মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
| আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:২০ | প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:১৯

আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে রক্তস্নাত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। পূর্ণতা পায় বাঙালির বিজয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলেও স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ওই সময় স্বাধীন দেশে আর একটি সংগ্রাম শুরু হয়। তা হলো বঙ্গবন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। স্বাধীনতার ২৩ দিন পর ১৯৭২ সালের এদিন অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে তাঁকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখা হয়।

জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। ওই দিন সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে একটি বিশেষ ফ্লাইটে অবতরণ করেন। লন্ডনে পৌঁছানোর পর থেকে সকাল ১০টার পর তিনি কথা বলেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে। টেলিফোনে কথা বলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও। পরে ব্রিটেনের বিমান বাহিনীর একটি বিমানে করে ৯ জানুয়ারি দেশের পথে যাত্রা করেন। ১০ জানুয়ারি সকালে তিনি অবতরণ করেন দিল্লিতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যান্য অতিথি ও সে দেশের জনগণের কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

এদিন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে তিনি ঢাকা এসে পৌঁছেন। ৯ মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই বাঙালির বিজয় পরিপূর্ণতা লাভ করে। জাতির পিতা নিজেই তাঁর এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা হিসেবে।’

বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের সেই ১০ জানুয়ারি বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। তিনি ভাষণে বলেছিলেন ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যারা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই।’

তিনি বক্তৃতায় আরো বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না যে, বাংলায় আমি আবার আসতে পারবো কি না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে, বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’

সশ্রদ্ধ চিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন এবং সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করে বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্র সমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই, তোমরা গেরিলা হয়েছো, তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমায় আপনারা পেয়েছেন। আমি আসছি। জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে আমার সেলের পাশে, আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম, বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মুসলমান একবার মরে, দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাবো। আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাবো না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। এবং যাবার সময় বলে যাবো জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’

আজকের এই দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আসুন আমরা দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নপূরণের একমাত্র পথ।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :