বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ‘রাজনীতির পাঠশালা’

প্রকাশ | ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ২০:০৮ | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:৪৬

মো. ফজলুল করিম মিরাজ

অধিকার আদায়ের রাজপথ থেকে ছাত্ররাজনীতির পাঠশালাকে আলোকিত করেছে যে সংগঠন, নিমজ্জিত অন্ধকার থেকে আলো ছিনিয়ে এনেছে যে সংগঠন, শিক্ষাঙ্গন থেকে সন্ত্রাসের কালো ছাঁয়া মুছে দিয়েছে যে সংগঠন, সেই সংগঠনের ৭৪তম জন্মদিন পালিত হয়েছে গত ৪ জানুয়ারি। ছাত্রলীগ এমন একটি সংগঠন যে সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর থেকে আন্দোলন, সংগ্রাম, রক্ত ও জীবনের বিনিময় রাজপথে লিখে যাচ্ছে অমর ইতিহাস।

যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালিরা সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান তাদের সেই প্রত্যাশিত রাষ্ট্র ছিল না। শুরুতেই তাদের ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ, আঞ্চলিক বৈষম্য ও জাতি নিপীড়ন। পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’ বলে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায় ‘এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে পড়ার’ মতো। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র উন্মোচিত হয়। জাতীয় মুক্তি অর্জন ব্যতীত এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের যে কোনো উপায় নেই, বঙ্গবন্ধু দ্রুত তা উপলব্ধি করলেন। আর আন্দোলন-সংগ্রামের এই নবতর পর্যায়ে বেশি আবশ্যক দৃঢ়ভিত্তিসম্পন্ন সংগঠনের, এ কথাও তিনি সহজে উপলব্ধি করতে পারলেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সাংগঠনিক শক্তিতে গভীর আস্থা। তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর প্রথমে ছাত্রলীগ এবং আরও কিছু পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় তিনি ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করেন।

ছাত্রলীগ পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র চার মাস ১৯ দিন পর এর প্রতিষ্ঠা (৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮)। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন মূল উদ্যোক্তা।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পর সর্বপ্রথম মাতৃভাষা বাংলার জন্য সংগ্রাম করেছিল। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল অনেককে। তারপর আমরা আমাদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে পেয়েছি।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তৎকালীন ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন, যাতে ছাত্রলীগ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভ্যানগার্ড। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে, যা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি দিয়েছিলেন, যা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন বেগমান হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাহসী আন্দোলন বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।

১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন ছাত্রলীগের ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালে বাংলার ছাত্রসমাজ সারাদেশে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে, যা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বাংলার ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন, যা ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিকে ত্বরান্বিত করে।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তৎকালীন ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্রলীগ কাজ করত। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের অপশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্বাচিত করতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্রলীগ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে, যার মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত হয়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী শহীদ হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদসহ তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।

স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অসামান্য অবদান দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরে জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষনেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও হয়েছে ছাত্রলীগ থেকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগের অসামান্য অবদান দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনের নেতাকর্মীরা পরে জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষনেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও হয়েছে ছাত্রলীগ থেকে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত যারাই এদেশের শাসক ছিলেন। তারা সবাই এই স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি প্রেসক্রিপশনে পরিচালনা করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দেশের সরকার প্রধান হন বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা। যার নেতৃত্বে নতুন গতি পায় বাংলাদেশ, কিন্তু ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ব্যালট বাক্স দখল করে অগণতান্ত্রিক পন্থানুসরণ করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

 

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয় বাংলাদেশের মানুষ। যার ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন হয় এবং গণতান্ত্রিক সরকারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষে কার্যক্রম শুরু হয়। যাতে প্রধান অন্তরায় ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সময় ছাত্রলীগ রাজপথ পাহারা দিয়েছিল, যাতে কোনো ধরনের সহিংসতা না ঘটে। ছাত্রলীগের শত শত ছেলের আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় এবং অনেকের বিচারের রায় বাস্তবায়ন হয়। অনেকের মামলা এখনো চলমান। আশা করি সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শতভাগ কলঙ্কমুক্ত হবে।

এদেশের ছাত্রসমাজের প্রতিটি যৌক্তিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ হচ্ছে দাবি আদায়ের সবথেকে বড় মঞ্চ। ছাত্রলীগ যেমন পথপ্রদর্শক, ঠিক তেমনি মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াকু সংগঠন।

ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর জয় বাংলা স্লোগানের প্রতিধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ বাতাস। ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে দিশেহারা হয়ে পড়ে মৌলবাদী সংগঠনগুলো। ছাত্রলীগ যেমন আদর্শিক ছাত্রসমাজ তৈরির কারখানা। ঠিক তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি আগাছা উপড়ে ফেলার বিনা পয়সার আদর্শিক শ্রমিক।

পিতা মুজিব থেকে দেশরত্ন শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের একমাত্র আস্থার ঠিকানা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছাত্রলীগ হচ্ছে পিতা আর কন্যার ভ্যানগার্ড। ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মী দেশরত্ন শেখ হাসিনা নামক বটবৃক্ষের ছায়া তলে থাকতে পছন্দ করে।

আমৃত্যু আমার মতো ছাত্রলীগের আদর্শিক প্রতিটি নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং দেশরত্ন শেখ হাসিনার ব্যাপারে আপসহীন থাকবো এটাই হোক ছাত্রলীগে ৭৪তম জন্মদিনের দীপ্ত কণ্ঠে অঙ্গীকার।

 

লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ