিরপরাধ রাকিব হয়ে যান সেই মামলার আসামি। বুধবার সকালে এমন অভিযোগ করেন রাকিবের বাবা-মা ও তার গ্রামবাসী।

রাকিবের বাড়িতে শুনসান নীরবতা। গত ২২ দিন ধরে তার পরিবারের কারো নাওয়া-খাওয়া নেই। পুরো বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। মনে হবে এ যেন একটা ‘মরা বাড়ি’।

রাকিবের মা রাহিমা বেগম(৪০) বার বার ছেলের কথা বলে মুর্ছা যাচ্ছে। তার ছেলে স্থানীয় বিভিন্ন পোল্ট্রি ফার্ম থেকে মুরগী নিয়ে উত্তরায় দোকানে দোকানে দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু মিথ্যা মামলায় ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন সে ওই মামলায় জেলখানায়। আমার ছেলে গ্রামে কারও কোনো ক্ষতি করে নাই। তবে কেন আমার ছেলেকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হলো? আমার ছেলের মুক্তি চাই।

রাকিবের বাবা পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী আক্তার হোসেন। তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, রাকিব আমার একমাত্র ছেলে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছি। এখন সে লেখাপড়ার পাশাপাশি পিকআপ দিয়ে পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবসা করে।

মামলার বরাত দিয়ে আক্তার হোসেন জানান, চলতি বছরের ২৭ আগস্ট গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ২০৩ পিস ক্যান বিয়ারসহ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের রাথুরা গ্রামের সাইজউদ্দিনের ছেলে শহিদুল্লাহকে (৩২) আটক করে। পরে পুলিশ ধৃত আসামি শহিদুল্লাহর জবানবন্দি অনুযায়ী ওই ঘটনায় পরদিন ২৮ আগস্ট ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ওবায়দুর রহমান বাদী হয়ে শহিদুল্লাহ তার ছোট ভাই আশরাফুলসহ রাকিব ও রুবেল নাম উল্লেখ করে কালীগঞ্জ থানায় একটি মাদক মামলা করেন। তবে মামলায় রাকিব ও রুবেলের বাবার নাম অজ্ঞাত ছিল।

ওই মামলায় ডিবি পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগে আসামিদের পূর্ণাঙ্গ নাম ঠিকানা যাচাই-বাছাই করার জন্য কালীগঞ্জ থানায় একটি অনুসন্ধান স্লিপ পাঠায়। পরে কালীগঞ্জ থানার পক্ষ থেকে ওই অনুসন্ধান স্লিপ নিয়ে উলুখোলা পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ-পরিদর্শক মুকুল তালুকদার তদন্ত করে রাকিবের বাবার নাম আক্তার উল্লেখ করে পাঠিয়ে দেন এবং মামলার আরেক আসামি রুবেলকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আক্তার হোসেন বলেন, নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে আমরা জানতে পারি আমার ছেলে ওই মামলার আসামি। পরে সরল মনে ছেলেকে নিয়ে আমরা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে গেলে আদালত আমার ছেলেকে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২২ দিন ধরে জেলে আছে। আমি আমার নির্দোষ ছেলের মুক্তি চাই।

ওই মামলার ২ নম্বর আসামি রাথুরা গ্রামের সাইজউদ্দিনের ছেলে মো. আশরাফুল বলেন, ঘটনার দিন আমাদের সঙ্গে এই ঘটনায় আক্তার কাকার ছেলে রাকিব জড়িত না। আমাদের সঙ্গে যে রাকিব জড়িত ছিল সে আমার বন্ধু, তার বাড়ি পাড়াবর্তা (নাওটান) গ্রামে এবং বাবার নাম তাইজউদ্দিন তাজু।

গলান বাজারের ব্যবসায়ী ও রাথুরা গ্রামের বাসিন্দা মহসিন শেখ জানান, রাকিব মূলত এই ধরনের ছেলে নয়। সে মাদক কারবার তো দূরের কথা, মাদক সেবনও করে না। আমরা জানি সে পিকআপ দিয়ে উত্তরা এলাকায় পোল্ট্রি মুরগির ব্যবসা করেন। একই কথা বলেন ওই গ্রামের বাসিন্দা আরেক মুদি দোকানি রাশেদ মিয়া।

রাথুরা দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা জালাল হোসেন বলেন, আমি ১১ বছর ধরে এই মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন করছি। রাকিবের নামে এই ধরনের কথা কখনো শুনিনি। সে খুবই নম্র, ভদ্র ও শান্ত ছেলে। রাস্তা-ঘাটে মুরব্বিদের দেখলে সালাম-কালাম দেয়। একই কথা বলেন রাথুরা গ্রামের সুরুজ মিয়ার স্ত্রী হালিমা বেগম।

ওই গ্রামের বাসিন্দা রাথুরা মোল্লাবাড়ী জামে মসজিদের সহ-সভাপতি ষাটোর্ধ হাজী আব্দুল বাতেন জানান, ছেলেটি খুব ভাল। নামের সঙ্গে মিল থাকায় বিনা দোষে জেল খাটছে। এখন সে জেলে থাকায় তার ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে। একই কথা বলেন ওই গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ জালাল মিয়া, সানাউল্লাহ, ষাটোর্ধ মাধু মিয়া, পঁচিশোর্ধ হাবিবুর রহমান ও পাড়াবর্তা গ্রামের রাকিব মিয়া।

কালীগঞ্জ থানার পক্ষে আসামিদের নাম ঠিকানা যাচাই-বাছাইকারী পুলিশ কর্মকর্তা মুকুল তালুকদার বর্তমানে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) কোনাবাড়ী থানায় কর্মরত আছেন। তিনি মুঠোফোনে জানান, আমি মাত্র এক মাস কালীগঞ্জ থানার উলুখোলা ফাঁড়ির অধীনে কাজ করেছি। আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নাম-ঠিকানা পাঠিয়েছি।

মামলার বাদী গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, আমি মামলায় চারজনের নাম দিলেও শহিদুল্লাহ এবং আশরাফুলের বাবার নাম উল্লেখ করেছি। তবে রাকিব ও রুবেলের বাবার নাম জানতে না পারায় অজ্ঞাত রেখেছি। পরে ওই মামলা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. বদিউজ্জামান তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই বদিউজ্জামান বলেন, এখানে আমার কিছু করার নেই। আমরা ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান স্লিপ পাঠিয়ে কালীগঞ্জ থানা পুলিশের সহায়তায় পূর্ণাঙ্গ নাম নিয়েছি এবং মামলায় রুবেল নামে এক আসামির সম্পৃক্ততা না থাকায় তাকে অব্যাহতি দিয়ে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি।

কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান বলেন, মূলত যাকে তদন্ত করতে পাঠাই, সে তদন্ত করে দিলে আমি শুধু স্বাক্ষর করি। আমার পক্ষে যাচাই-বাছাই করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে সেটা দুঃখজনক।

গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমির হোসেন বলেন, মূলত আমরা অনুসন্ধান স্লিপের মাধ্যমে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। অজ্ঞাত হিসেবে নাম দেওয়ার পর কালীগঞ্জ থানা পুলিশ বাবার নাম উল্লেখ করে আমাদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে আমার সন্দেহ হলে আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে বাই ফোনে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত করতে বলি। পরে তিনি ফোনে ওভার কনফার্ম করেন। তবে এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে এটা অনাকাঙ্ক্ষিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

(ঢাকাটাইমস/১ডিসেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :