গল্প

অস্তিত্ব

রোখসানা ইয়াসমিন মণি
 | প্রকাশিত : ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৩৯

গাড়ি এসে থামলো নায়েব বাড়ির কাচারি ঘরের সামনে। কয়েকজন পাকিস্তানি মিলিটারি নেমে এলো। দুজন গাড়িতে বসা। ওদের সাথে হাকিম মিয়া রাজাকার বাড়ির পথ দেখিয়ে নায়েব বাড়িতে নিয়ে এসেছে। হাকিম মিয়া বলছে, হুজুর ইয়ে হ্যায় হাজী ওরফে নায়েব সাবকো বাড়ি। হাজী সাবকো বড় লেড়কা ঘরকে নেহি থাকে হ্যায়। হুজুর আইয়ে আইয়ে, আপ দেখনা পড়েগা, আইয়ে হুজুর অন্দরতক চলিয়ে।

পাকিস্তানি মিলিটারিরা দরোজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। এই ঘর সেই ঘর খুঁজেও ওরা কোনো পুরুষ পেলো না। পুরুষ না পেয়ে ওরা নায়েব বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করলো। ভেতরে ঢুকতেই রোকেয়া বেগম মিলিটারিদের দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। হাতে পান ছেঁচুনি ছিল। তিনি ওটা দিয়ে পান-সুপারি ছেঁচছিলেন। আচমকা মিলিটারিদের ঘরে দেখে ভয়ে তার হাত থেকে পান ছেঁচুনি পড়ে পানের মিহিগুঁড়া আর কুঁচো সুপারি সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। ওগুলো পায়ের নিচে দলে মিলিটারিরা রোকেয়া বেগমকে একটা ধাক্কা দেয়, হট যা বুড়ি!

নায়েবের বড় পুত্রবধূ হাসিনা বানু রানী ছেলের কান্না শুনে সবে রান্নাঘর থেকে নিজঘরে এসেছে। ছয় মাস বয়সী ছেলেটা ঘুমে ছিল। ঘুম থেকে জেগেই কাঁদছে। রানী তখন ছেলেকে থামানোর জন্য আলমারিটা খুলেছে, দুধের পট বের করে দুধ বানিয়ে তার ছেলেকে খাওয়াবে বলে, এমন সময় মিলিটারিরা তার ঘরে ঢুকে পড়লো।

মিলিটারিদের দেখে রানীর বুকটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। কী করবেন এখন তিনি? ঘরে অনেক মেয়ে। ডোমবাড়িয়া গ্রামের উঠতি বয়সী মেয়েরা রানীর কাছে থাকে। রানী লম্বা-চওড়া সুন্দরী মেয়ে। অনর্গল ইংরেজি, উর্দু আর হিন্দিতে কথা বলতে জানে। গ্রামের মেয়েদের ধারণা কখনো যদি মিলিটারিরা তাদের গ্রামে ঢুকে তাহলে একমাত্র রানীই বাঁচাতে পারবে।

মেয়েগুলো আগেই মিলিটারি আর্মি এসেছে টের পেয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়েছে।

রানীর আলমারি দোতলার মতো। প্রথম তলার ভেতরের একটি কপাটে বঙ্গবন্ধুর ছবি লাগানো। ওই কপাটের পিছনেই রানীর ছেলের দুধের পট, ফিডার, ফ্লাস্ক। রানী সবে একটি কপাট খুলেছে, ওরা ঘরে ঢুকে পড়লো। রানী এক লাফে ছেলেকে কোলে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি লাগানো কপাটটি পিঠে ঠেস দিয়ে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইলো। বাকি কপাট খোলা। ভেতরে সব দেখা যাচ্ছে। রানীর বুক কাঁপছে। বহু কষ্ট করে ছেলেকে বুকের সাথে ঝাপটে সাহস নিয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলো।

মিলিটারিরা তখন রানীকে জেরা করছে। এমন সময় রোকেয়া বেগম দৌড়ে এসে মিলিটারিদের হাত চেপে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, বাবারা, এ আমার ছেলের বউ। আমার বউয়ের কোনো দোষ নাই। ছাইড়া দাও, বাবারা। আমার নাতিটা খিদায় কানতেছে। ওরে খাইতে দাও। রোকেয়া বেগমের কথা কে শোনে?

এক মিলিটারি বলে, স্যার চলতে হ্যা, ইয়া ল্যাড়কি মেরা ওয়াতানি হ্যা। ইয়ে কুছনেহি করেগা। ওঠেগা, ওঠেগা।

যাবার সময় বলে যায়, ঠিক হ্যায়, লেড়কাকো খিলাও। ল্যাকিন হাম ফের আয়েগা। তেরা সোহরছে মিলনে হোগা। ওরা বুটের শব্দ তুলে চলে গেল। চলে গেলে খাটের নিচ থেকে মেয়েরা বের হয়ে এলো। এসেই রানীর গলা চেপে কান্না জুড়ে দেয়Ñ ভাবি, আপনি যদি আজ না থাকতেন, তাহলে আমাদের কী হতো? আপনাকে ওরা নিজেদের দেশি ভেবে ছেড়ে দিয়েছে। আপনার কারণে আমরাও বেঁচে গেছি। আল্লাহ আপনাকে হায়াত দারাজ করুন, ওরা রানীর গলা চেপে আরো জোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

নায়েব বাড়ির বড় ছেলে আবুল খায়ের। ছেলে-বুড়ো সবাই বড়মিয়া নামে ডাকে। এই মুল্লুকের সবার বড় সন্তান তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক মাসের মাথায় তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। কই আছে কেউ জানে না। কারো সাথে যোগাযোগ নেই। তিনি বাড়ি নেই এই কথাটি আর গোপন রইলো না। স্থানীয় রাজাকাররা এলাকার প্রতিটি বাড়ি ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিচ্ছে কারা বাড়ি আছে আর কারা নেই। নায়েব বাড়িতে কয়েকবার হাকিম মিয়া রেড দেওয়ার পর বড়মিয়াকে না পেয়ে ফিরে গেছে। আর তখনই এলাকায় চাপা গুঞ্জন উঠেছে যেকোনো সময় ডোমবাড়িয়া গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারিরা আসতে পারে। আর ঠিক হলোও তাই। পাকিস্তানিরা এলো। আচমকা।

পাকিস্তানি মিলিটারিরা চলে যাবার পর ডোমবাড়িয়া গ্রামটি বেশ কদিন চুপচাপ ছিল। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। মানুষগুলো রোজকার মতো ঘুম থেকে ওঠে। ক্ষেতে-খামারে যায়। হালচাষ করে। গ্রামে দুয়েকটা টং দোকান আছে। কাজ শেষে মুরব্বিরা ওখানে আড্ডা দেয়। চা-টা খায়। পান-বিড়ি খেয়ে গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরে। গ্রামে মিলিটারি আসার পর থেকে টং দোকানদার রহিম মিয়া আর তোরাব আলী আগের মতো দোকান বেশিক্ষণ খোলা রাখে না।

জুন মাস। গরমে পৃথিবী তেঁতে আছে। ঘরে থাকা দায়। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। হঠাৎ একদিন আকাশ মেঘলা হয়ে উঠল। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এখনই বৃষ্টি নামবে। আবহাওয়া গুমোট। গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। গ্রামের মানুষের কাছে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান সাধারণ ব্যাপার।

অবশেষে মাঝরাতে বৃষ্টি নামে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে বজ্র। মনে হয় আকাশ ভেঙে যাচ্ছে। রানীর ছেলে ঘুমের মধ্যে কেঁদে ওঠে। হয়তো ভয় পেয়েছে। সে ঘুম থেকে জেগেই মায়ের বুক খোঁজে। ছোট মুখটি মায়ের স্তনের কাছে হা হা করে ঘষতে থাকে। রানী ছেলেকে বুকে টেনে নেয়। স্তনে মুখটি দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে রাখে। বাইরে জলধারা বয়ে চলেছে। রানীর ছেলের শরীরও ঘামাচির গুটিতে থকথকে হয়ে আছে। রানী নরম হাতে ছেলের পিঠ খুঁটে দিচ্ছে। আর ভাবছে মানুষটা গেল কোথায়?

ঝমঝম বৃষ্টির রাতে নায়েব বাড়ির দরোজায় দুমদাম শব্দ হচ্ছে। শব্দে নায়েব ইউনুস মিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বিচলিত। এই ঝড়ঝাপটার রাতে কে হতে পারে? হাতের কাছে হারিকেন ছিল। তিনি হারিকেনের আলোর ওপর হাতপাখার ছায়া দিয়ে হারিকেন ঢেকে দিলেন। পুরো ঘর কিছুটা অন্ধকার করে পা টিপে টিপে সামনে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে? বাইরে কে?

দরজার ওপাশ থেকে ফিসফিস শব্দÑ আব্বাজান আমি। দরজা খুলেন।

ইউনুস মিয়া গলার স্বর শুনে হতচকিতের মতো দরোজা খুলে ছোট বাচ্চার মতো ভেউভেউ কান্নাজুড়ে দিলেন, বড়মিয়া তুমি? কই থেকে আইলা? বড়মিয়ার সারা শরীর ভেজা। বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবুথবু অবস্থা। বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো, আব্বাজান, অনেক কথা। পরে বলবো। আগে বলেন, কেমন আছেন আপনারা? ইউনুস মিয়া চোখ মুছে জবাব দিলেন, কেমন থাকতাম পারি কও? কেমনে ভালা থাকি কও? আমগোরে তুমি ভালো রাখছো ? হাছা কইরা কও, কোনহানে আছিলা? তোমার মা কানতে কানতে শেষ। তোমার বউ-বাচ্চার কথা একবারও মনে পড়ে নাই? ওদের রাইখা আমগোরে রাইখা তুমি কই ছিলা এতদিন?

রানী শ্বশুরের রুমের পার্টিসনে ঠেস দিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোনো কথা আসছে না। বিশ্বাস করতে পারছে না এরকম বৃষ্টি মাথায় করে স্বামী বাড়ি ফিরে এসেছে! এবং এরকম কাদাপানি ভেঙে বৃষ্টি মাথায় করে তার স্বামী বাড়ি ফিরে আসবে একদিন। এক অলৌকিক ঘটনা। ঘটনার আকস্মিকতায় শরীর থরথর কাঁপছে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। পায়ের তলা থেকে কী যেন শিরশির করে উপরে বেয়ে উঠছে। শীতল একটি সাপ তাকে প্যাঁচিয়ে ফেলছে। এই প্যাঁচ ছুটাতে পারছে না। রানী জ্ঞান হারায়।

রানী মাটিতে ধড়াম করে পড়ে যায়।

কী হলো, কী হলো বলে ইউনুস মিয়া রানীর কাছে দৌড়ে এলেন, রানীর মাথার কাছে বসেন, আমার বৌমা! আমার বৌমা! কী হইলো মা, মা মাগো কী হইলো তোমার? ঘরে এবার শোরগোল তৈরি হলো। শোরগোলে নায়েব বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই জেগে উঠছে। রোকেয়া বেগম বড়মিয়ার হাত ছেড়ে দিলেন। কান্না বন্ধ হয়ে গেল। বড়মিয়াকে বললেন, বাবা যাও জামা কাপড় খুইলা আসো। আমি দেখতাছি।

বড়মিয়া ভেতরে চলে যায়। রোকেয়া বেগম রানীর কপালে অনবরত পানি ছিটাতে লাগলেন। রানী চোখ খুললো। জ্ঞান ফিরে বসেই প্রথম প্রশ্ন, সত্যি মা হায়াতের বাপ আসছে?

বড়মিয়া কাপড় ছেড়ে এসে রানীর সামনে দাঁড়ায়। রানীকে মাটি থেকে তুলে পাশের চেয়ারে বসালো।

ইউনুস মিয়া মৃদু ধমক দিয়ে বললেন রোকেয়া বেগমকেÑ বড়মিয়ারে খাওন দেও আগে। দেখছোনি, ওর পা ফুইল্লা আছে। কতদূর থেকে আসছে কে জানে। খাওন দাওন নাই। শুকাইয়া মুখখান এট্টুক হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খাওন গরম দেও। টেবিল সাজাও। পোলা আমার খানা খাইয়া বিশ্রামে যাক। আল্লাহ বাঁচাইলে কাইল সব হুনন যাইবো। এহন আর কেউ কথা কইয়ো না।

গত কয়েকদিনের গরমে এমনিতেও ঘুমানোর কোনো উপায় ছিল না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মাঝে গতরাতের বৃষ্টি সবখানে কিছুটা শান্তি নিয়ে এলো। রানীর মতো গ্রামের প্রতিটি মানুষ ভয় আর আতঙ্কের মাঝে দিন কাটাচ্ছে। শান্তি ছিল না কারো মনে। যুদ্ধ সবাইকে এলোমেলো করে দিয়েছে। যে ঘরে সোমত্ত ছেলে আছে সে ঘরে বাবাদের ঘুম নেই। ছেলেদের কেউ কেউ এসে নিয়ে যায় কি না সেই ভয়ে আছে তারা। ওরা শুনেছে হাকিম্মা রাজাকারের মতো এ রকম বহু রাজাকার পুরো দেশটা ঘিরে রেখেছে। হায়েনারা ঘরে ঘরে গিয়ে উপযুক্ত ছেলেদের তালিকা করে। আর হিসাব মিলায় এরা এলাকায় আছে কি না! না থাকলে কৈফিয়ত দিতে হয় কই গেছে। হিসাবে না মিললে লুটপাট করে সব নিয়ে যায়। যুবতী মেয়েদের মিলিটারীর হাতে তুলে দেয়। তাদের খুশি করার জন্য আর বিনিময়ে লুটপাটের হুকুম নিয়ে আসে। যেসব গ্রামে যুবকরা বেশিদিন নিখোঁজ সেসব গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মিলিটারীর আস্থা অর্জন করে।

বড়মিয়া ঘুম থেকে যখন জাগলো তখন বেলা দুইটা।

রানী টেবিল সাজায়। হরেক রকমের সুস্বাদু রান্নার ঘ্রাণে বড়মিয়ার পেট মোচড়াতে থাকে। কতদিন এরকম খাবার খেতে পারেনি। পারেনি বললে ভুল হবে। পায়নি। পাবে কোথায়? ওরা জীবনবাজি রেখে দৌড়াচ্ছিল এক শহর থেকে আরেক শহর, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, তখন খাবার বলে যে একটি বস্তু আছে তা কী মনে ছিল? শরীরে ওদের আগুন। গ্রীষ্মের আগুন। পোড়াবে হানাদারদের। এই ব্রত নিয়েই ছুটছিল ওরা এক প্রান্তর থেকে আরেক প্রান্তর। খাবার নয়, স্বাধীনতা যে বড় জরুরি তখন! খাবার টেবিলে নায়েব সাহেবও আসেন। ভাত নিতে নিতে তিনি বলেন, বড়মিয়া এখন কেমন লাগতেছে?

আব্বাজান এখন কিছুটা ভালো আছি। পা ফুলা আছে এখনও। নায়েব সাহেব বললেন, চিন্তা কইরো না। ডাক্তার আসতেছে। মা বলেন, বাজান কি করমু কও! মিলিটারি ঘরে ঢুকছে কী যে ভয় পাইছি! তুমি নাই আমি তোমার বউরে কেমনে পাহারা দেই কও! শুনো বাজান, তোমার বউ-পোলা থুইয়া আর কোথাও যাইতে পারবা না! আমারে তোমার আইজ কথা দিতে হইব তুমি আর কোথাও যাইতে পারবা না, নইলে বাবা আমি আর বাঁচুম না। বড়মিয়ার খাওয়া শেষ হয়। হাত ধুয়ে মাকে বলে, আম্মা আপনি চিন্তা কইরেন না, আমি আর কোথাও যামু না। যদি যাওন লাগে রানীর একটা ব্যবস্থা কইরা দিয়া যামু।

নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বিছানায় ছেলে ঘুমিয়ে আছে। কি সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটা। চাঁদের মতো। বাড়িতে আসার পর এখনও ছেলেটাকে কোলে নিতে পারে নাই। একটু আদরও করতে পারে নাই। রানীর সাথেও ঠিকমতো কথা বলা হয়নি। তাছাড়া দিনের বেলা রানীর এত কাজ থাকে যে, কথা বলার সুযোগ নেই। আম্মা থাকেন পাশের রুমে। কথাতো থাক দূরের কথা, রানীর সাথে চোখাচোখি হওয়ারও সুযোগ নেই। গতকাল রাতে রানী জ্ঞান হারিয়েছিল তাকে দেখে। রানী কী ভেবেছিল, আমি মারা গেছি? হতে পারে হয়তো। কারণ, দেশের এই অবস্থায় বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া যেকোনো মানুষের প্রতি এরকম ধারণা হতেই পারে। বিচিত্র কিছু না। বড়মিয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে এই সময় রানী কাছে আসুক। অন্তত এক মিনিটের জন্য হলেও। বুকটা খাঁ-খাঁ করছে। রানীকে সব কথা বলা দরকার। একমাত্র রানী ছাড়া আর কাউকে সত্য কথা বলা যাবে না।

রাতের কাজ শেষ করে রানী রুমে আসে। ভীষণ ক্লান্ত। ছেলেটাকে টেনে নেয় কোলে। কপালে চুমু খায়। হায়াত পিটপিট চোখে মায়ের চোখে চোখ রেখে হাসে। আহ! কুপির আলোর মতো হায়াতের সুন্দর দুটি চোখ জ্বলছে। রানী ওর নরম আঙুল নিয়ে খেলে। পায়ের তুলতুলে পাতার নিচে চুমু খায়। ছেলে খটখট করে হাসে। বড়মিয়া বামপাশে কাৎ হয়ে ঘুমাচ্ছিল। রানী এসেছে টের পেয়ে ডানপাশে ফিরেই রানীর হাতচেপে ধরে, রানী আমাকে ক্ষমা করো। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আসলে তোমাদের খবর নেওয়ার মতো অবস্থা আমার ছিল না। তাছাড়া এমন কেউ নেই যে খবর পাঠাবো আমি ভালো আছি বা তোমরা কেমন আছো?

রানী চোখ মোছে, ঠিক আছে। তাই বলে এরকম নিরুদ্দেশ হইবা? আমরা কী মনে করতে পারি বলো? চারদিকে যেরকম খবর শুনতেছি, আগুন, লুটপাট মুক্তি সন্দেহে মিলিটারিরা যেভাবে মানুষ ধরে নিয়ে মেরে ফেলছে, আবার রাজাকাররা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করতেছে তখন তুমি কেমন আছো কী হালে আছো বুঝবো কেমন করে?

চিন্তা হওয়ারই কথা। শোনো, আমি তোমাকে সত্যটা কইতেছি। আমি হাজীগঞ্জ ছিলাম না। আমরা ছিলাম ফেনী, মুরাদনগর, দাউদকান্দি, চৌদ্দগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর। আমি চান্দপুরের আজাদ আর নোয়াপাড়ার লোকমানসহ একসাথে এই অঞ্চলগুলো ঘুরে বেরিয়েছি। খুব গোপনে গ্রামের মানুষের সাথে আলোচনা করেছি। একটা গ্রাম থেকে কয়জন মুক্তিযুদ্ধের জন্য লোক পাব আমরা সেই হিসাব নিয়েছি। তাদের একসাথ করেছি। চৌদ্দগ্রাম দিয়ে ইন্ডিয়া বর্ডার পার করেছি যুদ্ধ করার জন্য। সে অনেক কথা। কত বন-জঙ্গল ঘুরেছি। রাত কেটেছে জঙ্গলে জঙ্গলে। কত না খেয়ে থাকতে হয়েছে। কত উপোস থাকতে হয়েছে। কোনো খাবার ছিল না। পানি পাইনি। কলা গাছ কেটে কলাগাছের খোল চিবিয়ে পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। রানী, দেশের অবস্থা ভালো না। আমাদের প্রচুর লোক চাই। বহু। পারলে আমাদের গ্রামের সব পোলাপান নিয়া যাই।

রানী এবার ভয় পায়, তুমি কি তাহলে গ্রামে পোলাপান নিতে আসছ? আমাদের জন্য আসো নাই?

আরে ধ্যাৎ কী বলছো? আমাদের কাজ আপাতত শেষ। হাইকমান্ড থেকে খবর আসলে আবার যেতে হবে। আপাতত বাড়িতে এসেছি। কাজ আছে অনেক। চিন্তা করো না। কারো কিছু হবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো। শুনো, একদম মন খারাপ করবে না। তুমি শিক্ষিত আর স্মার্ট মেয়ে। তোমাকে যত সহজে এইসব কথা বলেছি এই কথাগুলো তো আমি আমার আব্বাজান আর আম্মাকে বলতে পারব না। শুনো, আমিও বর্ডারের ওপারে চলে যেতে পারতাম। আমি চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের কাজ হবে না। তুমি জানো না মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করা কত কঠিন কাজ! স্বাধীনতার জন্য যোদ্ধা পাঠিয়ে দেওয়া সহজ কিন্তু যোদ্ধা সংগ্রহ করতে কী কষ্ট করতে হয় ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না রানী! আর এই কঠিন কাজগুলো আমরা কয়েকজন মিলে করছি। আমাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমি আরো আশা করছি, এই যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি আমার পাশে থাকবে।

কিন্তু বড়মিয়ার বাবা নায়েব সাহেব ছেলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। বললেন, যুদ্ধে যেতে পারবে না।

কন কী আব্বা?

কী কইতাসি, মানে বুঝো না? উর্দু কইতেসি? তুমি আর মুক্তি মুক্তি কইরা দৌড়াইও না। তুমি কী করতে আছো না আছো ওরা সব খবর রাখতেছে। ওরা তাই বইলা গেল। শুধু আমার দিকে চাইয়া চুপ আছে। আইজ হাকিম্মারেও মারছে। বলছে সে যেন এই ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না পারে। নাইলে ওরে জ্যান্ত কবর দেবে। শেষ কথা কইয়া দিই, যুদ্ধের চিন্তা তোমারে করন লাগবো না। যুদ্ধের জন্য বেবাক লোক আছে। ওদের ওপর ছাইড়া দাও। তুমি বাড়ি ছাইড়া কোথাও যাইবা না, কইয়া দিলাম।

বড়মিয়া চুপচাপ তার বাবার কথাগুলো শুনছিল।

সেপ্টেম্বর মাস। লাকসামে রেলওয়ে জংশনে মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে। ওইখানে ওরা লোকোসেড এরিয়ায় টর্চার সেল বসিয়েছে। লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওরা নিরীহ মানুষদের ধরে এনে পাখির মতো গুলি করে মারছে। মানুষ ভীত আতঙ্কিত। যে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। দলে দলে মানুষ ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ।

নায়েব বাড়ি থেকে আস্তে আস্তে শরণার্থীও বিদায় নেয়। অক্টোবরের একরাতে পাশের গ্রাম কনকশ্রীর গোলা ক্ষেতে মিসাইল বোমা পড়লো। সিঁসিঁসিঁ শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। বিশাল বিস্ফোরণে অনেক জায়গা গর্ত হয়ে গেল। পুরো এলাকায় হইচই, কান্না, চিৎকার, আতঙ্ক। গ্রামের মানুষ ঠিক করলো, পালাবে সবাই। গ্রামে আর থাকা যাবে না। পাশের গ্রাম শাকেরা থেকে আলফু নামে একজন যোদ্ধা পেঁড়াইতলি গ্রামে সেতুর নিচে মিলিটারির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হয়েছে। চরম নিস্তব্ধতা চারদিকে। রাজাকার পাহারা দিচ্ছে এই লাশ যেন কেউ নিতে না পারে। চারদিকে তাণ্ডব চলছে। কয়েকটা গ্রাম পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। রাজাকাররা মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে নসরতপুর সিগারেট ফ্যাক্টরিতে। ওখানে ওদের উলঙ্গ করে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হচ্ছে। মিলিটারির হাতে ওদের তুলে দিয়ে রাজাকাররা ফায়দা লুটছে। রোকেয়া বেগম এসব শুনে সেজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছেন।

রাতে বড়মিয়া যায় পিতার রুমে। নায়েব জানতে চান, বড়মিয়া কিছু কইবা?

জে আব্বাজান, কথা আছে।

বসো, কী কইবা বইসা কও।

বড়মিয়া চেয়ারে বসে, আব্বাজান আমি চাইতেছি আম্মা আর আপনের বৌমারে কলমিয়া আমার শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া দিতে। গ্রামের সবাই চইলা যাইতেছে। ওইখানে এখনও মিলিটারি যায় নাই। আপনে কী বলেন?

মন্দ অয় না। তোমার মার লগে কতা কও। কও দরকারী সব জিনিস গুছাইতে।

আমি আম্মার লগে কতা কইছি। তয় আম্মা যাইতে রাজি হইতেছে না। আম্মা বলতেছেন, দরকার হইলে মইরা যাইবেন তবুও এই বাড়ি ছাইড়া কোথাও যাইবেন না।

কও কি!

জে আব্বাজান। এখন আম্মা যাইবে না বইলা আপনেগো বউও যাইবো না।

নায়েব এবার একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, এককাজ করো। আমগো পায়খানার উত্তর আর দক্ষিণ দিকে জঙ্গলের যে আড়াল আছে ওইহানে বাংকার খুঁড়ো। খুঁইড়া দরকারী বেবাক জিনিসপত্র নিয়া তোমার মায়েরে আর বৌমারে ওইখানে পাঠাইয়া দেও। রাইতে ওরা ওইখানে থাকবে। দিনেও সম্ভব হইলে ঢুকে যাবে। আমরা অবস্থা বুজে ব্যবস্থা নিমু।

জে আচ্ছা, বড়মিয়া পিতার কাছ থেকে বিদায় নেয়।

পরদিন জুনাব আলী, বড়মিয়া আর বড়মিয়ার ছোট তিন ভাইসহ শুরু হলো বাংকার খোঁড়ার কাজে। কাকপক্ষীও টের পেল না এখানে কী হচ্ছে। মাটি খোঁড়া এত সহজ কাজ না। যে জায়গায় নায়েবের ছেলেরা রাজকীয় হাওলাতে চলে, যাদের সিথানের কাছে কাজের লোক দাঁড়িয়ে থাকে সেবা করার জন্য আজ কি না তারা মাটি খুঁড়ছে! ওদের হাতে ফোস্কা পড়ে গেল সারাদিন মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে। বাংকার খোঁড়া শেষ হলে কালাবুড়িকে বাংকারে নামিয়ে দেওয়া হলো। মসৃণ ঝকঝকে করার জন্য। বুড়ি নেমেই বললো ও বাবাগো! কব্বরেতো হান্দাইয়া গেলাম। এই আন্দার গর্তে তোমগো মাও থাকবোনি কেমনে আল্লাহ জানে।

বাংকার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হলো। একে একে বিছানা, বালিশ, ছোট বাবুর দুধের বোতল, ফিডার, স্টোভ কেরোসিন, মুড়ি, চিড়া, গুড়, কাপড়-চোপড়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা যা লাগে নিচে নেওয়া হলো। রাতে সবাই ওটায় ঢালু মাটির সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। একটা হারিকেন আর দুইটা টর্চ নেওয়া হলো সাথে। রাতটা কোনোরকম পার হলো। সকালে যে যার মতো উঠে এলো। রোকেয়া বেগমের মুখ গম্ভীর। তিনি ওই কবরে ঘুমাইতে পারবেন না। মরণ হইলে আলোতে হোক ওই অন্ধকারে না। শেষে কী আর করা, ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা আছে সব ওইখানে মজুদ করে ওপর থেকে ভালো করে মাটিচাপা দেওয়া হলো।

দুদিন পর, রানী ঠিক রাত বারোটার দিকে বাবুর গরম পানির জন্য রান্নাঘরে গেল। চুলা ধরাতে যাবে, এমন সময় রান্নাঘর থেকে দূরে যেখানে লাউয়ের ঝাঁপা সেখান থেকে ফিসফাস শব্দ আসছে। রানীর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। কে হতে পারে ওখানে? আজ বড়মিয়া বাড়িতে আছে। বাড়িতে আছে, তবে ঘরে নেই। রানী চুলা ধরানো বাদ দিয়ে ঘরে চলে এলো। ওর ভয় করছে।

রানী অপেক্ষা করছে। বড়মিয়া যখন ঘরে ঢুকলো তখন সুবহেসাদেকের আকাশে আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে।

রানী ঘটনাটা বড়মিয়াকে জানালো। বড়মিয়া বললো, একদম চেপে যাবে। এরা আমার লোক। জেনেছ যখন ভালোই হয়েছে। যতদিন ওরা আসবে এখানে রাতে চা-নাস্তা বানিয়ে রান্নাঘরে রেখে দেবে। আমি এসে নিয়ে যাবো।

রানী জিজ্ঞেস করলো, কতদিন থেকে ওরা আসছে?

আজ তিনদিন। হয়তো আর চার-পাঁচদিন সময় লাগবে। তারপর চলে যাবে।

ওরা এখানে কেন?

গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমি ওদের নিয়ে ম্যাপ করি। কোথায় কোন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেবে সেই ম্যাপ। মিলিটারিরা কই আছে, কোন জায়গা থেকে আক্রমণ করলে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সেই প্ল্যান করে দেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের। তাছাড়া কোথায় মাইন বসাতে হবে, মাইন নিয়ে কে যাবে, কখন এবং কোন রাস্তাটা সহজ হবে সব ঠিক করি আমরা। তাছাড়া এই প্ল্যান প্রয়োজনে পরিবর্তনও করে ফেলতে হয়। আবার নতুন করে তৈরি করি সব। এখন হচ্ছে মিশন মিসাইল অপারেশন। জংশনের ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়ে নসরতপুর থেকে আটকে পড়া মেয়েদের উদ্ধার হচ্ছে এই অভিযানের উদ্দেশ্য।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। পুরো লাকসামে ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণ সেল পড়ার শব্দে কান ফেটে যাবার জোগাড়। বড়মিয়ার ছেলে হায়াৎ ভয়ে চিৎকার করে। রাতে ঘুমায় না। সেলের সিঁসিঁসিঁ শব্দে এত চিৎকার করে যে, তাকে থামানো যাচ্ছে না। মায়ের কোল থেকেও নামে না। কারো কোলে যায় না। ভয়ে মায়ের বুকে সিঁটিয়ে থাকে। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, তাকেসহ রানীকে কলমিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। রানীও আর না করতে পারে না। ছেলের এই অবস্থা দেখে রানীও সব গুছাতে থাকে। বহু কষ্টে একটি রিকশা জোগাড় হলো। ফজরের আগেই ওরা রওয়ানা দেয়। রানীর সাথে চললো সেজো দেবর আবু নসর। হায়াতকে কোলে বুকের মাঝে চেপে রইলো। রিকশা চলছে। আলো ফুটছে একটু একটু করে। আলো ফোটার পর যতদূর দেখলো সব ধ্বংসস্তূপ। পোড়াবাড়ি, ভাঙা ঘরদুয়ার। কোনো লোকজন কোথাও নেই। মাঝে মাঝে বহুদূর ক্ষেতে দু-একজন মানুষ দেখা যায়। আর কিছু নজরে পড়ে না। সব বিরান। ধু-ধু। বসতি আছে অথচ জনমানব নেই। খাঁ-খাঁ করছে চারদিক। রিকশা এবার সরু রাস্তা ছেড়ে আরেকটি রাস্তায় বাঁক নেয়। সারি সারি তালগাছ রাস্তার দুই পাশে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে! ওদের থেকে কিছুটা দূরে একটি গরুর গাড়ি। নসর রিকশা ড্রাইভারকে তাড়া দেয়, ও ভাই, তাড়াতাড়ি চালান না!

আবু নসরের মুখের পুরো কথাটা বেরও হতে পারলো না, সিঁসিঁসিঁ করে একটি সেল শাঁ-ঝাঁক করে মাথার ওপর দিয়ে সামনে গিয়ে পড়লো। ওরা কিছুই বুঝে উঠার আগেই ড্রাইভার ও মাগো বলে রিকশা থেকে ছিটকে ধানক্ষেতে পড়লো। রানীও ধানক্ষেতের ভেতর গড়াতে গড়াতে ছুটলো। নসরের বুকে হায়াত। কিছু বুঝে উঠার আগেই রিকশাটি তালগাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। নসর গাছের চিপায় আটকে গেছে। ধানক্ষেতের ভেতর থেকেই রানীর গগনবিদারী চিৎকার নসু ভাই, ও নসু ভাই! আপনি কই? আমার হায়াত কই? আল্লাগো! আমার ছেলে কই?

নসর চেঁচিয়ে বললো, ভাবী তাড়াতাড়ি আসেন। আমি বেঁচে আছি। হায়াতের কিছু হয় নাই। তাড়াতাড়ি উঠে আসেন ভাবী! আমাদের যাইতে হবে। রিকশা ড্রাইভারও কঁকিয়ে কঁকিয়ে উঠে আসে। ওরা সামনে তাকিয়ে দেখে, দাউদাউ আগুন জ্বলছে। সেলটা গরুর গাড়ির ওপর পড়েছে। চোখের সামনে বিভীষিকা! কোনো অস্তিত্ব নেই। যে গাড়িটা কিছুক্ষণ আগেও সামনে ছিল এখন এটা পুড়ছে। এই সেল তাদের ওপরও পড়তে পারতো। রানী ভয়ে কলেমা পড়তে লাগলো। মানুষ আর গরু পোড়ার গন্ধে ওর বমি আসছে। রিকশা ড্রাইভার বললো, ভাবি তাড়াতাড়ি ওঠেন। আর দেরী করোন যাইবো না। তাড়াতাড়ি। খুব তাড়াতাড়ি ওঠেন।

রিকশা যখন কলমিয়া গ্রামে পৌঁছলো, তখন সকাল আটটা। কলমিয়া গ্রামের শরাই বাড়ির মানুষ মেয়েকে পেয়েছে ।

ডিসেম্বরের আট। যুদ্ধ ভালো করেই বাধলো। মরণ কামড় দিচ্ছে বাঙালিরা। সঙ্গে আছে ভারতীয় বাহিনী। এগারো ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে লাকসাম মুক্ত হলো। মুক্তিযোদ্ধারা সিগারেট ফ্যাক্টরির তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেই বিকট চিৎকারে আঁতকে ওঠেÑ ভয়ংকর! কী ভয়ংকর আর নৃশংস দৃশ্য! সারা ফ্যাক্টরিতে রক্ত আর রক্ত। নগ্ন মেয়ে, নারী, যুবতী, বৃদ্ধ, শিশু একেকটা একেজনের সাথে বাঁধা। মাংসের পচা গন্ধ, রক্তের পচা গন্ধে ভেতরে টেকা দায়। মেয়েদের গোঙানি চিৎকার সারা ফ্যাক্টরিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এত নগ্ন নারীকে একসাথে এখান থেকে বের করা অসম্ভব। তার ওপর সবাই আহত। মুক্তিযোদ্ধারা যতটুকু পেরেছে গায়ের পোশাক খুলে ওদের ছুড়ে দিয়ে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে চলে এসেছে। কমান্ডার বললেন, চলো সামনে এগোই। আমরা আবার আসবো এদের উদ্ধার করতে। তার আগে এদের জন্য ওষুধ আর পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগোলো। হায়! একি দেখছে ওরা! সারি সারি গর্তের ভেতর শয়ে শয়ে মানুষের লাশ পড়ে আছে। কারো কপালে গুলি, পিছমোড়া করে হাত-পা বাঁধা। কারো হাত কেটে ফেলা হয়েছে, কারো পা। কারো মাথার খুলি নেই। চোখ নেই।

রানী বাপের বাড়ি চলে যাবার পর বড়মিয়া নিখোঁজ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বড়মিয়া। এবং লাকসামের নামকরা শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। সমস্ত লাকসাম তাকে অঙ্কের ডুবোজাহাজ বলে। ছেলে যখন বিএসসি পাস করে তখন নবাবের হাতির পিঠে সে সারা লাকসাম ঘুরেছিল। নায়েব হাজী ইউনুস মিয়ার বড় ছেলে আবুল খায়েরের জন্য নবাব হাতি পাঠিয়েছিলেন। সারা লাকসামে যদি কেউ বিএসসি পাস করে তো এই একজনই করেছে। তাই নবাব সেদিন তাকে সম্মান জানিয়েছিলেন এমন একটি ছেলেকে মানুষ করার জন্য। ইউনুস মিয়া কাঁপছে। আল্লাহ, কিছু হয়ে যায়নি তো? কারণ, হাইক্কা রাজাকারের নজর ছিল বড়মিয়ার ওপর। ইউনুস মিয়া খতমে দোয়া পড়ছেন ছেলে ফিরে আসার জন্য।

কলমিয়ায় রানী আনন্দে আছে। কাজকর্ম সংসার কিছু নেই। বিয়ের পর একমাত্র বাবাবাড়ি ছাড়া এরকম ফুসরত আর কোথাও পায়নি। এখানে খাওয়া, গোসল, ঘুম ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এমনকি ছেলে হায়াতকেও ঘুমানোর সময় ছাড়া কাছে পায় না। শরাই বাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। আট ভাই থেকে একজন ঘরজামাই গেছে ডোমবাড়িয়া। বাকি সাতজন রয়ে গেছে এখানে। এই বাড়িতে ছোট বলতে হায়াত। তাই এর কোল ওর কোল ঘুরতে ঘুরতেই দিন শেষ হয়। কিন্তু আরো অনেকে তাকে কোলে নেওয়ার বাকি থাকে। এই নিয়ে বাড়ির ছেলেপুলের মাঝে চলে কামড়াকামড়ি। কার আগে কে হায়াতকে কোলে নেবে। এ রকম করতে করতে সতেরো তারিখ ভোরবেলা এলো। সবাই ঘুমে। হঠাৎ বাজির শব্দে চারদিক মুহুর্মুহু করে উঠলো। ছেলে বুড়ো দলেদলে মিছিলের শব্দ আসছে। স্লোগানে প্রথমে কয়েকটি গলা শোনা গেলেও কয়েক মিনিটের মধ্যে একশো, দুশো, তিনশো, চারশো ছড়িয়ে পড়ছে। মিছিল পূর্ব দিক থেকে এলো। পশ্চিমে বাঁক নিলো। পশ্চিম থেকে উত্তরে। উত্তর থেকে দক্ষিণে। মিছিল আর স্লোগানে ঘরের ভেতর যত ছেলেমেয়ে বুড়ো আছে সব ঘর থেকে বের হয়ে মিছিলে দৌড়াতে লাগলো। জমেদ চাচা যে লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না তিনিও লাঠি ভর দিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। উঠানের মাঝে দাঁড়িয়ে তার কাঁপা হাত দিয়ে লাঠিটা উপরে তুলে মাটিতে সজোরে আঘাত দিয়ে বললেন, এই কে আছো, হগ্গলে হুইন্না যাও, দেশ স্বাধীন হইছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে। কই তোমরা! হগ্গলে হুনো, বাংলাদেশ স্বাধীন হইছে। জয় বাংলা, জয় বাংলা! তোমগো নেতা আমগো নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব। তোমগো নেতা আমগো নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব। জয় বাংলা!

বুড়োর হল্লায় হায়াত জেগে ওঠে। জেগে উঠেই ভ্যাঁ করে চিৎকার জুড়ে দিলো। রানী দৌড়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো। জানে হায়াতকে কোলে নেওয়ার মতো বাড়িতে এখন কেউ নেই। সবাই মিছিলে গেছে। রানী ছেলেকে বুকে জোরে চেপে ধরে বল্লো, আমার সোনা! দেশ স্বাধীন হয়েছে জানো? আমরা সবাই স্বাধীন হয়ে গেছি। রানীর ঠোঁট হায়াতের কানের মধ্যে রাখে, বলোতো হায়াত সোনা, জয় বাংলা! বলো, বলো, জয় বাংলা।

কিন্তু রানী তখনও জানে না, স্বামী- হায়াতের বাবা আর ফিরে আসবে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :