ভৈরবে অপার সম্ভাবনাময় খাত মশার কয়েল তৈরির ফ্যাক্টরি

প্রকাশ | ০৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:০৩

রাজীবুল হাসান, ভৈরব (কিশোরগঞ্জ)

ভৈরবের অপার সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে গড়ে উঠছে মশার কয়েল তৈরির ফ্যাক্টরি। যদিও কয়েকটি কারখানা ছাড়া অন্যগুলোর নেই কোনো সরকারি বৈধ অনুমোদন। এসব কারখানায় কাজ করছে কয়েক হাজার শ্রমিক। এসব কারখানা প্রথম পর্যায়ে ক্ষুদ্র পূঁজি দিয়ে শুরু করেছেন উদ্যোক্তরা। পরে বৃহৎ আকারে কারখানা গড়ে তুলছেন তারা।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আনুমানিক ১৯৮০ সালে প্রথম স্থাপন করা হয় কয়েল কারখানা। এসব কারখানায় প্রতিদিন ভৈরব থেকে গড়ে এক কোটি টাকার কয়েল দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাজারজাত হয়ে থাকে। এই উপজেলায় কয়েক শতাধিক কারখানার মধ্যে অনুমোদন আছে ৮-১০টির। ভৈরব থেকে অন্তত ১৫০টি ব্র্যান্ডের নামে কয়েল বাজারজাত হয় 

ডন, রকেট, বুলেট, নাইটগার্ড, জিরো, জিরাপাতা, সূর্য, সম্রাট, ধূপ ইত্যাদিসহ নানা ব্র্যান্ডের মশার কয়েলের উৎপাদন হয় ভৈরবে। গত চার দশকে এই উপজেলায় গড়ে উঠেছে শতাধিক কয়েল কারখানা। এসব কারখানার মধ্যে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ও অনুমোদন আছে কেবল ৮-১০টির। বাকি সবগুলোই চলছে অনুমোদনহীনভাবে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে।

তবে অনুমোদনহীন এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকার কয়েল বাজারজাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এছাড়াও কয়েল কারখানাগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক হাজার নারী-পুরুষের।

মশার কয়েল তৈরির মূল উপাদান হিসেবে বিভিন্ন কেমিকেল ব্যবহৃত হয়। ওইসব কেমিকেলের সঙ্গে রং, তেঁতুলের বিচি, নারকেলের আরচি, কাঠের ভূষি ও বিশেষ একটি গাছের বাকল গুঁড়া করে মেশানো হয়। কেউ কেউ সনাতন পদ্ধতিতে কয়েলের ফ্রেমে বসিয়ে বানাচ্ছেন। পরবর্তীতে ফ্রেম অনুযায়ী কেটে আগুনের তাপে শুকানো হয়। সর্বশেষ শুকানোর পর প্যাকেটজাত করে বাজারজাত করা হয়।

প্রচলিত আছে ১৯৮০ সালে ভৈরবে সর্বপ্রথম কয়েল কারখানা স্থাপন করেন ইয়াকুব নামে এক ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠিত ইয়াকুব মাহবুব কেমিকেল ওয়ার্কস থেকে ‘বোরাক’ নামে কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করা হতো। এরপর থেকে পুরো ভৈরব উপজেলায় বিস্তৃত হতে থাকে কয়েল কারখানা। বর্তমানে শতাধিক কয়েল তৈরির কারখানা কয়েল উৎপাদন করছে। এসব কারখানায় অন্তত তিন হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে।

উপজেলার তাঁতারকান্দি, লক্ষ্মীপুর, ভৈরবপুর, কালীপুর ও জগন্নাথপুরসহ আরও কয়েকটি এলাকায় কয়েল তৈরির কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কারখানা রয়েছে তাঁতারকান্দি এলাকায় অবস্থিত। কারখানাগুলো থেকে অন্তত দেড়শ ব্র্যান্ডের নামে কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত হয়। তবে এর মধ্যে বোরাক কয়েল, বস, আবেদীন, সিটি, সেন্টমার্টিন, ম্যাক্সো ও পাহাড়ি কয়েলসহ কয়েকটি কয়েল তৈরির কারখানার অনুমোদন রয়েছে। অনুমোদিত কারখানাগুলোর মধ্যে দুয়েকটি কারখানায় একাধিক ব্র্যান্ডের নামে কয়েল উৎপাদন করা হয়।

অনুমোদনহীন কারখানাগুলো চলছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে। সেসব কারখানা শুধুমাত্র পৌরসভার ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই বছরের পর বছর অবৈধভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছেন কারখানা মালিকরা। কয়েল কারখানার জন্য পৌরসভা, ফায়ার সার্ভিস, কৃষি বিভাগ, বিএসটিআই ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তবে অনুমোদন নিতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়- এমন অজুহাতে কারখানা মালিকরা অনুমোদন নিতে চান না। তাদের উৎপাদিত কয়েল ডিলারদের মাধ্যমে কয়েল ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নরসিংদী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়।

আরাফাত কেমিকেল ওয়ার্কস থেকে উৎপাদিত ‘বস কয়েল ফ্যাক্টরি’র মালিক ফজলুল হক বলেন, প্রতিদিন ভৈরব থেকে গড়ে এক কোটি টাকার কয়েল বাজারজাত হয়। ডিলারদের মাধ্যমে আমাদের কয়েল দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। কয়েল কারখানাগুলোতে অনেক নারী ও পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।

কয়েল কারখানার কারিগর রবিউল বলেন, প্রথমে কাঠের গুঁড়ার সঙ্গে  কিছু মেডিসিন মিশিয়ে অটো মেশিনে দেয়া হলে তা পর্যায়ক্রমে কয়েল আকৃতির ধারণ করে তা একটা পাত্রে সাজিয়ে রাখা হয়। তারপর সে মশার কয়েলগুলি রোদে শুকিয়ে বাজারজাত করার জন্য প্যাকেজিং করে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়।

রবিউল বলেন, এই কারখানায় কাজ করে যে টাকা পাই সেই টাকা দিয়ে আমার পরিবার চালাই। এখানে কাজ করে পরিবার নিয়ে ভালো জীবনযাপন করছেন বলে তিনি জানান।

সম্রাট কয়েল কারখানায় কর্মরত কারিগর জনি বলেন, ছয় বছর যাবত আমি মশার কয়েল উৎপাদন কারখানায় কাজ করছি। এই কাজ করেই আমরা আমাদের সংসার চালাই। জন্মের পর থেকেই মশার কয়েল বানানোর কাজ শিখেছি।

জগনাথপুর এলাকার সম্রাট মশার কয়েল কারখানার মালিক আফছার উদ্দিন জানান, আট বছর আগে কয়েল তৈরির কারখানাটি গড়ে তুলি। কারখানাটিতে সম্পূর্ণ অটোমেটিক মেশিনের মাধ্যমে মশার কয়েল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এই কারখানায় প্রতিদিন ১৫-২০ জন শ্রমিক কাজ করেন।

আফছারের কারখানার মতো ভৈরবে  শতাধিক কারখানা রয়েছে। তবে সারাদেশে ভৈরবের মশার কয়েলের ভালো সুনাম রয়েছে। এর ফলে দিন দিন মশার কয়েল উৎপাদনকারী কারখানা বাড়ছে। সরকারিভাবে কারখানার বৈধকরণের প্রক্রিয়াটি সহজ করলে সব কয়েল কারখানা কাগজে কলমে বৈধতা পাবে বলে জানান আফসার।

এ বিষয়ে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিকুর রহমান সবুজ জানান, বন্দর নগর ভৈরবে শতাধিক মশার কয়েল উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে অধিকাংশ কারখানা বৈধ কাগজপত্র নেই। যদিও এই খাতে ভৈরবের কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে সেহেতু কারখানাগুলি মালিকদের সরকারি নির্দেশনা মেনে কয়েল উৎপাদন করার জন্য নিয়মিত সেসব কারখানাগুলিতে উপজেলা প্রশাসন সর্বদা মনিটরিং করছে।

(ঢাকাটাইমস/৮ডিসেম্বর/কেএম)