আমেরিকার বৈরিতা বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:৫২

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। মানে বিজয়ের পঞ্চাশ বছর। এ মাহেন্দ্র ক্ষণ উদযাপনে রাষ্ট্র এবং দেশবাসী যখন ব্যস্ত ও অধীর, তখন মাত্র তিন দিন আগে ১২ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলো, ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাব ও এর ছয়জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।’

সঙ্গত কারণই আমেরিকার এই বৈরী আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। ড. মোমেন জানিয়েছেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি বাংলাদেশের মানুষ।’

গ্রহণ করার কথাও নয়। কারণ বাংলাদেশের মানুষ জানে, এর পেছনে আমেরিকার বৈরিতা রয়েছে। আর এই বৈরিতা নতুন কোন বিষয় নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার এই বৈরিতার মেয়াদ ৫০ বছরেরও বেশি। যার প্রথম প্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে পাকিস্তান রক্ষায় সপ্তম নৌ-বহর পাঠাবার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। অবশ্য শেষতক পরিস্থিতি বৈরী বিবেচনা করে যুদ্ধ জাহাজের বহর ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে আমেরিকা এবং পাকিস্তান রক্ষার আশা ত্যাগ করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি বৈরিতা ত্যাগ করেনি। বরং বিভিন্ন উছিলায় দন্ত দেখিয়েছে, দেখাচ্ছে। এ ধারায়ই সংযোজন হচ্ছে, সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা।

এ প্রসঙ্গে ইতিহাসের দিকে খানিকটা তাকানো যাক। তা হয়ে পরিষ্কার বোঝা যাবে, বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার বৈরিতায় কখনো ছেদ পড়েনি। বাংলাদেশে পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর আমেরিকার বৈরিতার নগ্ন প্রকাশ কিচিঞ্জারের ‘বটমলেস বাস্কেট’ তত্ত্বের মাধ্যমে। সবাই এটি জানে। আরো জানা কথা, এই তত্ত্ব অলীক প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এ ধারায় আর একটি বিষয় কম জানা। তা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে সিআইএ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব নেতাদেরকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করার জন্য তৈরি এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘এই দেশটা (বাংলাদেশ) বাঁচবে কেমন করে? এদের কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, তাদের দেশটার আয়তন এত ছোট, আর এই ছোট জায়গায় ঠাসাঠাসি করে এত মানুষ থাকে! এর ওপর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই। কেমন করে এই দেশ টিকবে?’

সহজেই অনুমেয় এই প্রতিবেদন বিশ্ব জনমতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নেতিবাচক ধারণা তৈরিতে প্রভাব ফেলেছে। এরপরও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। এদিকে থেমে থাকেনি আমেরিকার বৈরিতাও। আর বৈরিতার ক্ষেত্রে কেবল তত্ত্ব কথা নয়। সদস্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে আমেরিকা ১৯৭৪ সাল। ফলশ্রুতি, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বলা হয় ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের কারণ আমেরিকার অমানবিক কারসাজি।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা ফিরেছেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। দেশ তখন বিধ্বস্ত। মাইলের পর মাইল দু’পাশে কেবল পুড়ে যাওয়া গ্রাম। এমনও গ্রাম ছিল যেখানে একটি বাড়িও ছিলো না, পুড়িয়ে দিয়েছে পাক হানাদার বাহিনী। যুদ্ধ শেষ হয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে, কিন্তু তখনো অনেক জায়গায় পড়েছিল লাশ। তখনো শকুন খুবলে খাচ্ছে সেসব মৃতদেহ। এদিকে যে শরণার্থীরা বাড়ি ফিরেছে তাদের মনে নানান শংকা। মুক্তিযুদ্ধেও অনেক অস্ত্র ততদিনে চলে গেছে নানান শ্রেণির অপরাধীদের হাতে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের নতুন প্রশাসন তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সামলাতে ত্রাহী মধুসুদন অবস্থা।

এ পরিস্থিতে জাতিসংঘ হতে শুরু করে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে একটি আসন্ন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে বিশ্ব। এর আগে ১৯৭১-এর ডিসেম্বরেই জাতিসংঘ বাংলাদেশে তাদের ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে, ইউনাইটেড নেশন্স রিলিফ অপারেশন ইন ঢাকা। কিন্তু খাদ্য সরবরাহ নিয়ে জাহাজ পাঠানো যাচ্ছিল না। যুদ্ধের সময় পেতে রাখা মাইনের কারণে চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দর- দুটিই তখন বন্ধ। বন্দরের চ্যানেলে তখন ডুবে ছিল অনেক জাহাজ। জরুরি খাদ্য সাহায্য পরিবহনের জন্য পাওয়া যাচ্ছিল না কোন জাহাজ, খাদ্য পরিবহনে রাজি হয়নি কোন শিপিং লাইন্স। তবে শেষ পর্যন্ত সাহায্য এসেছিল সারা পৃথিবী থেকে- আর্জেন্টিনা হতে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া, নেপাল থেকে নরওয়ে, ব্রিটেন থেকে বুলগেরিয়া- অনেক রাষ্ট্র খাদ্য সাহায্য দিয়েছে। তবে খাদ্য সাহায্যের দিক থেকে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ভারত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত কেবল ভারতই দিয়েছে ১২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য সাহায্য। ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাহায্যের কারণে শেষ পর্যন্ত প্রথম দফার দুর্ভিক্ষ এড়াতে পেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ঠেকানো যায়নি এর পরেরটি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। অমেরিকা নিষ্ঠুর খেলার কারণে।

কিউবার কাছে বাংলাদেশের পাট বিক্রির সিদ্ধান্তকে উছিলা হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশে সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ফিরিয়ে নেয়া হলো খাদ্য নিয়ে বাংলাদেশের পথে থাকা জাহাজ। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ যে এরকম ব্যাপক রূপ নিল, তার প্রধান কারণ ছিল আমেরিকার এই অমানবিক আচরণ।

এর আগের ১৯৭৩ সালে কয়েক দফা বন্যা এবং খরা দেখা দিয়েছে। তখন বিরাট শস্য ঘাটতি দেখা দেয়। এরপর ১৯৭৪ সালের শরৎকাল আসলো, তখন আর দেশে কোন খাদ্যের মওজুদ ছিল না। না সরকারের হাতে, না ব্যক্তির হাতে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি পেল। লাগামহীন হলো মূল্যস্ফীতি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল বন্যা কবলিত। আর সময় বুঝে মোক্ষম আঘাত হানলো ১৯৭১ সালে দম্ভ চূর্র্ণ হওয়া আমেরিকা।

আর কেবল অতীত নয়, বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকা বৈরি হয়ে আছে চলমান ধারায়ই। এর একাধিক প্রকাশ আছে। যার সাম্প্রতিক প্রকাশ হচ্ছে, র‌্যাব ও এর ছয়জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ। তবে র‌্যাব মূল কারণ নয়। মূল কারণ প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন।

আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :