পিতার চোখের মণি

একটি উপস্থাপিত স্বপ্ন প্রস্তাবনার পরিকল্পিত মৃত্যুর কথা উঠে আসবে এখন। শুরুটা ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ বাতিল করে সবার জন্য শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং একটি গণমুখী, বিজ্ঞানমনস্ক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রসমাজ অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সে সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। ইতিহাস জানায়, তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বেগবান করেছিল ওই আন্দোলনকে। তাকে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল সে সময়, কারাভোগ ছয় মাসের বেশি সময়।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা শেখ ফজলুল হক মণি শুধু ছাত্র অধিকার নিয়েই কাজ করেছেন বিষয়টা তেমন নয়। বরং রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভেবেছেন, লিখেছেন আইডিয়া আকারে এবং তা দেখিয়েছেন জাতির পিতাকে, এমন সাক্ষ্যই দেয় বিভিন্ন দলিল।

কীভাবে রাজনীতিতে এলেন শেখ ফজলুল হক মণি? আসলে তিনি রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে ভাবতেন, বলতেন, জন্ম দিতেন নতুন নতুন আইডিয়ার। জহরত চিনতে তো খাটি জহুরির ভুল হবার কথা নয়, জাতির পিতাও ভুল করেননি।

বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগম স্বামীর চাকরিসূত্রে কলকাতায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় থাকাকালীন অধিকাংশ সময় এই বোনের বাড়িতে থাকতেন। সেই সূত্রে শেখ মণির মেধা ও মননের সাথে পরিচয় ঘটে বঙ্গবন্ধুর। একদিন তিনি আছিয়া বেগমকে বললেন, “বুজি, তোমার মণিকে আমারে দাও, ও রাজনীতি করুক।”

আছিয়া বেগমও আপত্তি করেননি। যে ছেলেটি লিখতেন কবিতা, ছোটগল্প, তার হাতে ১৯৬০ এল দক্ষিণ এশিয়ার সবচে বড় সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। পর পর দুই মেয়াদে তিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছাত্রলীগের। ছাত্রদের মননে রোপণ করেছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন, যা তিনি দেখেছিলেন পিতা মুজিবের চোখে।

তখন দেশে যুদ্ধ চলছে। চলছে নানাদেশীয় ষড়যন্ত্র। মুক্তিপাগল যোদ্ধাদের আবেগ তো আর কিনে নেয়া যায় না, তাই ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্য ছিল দেশপাগল মানুষগুলোকে বিভ্রান্ত করা। তা ঠেকাতে প্রকাশ্যে আসে মুজিববাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। তার সাথি হয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদের মতো নেতারা। তাদের বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিটি পদক্ষেপের কারণেই বিভ্রান্ত করা যায়নি দেশের জন্য জীবনবাজি রাখা মহাত্মাদের।

শেখ ফজলুল হক মণির রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় মুগ্ধ বঙ্গবন্ধু দেশকে বঞ্চিত করতে চাননি এমন আইডিয়াবাজ নেতৃত্ব থেকে। এদিকে ছাত্রসংগঠনে থাকার বয়সও যে নেই তার। সদ্য স্বাধীন দেশের বিভিন্ন সমস্যাসঙ্কুল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াতে মণিকে দরকার। দরকার তার একটা টিম। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন যুবলীগ গঠনের।

পরাধীন দেশের ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি যখন স্বাধীন দেশের একটি যুব সংগঠনের নেতৃত্ব কাঁধে নিলেন, তখন প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। চারদিকে যুদ্ধের ক্ষত, পরাজিত শক্তিরা বিভিন্ন প্রচারণায় মত্ত। সদ্য স্বাধীন দেশের যুবসমাজ নানাবিধ হতাশায় ভুগবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই প্রেক্ষাপটে যুবসমাজের চোখে দেশ পুনর্নির্মাণের স্বপ্ন পুঁতে দেয়ার এক ব্রত নিয়ে নামলেন শেখ ফজলুল হক মণি। বোঝালেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যুবসমাজের দায়ের কথা।

শেখ ফজলুল হক মণি সাংবাদিকতাও করেছেন। একজন সাংবাদিককে পেশাগত কারণেই পড়তে হয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। নিজের পাঠাভ্যাসের সুফল কাজে লাগিয়ে যুবসমাজকে বইমুখী করার এক আইডিয়াও তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন। সে দৃশ্য আজ মৃতপ্রায় কিংবা নেই বললেও চলে।

কারো ওপর বাজি ধরে জিতে গেলে মানুষ আকাশের মতো আনন্দিত হন, বঙ্গবন্ধুও বাজি ধরেছিলেন কবি ও গল্পকার শেখ মণির ওপরে। রাজনীতিতে এসে নিত্যনতুন আইডিয়া বাস্তবায়ন করে শেখ মণি তাক লাগিয়ে দিয়েছেলেন, জিতিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে।

কিন্তু দেশকে জিততে দিতে চায়নি যারা, সেই পাকিস্তানি পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসররা সপরিবারে হত্যা করলেন স্বপ্নদ্রষ্টাকে। সেসময় বাদ যাননি পিতার চোখের মণি হয়ে ওঠা শেখ ফজলুল হক মণিও। এই অতীত আমাদের জন্য যেমন করুণ, তেমনি অগ্নিশপথেরও।

সেদিনের মরে যাওয়া স্বপ্নে যত্ন করে পরিচর্যা করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কচি সবুজ পাতা জন্মিয়েছেন। এই বৃক্ষ একদিন মহীরুহ হবে। ঠিক বিশালায়তনের বাংলাদেশ এঁকেছিলেন বঙ্গবন্ধু, এমন স্বপ্নই দেখেন মুজিব-কন্যা। আর এই বৃক্ষের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে যুবলীগের ভূমিকাও অপরিসীম। তাই তো শেখ ফজলুল হক মণির বড় ছেলে শেখ পরশের হাতে তুলে দিয়েছেন যুবলীগের দায়িত্ব। যে যুবলীগ নিয়ে চারপাশ থেকে আসছিল নানাবিধ অভিযোগ, শেখ পরশের হাত ধরে যেন হঠাৎ এক পরশপাথর ছোঁয়ায় বদলে গেল সমস্ত দৃশ্যপট।

যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণির মতো শেখ পরশও সাহিত্যঝোঁকা, পড়িয়েছেন একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর তার মাথা থেকে আসা বেশ কিছু আইডিয়া করোনা মহামারিতে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি ধারণাই ছিল নতুন।

আমি বিশ্বাস রাখি এই যুবলীগের ধারণায় একদিন বদলাবে বাংলাদেশ। আমি স্বপ্ন দেখি এই যাত্রার একজন গর্বিত অংশীদার হওয়ার। আমি এবং আমরা হয়ে উঠতে চাই শেখ ফজলুল হক মণির চোখের মণি, যেমনটা তিনি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর।

লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ