বঙ্গবন্ধু এক অতিমানবীয় সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রবাদ পুরুষ

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, পিপিএম
 | প্রকাশিত : ০২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:০৯

প্রায় ১৪ বছর জেল-জুলুম অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। মাত্র ২৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনযাত্রায় সারা পৃথিবীর শোষিত-বঞ্চিত, অসহায়, নিপীড়িত, নির্যাতিত স্বাধীনতাকামী মানুষের আবেগ অনুভূতি আর বিপ্লবী চেতনাকে নিজের অন্তরে ধারণ করে হয়ে উঠেছেন বিশ্বনেতা। এরই মধ্যে শত্রুপক্ষের মৃত্যুগহ্বরে বসে থেকে নিজের জাতিকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান অর্জন করিয়ে মাত্র ৯ মাসের আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার বিরল ইতিহাস গড়েছেন। এই গৌরব বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো বিশ্বনেতার নেই। সেই সাথে, সময়ের সেরা পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনীর কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছিল পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম লিখিত আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।

সারা বিশ্বের রাজধানী শহর আর ক্যান্টনমেন্টগুলো প্রকম্পিত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক দিনটিতে। মুহূর্তের মধ্যে সারা পৃথিবীর আকাশে এমনতর বৈদ্যুতিক চমক, মহাকালের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ঘটেনি। যে তরঙ্গের আলোকশক্তি চুম্বকশক্তিতে পরিণত হয়েছিল সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের চেতনায়, যা প্রেষণার উৎস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জাতীয়তাবাদী যুদ্ধের অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছিল।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পরিস্থিতি বিবেচনায় সে সময়টা এমন ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে প্রথম বিশ্বের নেতৃস্থানীয়রা সবাই দাঁড়িয়ে পড়তেন, যেমনটা আমরা লক্ষ করে থাকি জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনকালে স্বভাবজাতভাবেই মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান করে। তেমনি করে, বঙ্গবন্ধুর নাম শ্রবণে সেসময় বিশ্বনেতাদের সামনে যেন তাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হতো, আর নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন সবাই। ব্যক্তিত্বের এতটা সম্মোহনী শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আর একজন রাজনৈতিক মানুষের আগমন হয়েছে কি না, সেই ইতিহাস আমাদের জানা নেই।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কোনো অধিবেশনে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রয়োজনে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করতেন না বঙ্গবন্ধু। স্পষ্ট কথাটি বলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অবিস্মরণীয় ভাবমূর্তি। ওষুধ নির্মাণের মেধাস্বত্বকে অস্বীকার করে তিনি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে নিজের জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করে জাতিসংঘের উন্নত দেশগুলোকে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আমার দেশ দারিদ্র্যের কষাঘাতে পেটের অন্ন জোগাতে যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন তাদের চিকিৎসা ব্যযয়ের জন্য উচ্চমূল্যে তোমাদের কাছ থেকে ওষুধ কেনার সামর্থ্য আমাদের নেই। কাজেই আমার দেশ তার সামর্থ্য অনুযায়ী ওষুধ উৎপাদন করবে।

এমন বক্তব্য উপস্থাপনের পরপরই বিশ্বের হতদরিদ্র দেশগুলোর নেতারা সবাই এসে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন। ফলশ্রুতিতে আজকের বাংলাদেশ নিজের ওষুধ উৎপাদন শুরু করেছিল এবং বিশ্বের ৬৭টি দেশে আজ ওষুধ রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের জ্যোতির্ময় প্রখরতা এতটাই উচ্চমার্গীয় ছিল যে, উন্নত বিশ্বের নেতারাও তখন এমন প্রসঙ্গগুলোর বিরোধিতা করতে রীতিমতো চমকে উঠতেন। বঙ্গবন্ধুর অতিমানবীয় ব্যক্তিত্বের প্রাসঙ্গিক একটি আলোচনায় বর্তমান দুই বাংলার সঙ্গীতাঙ্গনের অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ কবীর সুমনের (সুমন চট্টোপাধ্যায়) একটি সাক্ষাৎকার থেকে আমরা খানিকটা মিলিয়ে নিতে পারি।

২০১৮ সালে ‘সময় সংবাদ’-এর কলকাতার প্রতিনিধি সুব্রত আচার্যের নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-

"বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারও নেতা। আমি কিন্তু ভারতের নাগরিক হিসেবেই এটা বলছি। উনি কিন্তু শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতা নন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন তিনি ছাড়া পেলেন, পরে যেদিন কলকাতা বিমানবন্দরে তার বিমান নামল, সেদিন বিমানবন্দর থেকে রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছিল তার বক্তব্য।

‘তিনি যখন বললেন- "আমি শেখ মুজিবুর রহমান বলছি " তখন আমি ও আমার বাবা-মা তিনজনই শুনছিলাম এবং ঐ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। ওনাকে কখনও সরাসরি চোখে দেখিনি। তিনি আজও আমার নেতা। একবার যদি তাকে দেখতে পেতাম! ৭ মার্চের যে ভাষণ, সেটা আমার জাতির ভাষণ। শুনেছি হাজার বছরের জাতি আমাদের। এটি ছিল আমাদের বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীনতার উচ্চারণ। আমার গর্ব, আমার আত্মপরিচয়, আমার জাতীয় পরিচয় ঐখানে। এই ব্যাপারে আমি আপোষহীন। এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জায়গাটা আমাদের গর্বের বিষয়।

`এই যে আমি গান করি, সেটাও কিন্তু তারই একটা প্রভাব। আমিও বঙ্গবন্ধুর মত ওভাবে একা উঠে দাঁড়িয়ে একদিন একটা গান করব, বুক চিতিয়ে বাংলা গান গাইব, যা আমি কোনোদিন দেখিনি গ্রামের বাইরে। আবদুল আলিম গাইতেন নির্মলেন্দু চৌধুরীর কথায়, গিরীণ চক্রবর্তী ওভাবে বুক চিতিয়ে গেয়ে গেছেন- 'তোরা সব জয়ধ্বণী কর'।

`আজকালকার প্রজন্ম মিনমিনে কণ্ঠে গান করে। বঙ্গবন্ধু মিনমিনে লোকের নেতা নন। তিনি একটা লড়াকু জাতির নেতা, যে জাতি শান্তি ভালোবাসে, শান্ত থাকতে জানে, আবার লড়তেও জানে। আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর এটাই পরিচয়।

`আমি রাজনীতির মানুষ নই, তাই তার রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু বলতেও পারি না। কিন্তু, আমি ঐটুকু জানি আমরা তিনজন মানুষ সেদিন দাঁড়িয়ে উঠেছিলাম কাঁদতে কাঁদতে। আমি ও আমার বড়ভাই ভেবেছিলাম তখন বাংলাদেশ চলে যাব শুধুমাত্র সেই একটি ভাষণের জোরে। ’

হৃদয়ের গহিনে ধারণ না করলে কাউকে নিয়ে এভাবে বলা যায় না। বঙ্গবন্ধু প্রকৃতই সেই একটি মাত্র মানুষ, যার অতিমানবীয় সন্মোহনী শক্তির বিস্তার একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখাকে নির্দ্বিধায় অতিক্রম করে অনায়াসে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র বিশ্বে। পৃথিবীর তৎকালীন ও তৎপরবর্তী প্রায় সব প্রান্তের অনুসরণযোগ্য বিশ্বনেতারা এবং অন্যান্য বহু অঙ্গনের সুপ্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমন আবেগ বারবার প্রকাশ করে গেছেন।

পৃথিবীর যেকোনো সীমানায় বাস করা প্রতিটি বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তিনিই অবিভক্ত বাঙালি জাতিসত্তার প্রকৃত আত্মপরিচয়। সমাজের যেকোনো পেশার, যেকোনো পরিচয়ের প্রত্যেক মানুষের কাছেই বঙ্গবন্ধু চিরকালীন অজেয় সত্তার এক অবিকল্প প্রতিরূপ। যোগ্যতায়, নেতৃত্বে, বিপ্লবে, মননে, আদর্শে, চেতনায়, উদারতায় ও সাফল্যে তিনি পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন একটি নক্ষত্র, যার প্রকাশে সভ্যতার স্মরণকালের প্রায় সব সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্বনেতার সব জাগতিক মহিমা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে।

লেখক: পুলিশ সুপার, প্রাবন্ধিক ও কণ্ঠশিল্পী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :