‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আলোকিত এক নতুন অধ্যায়

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, পিপিএম
| আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:২৪ | প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ২৩:১০

বিস্মিত মহাকাল!

চিরজাগ্রত উন্নত শির, মুক্তির কবিয়াল

ইতিহাস তুমি, একাত্তরের অমর বিজয়গাথা,

মহাসংগ্রামী, স্রষ্টার দূত, বাঙালি জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু, শোষিতের বরাভয়

বর্জ্রকণ্ঠী, মহাজাগতিক, দুর্বার-দুর্জয়।

রুদ্ধ দুয়ার, লৌহ কারাগার কম্পিত সেই নামে,

শেখ মুজিবুর, কাণ্ডারী তুমি

চেতনার সংগ্রামে।

প্রথাগতভাবে সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মে সমাজের বিশেষ বিশেষ সময়ের উল্লেখযোগ্য প্রেক্ষাপট প্রতিবিম্বিত হয়। সাধারণত সাহিত্যের প্রচলিত চর্চায় সমসাময়িক ঘটনাবলির প্রভাব এবং তার নান্দনিক ভাববিশ্লেষণ সেই সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্ররূপ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করে। তাই সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আবহমান বাংলার সাহিত্যকর্মও এর ভিন্ন নয়।

ইংরেজবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর মাতৃভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় বিপুল পরিমাণে দেশাত্মবোধকেন্দ্রিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সময়ের প্রভাব এবং দাবিতে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার ও অন্যান্য অঙ্গের সাহিত্যিকগণ তাদের সাহিত্যকর্মে চলমান ঘটনাপ্রবাহের নিদর্শন রেখে যান। বলা বাহুল্য যে, ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি গণআন্দোলনেই সমসাময়িক শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

একটি মানবিক সমাজের রূপরেখায় তার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রভাব অপরিসীম। জাতিগতভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নিজেদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সমাজবিন্যাসের প্রকৃতি, শিক্ষার স্বরূপ প্রভৃতি চিত্রিত হয়ে থাকে সমসাময়িক সাহিত্যকর্মে। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনার যেকোনো সময়ের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সাহিত্যিকগণ সে সময়ের সামাজিক ইতিহাসের চিত্রকল্পটি সযত্নে এঁকে রেখে যান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, যা অভিযোজনের প্রয়োজনে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার পরিকল্পনায় যথার্থ নির্দেশিকার ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায়, একজন প্রকৃত সাহিত্যিক একজন আদর্শ সমাজবিজ্ঞানীর প্রতিরূপ।

আবহমানকাল ধরেই গঙ্গা-পদ্মা নদীবিধৌত বঙ্গভূমি তার অনন্য লোকজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। বাংলার বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই লোকজ নন্দনতত্ত্বে বিরাট প্রভাব রেখেছে। যুগে যুগে অসংখ্য সুপ্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকের পাশাপাশি অগণিত বাউল, কবিয়ালের সৃষ্টি হয়েছে বাংলার এই পুণ্যভূমিতে। এমনকি দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মসংগীত বাংলার সুফি সাধনতত্ত্বের অন্যতম আধার হিসেবে আজও বিশেষভাবে প্রচলিত এবং লোকপ্রিয়। সহজাতভাবেই বাংলার লোকজ সাহিত্যিকগণ যেকোনো বিশেষ ঘটনাকেই তাদের একান্ত নিজস্ব উৎকর্ষে জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি ইত্যাদি ধারায় সম্পৃক্ত করে নিতেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের মতো অন্যতম একটি ঘটনার প্রভাব বাংলার প্রচলিত শিল্প-সংস্কৃতিচর্চায় অবশ্যই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে, এ কথা অনায়াসেই বলা যেত।

স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন সময় থেকেই ‘বাংলাদেশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বঙ্গবন্ধু’- এই ত্রিসন্ধির প্রভাব বাংলার সাহিত্যকর্মে এক নতুন যুগের সূচনা করে। জাতির পিতার অনন্য নেতৃত্বগুণে সে সময় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব স্তরের সাধারণ মানুষ যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শে একাত্ম হয়েছিল, তার মূল ভিত্তি ছিল বাংলার লোকজ সংস্কৃতি। অলৌকিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রজ্ঞাশীলতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বাংলার সব মানুষের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করে গেছেন, তার প্রধান ভিত্তিই ছিল হাজার বছরের বহমান বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও লোকজ সংস্কৃতির অভেদ্য বন্ধন।

বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার কবি-সাহিত্যিকগণ ওই সময় অজস্র গণসংগীত, উদ্দীপনামূলক গান রচনা করে সমরশক্তি আহরণের প্রেরণা জুগিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীরা সে সময় বিশ্বনেতৃত্বের চেতনায় বাংলার সাধারণ মানুষের পক্ষে যে গণজাগরণের জোয়ার তুলেছিলেন, তা ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদাহরণ হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি অগ্রদূত হয়ে একাধারে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলার শিল্প ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং বিশ্বমানবাধিকার সংরক্ষণ ও শান্তি স্থাপনের আন্দোলনে। বিশ্বরাজনীতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে আর কোনো নেতাই নিজেকে বঙ্গবন্ধুর মতো এতটা প্রসারিত করতে পারেননি।

স্বাধীন বাংলার শিল্প ও লোকজ সংস্কৃতির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব এতটাই প্রবল যে, একক ব্যক্তি হিসেবে শুধু তাঁকে নিয়েই বাংলাদেশে শতসহস্র গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, নাটক, যাত্রাপালা, গবেষণাগ্রন্থ ইত্যাদি রচিত হয়েছে। এমনকি স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও এই ধারাবাহিকতার স্রোতে কিছুমাত্র প্রতিপ্রবাহ দৃষ্টিগোচর হয়নি। তাঁর এই বিশালত্বের কাছে জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জনের নিরিখে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রনায়কের তুলনার প্রেক্ষাপটে জাগতিক সমস্ত সংখ্যাতত্ত্ব ও তথ্য-উপাত্তের হিসাব তুচ্ছ হয়ে যায়।

নক্ষত্রের মহাকায়তা ও ঔজ্বল্যের কাছে গ্রহ-উপগ্রহের অস্তিত্ব যেমন ম্লান ও নিষ্প্রভ, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে অদ্বিতীয় উদাহরণ হয়ে সামগ্রিক প্রভাব বিস্তারে বহু আলোকবর্ষ অগ্রবর্তী হয়ে আছেন। এমনকি বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু সাহিত্যিকগণ তাঁকে নিয়ে রচনা করেছেন বিভিন্ন গ্রন্থ, যা ওই সব দেশের নতুন প্রজন্মকে তাদের নিজস্ব জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে তাদের সাহিত্যকে।

একটি নবগঠিত সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর জীবদ্দশাতেই বঙ্গবন্ধুর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। এক রকম শূন্য হাতে রাষ্ট্রপরিচালনা শুরু করে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে তিনি গঠনতন্ত্র থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়েই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর এই অলৌকিক দক্ষতা, অভূতপূর্ব রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, একনিষ্ঠ সংস্কৃতিপ্রবণ ব্যক্তিত্ব ও মুক্তমনা অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল সমসাময়িক প্রায় সব পর্যায়ের সাহিত্যকর্মীদের। এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি দ্বারা পরিচালিত ৭৫-পরবর্তী প্রায় দুই দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসের কালযুগের কুপ্রভাবকে অগ্রাহ্য করে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণে এসে স্বাধীনতাযুদ্ধের অর্ধশত বছর পরেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাহিত্যকর্মীদের আবেগ বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি, বরং বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে।

তাই বলা যায়, ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক চিরকালীন সচল অধ্যায়। এক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করলেই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, ভবিষ্যৎ বাংলার সার্বিক রূপরেখাও তিনি কোনো এক অতিমানবীয় দক্ষতায় নিখুঁতভাবে চিত্রায়ণ করে গিয়েছেন, যে আদর্শে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা তাঁর নির্দিষ্ট পথ ধরে সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে দেশকে সুনিশ্চিত সমৃদ্ধির পথে পরিচালনা করে চলেছেন। তাই আজও বাংলার শত শত সাহিত্যকর্মী তাঁকে নিয়ে অমর সাহিত্য রচনার স্বপ্ন দেখে। ইতিহাসের খুব কম রাষ্ট্রনায়ক নিজেকে এমন আধ্যাত্মিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভবিষ্যৎ বিশ্বের নতুন প্রজন্ম তাঁকে নিয়ে গবেষণা করে, তাঁর সমগ্র কর্মকাণ্ড এবং গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের রাজনৈতিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বিশ্বনেতৃত্বের প্রয়োজনে নিজেদের সমৃদ্ধ করবে, এ শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে তথ্য-উপাত্তের সহজলভ্যতার কারণে অচিরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বিক কার্যক্রমের গঠনমূলক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রবল যৌক্তিকতা রাখে। কালজয়ী এই পরমপুরুষ আমাদের পিতা- বাঙালি হিসেবে এই গর্ব একান্তই আমাদের, জন্মসূত্রে প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের।

লেখক: পুলিশ সুপার। প্রাবন্ধিক ও কণ্ঠশিল্পী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :