আলোকবর্তিকার প্রত্যাবর্তন

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৩৮

ইলিয়াস সানী

‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’
- ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২; বঙ্গবন্ধু। 

স্বদেশের মাটি ছোঁয়ার সেই জয়গান, আনন্দ অশ্রুর মতো অঝর ধারায় সেদিন ঝরেছিল। একটি স্বপ্নের উপাখ্যান পূর্ণতা পেয়েছিল সেদিন,
পিতা মুজিব তোমার প্রত্যাবর্তনে।

বাঙালির স্বপ্ন সারথি’র স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল, হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল। 

তার মাঝের গল্পটা মোটেও সুখকর ছিল না। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পূর্ব মুহূর্তে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সমগ্র জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৬ মার্চের ঘোষণা বুকে ধারণ করেই সমগ্র জাতি মরণপণ সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অস্ত্র হাতে ২১৪ বছরের পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করতে চালিয়ে গেছে সশস্ত্র সংগ্রাম। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধকালীন এ সময়ে চেষ্টা চালিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশ্ব নেতাদের হস্তক্ষেপ, সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত আক্রমণ সর্বোপরি মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে রক্ষা পায় তার জীবন। এ সময় সারা বিশ্বের সব পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু ছিল অন্যতম প্রধান আলোচিত বিষয়। 

১৫ আগস্ট ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের বক্তব্য ‘শেখ মুজিবের বিচার পূর্ব বাংলায় নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি করবে- উথান্ট’ শিরোনাম করে ‘লা নাসিঅন, বুয়েনাস অ্যারিস’ পত্রিকা লেখে-
‘জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মি. উথান্ট হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর অভিযোগ এনে গোপন বিচার করলে পূর্ব বাংলার অবস্থা গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংস ও মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর হবে। এদিকে ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হয়েছে, সেটাও স্বীকার করতে নারাজ। তাদের তথ্য বিভাগ এটুকুই শুধু বলতে রাজি যে, পাকিস্তানের কোনো এক স্থানে শেখ মুজিবের বিচার হচ্ছে।’

শত নাটকীয়তার চমৎকারিত্ব শেষে বাংলায় নতুন সূর্য উদিত হয়। পিতা মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলার বিজয় রচিত হয়। 
কিন্তু! 
পিতা মুজিব পাকিস্তানে বন্দি!

পাকিস্তানি শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টো, মাথা গরম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্ররোচনায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কি না, তা নিয়ে বিশ্ব নেতারাও উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছিল, সে সময়ও আপামর জনগণ বঙ্গবন্ধুর বেঁচে থাকার জন্য দিন-রাত নামাজ-রোজা রেখেছিল। এমনি পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর কিছু হলে পাকিস্তান আক্রমণের। এ পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মিডিয়ার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। সদ্য স্বাধীন দেশ ও তার নেতার প্রতি মুহূর্তের খবরের জন্য উন্মুখ বিশ্ববাসী।

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পেনাং, স্ট্রেইট ইকো পত্রিকায় ‘ঘড়িতে অনেক সময় বয়ে গেছে’ শিরোনামে লেখা হয় ‘গ্রেপ্তারকৃত ৮০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য এবং ৯০ লাখ পাকিস্তানিকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারটি এখনো বাঙালি জনগণের ইচ্ছার ওপর। এ পরিস্থিতিতে মি. ভুট্টো যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে দ্রুতই তার মোহমুক্তি ঘটবে। মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা, তিনি কখনো চান না যে তার জাতি অন্য কোনো আদর্শের পতাকাতলে পরিচালিত হোক।’ 

সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মোনাজাতে সেদিন পিতা মুজিব ঠাঁই করে নিয়েছিলেন আপন মহিমায়। ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়িয়েও পিতা মুজিব বাংলার জয়গান গেয়েছিলেন পরম আনন্দে। পাকিস্তান সরকার নতুন করে আর কোনো ভুল করেনি। 

১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পুরো জাতি অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রতীক্ষার প্রহর গুনছিলেন। ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এদিন তিনি মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছেন। ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লি হয়ে তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। তার এ প্রত্যাবর্তন ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তন। সে সময় সারা বিশ্বের মিডিয়া প্রতি মুহূর্ত অনুসরণ করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়টি। বঙ্গবন্ধুর এ মুক্তির খুঁটিনাটি বিষয় বিশ্ব গণমাধ্যমে তাত্ক্ষণিক প্রচারিত হতে থাকে। ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘সানডে মেল, মালয় এশিয়া’ পত্রিকায় ‘মুজিব মুক্তি পেয়েছে’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি খুব সকালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনে পৌঁছেন। বিশেষ বিমান পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ ৬৩৫-এ তিনি লন্ডন পৌঁছেন।

বাঙালির সপ্তর্ষিমণ্ডলের নক্ষত্রসম আলোকবর্তিকার প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই, বাঙালি সেদিন বিজয়ের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করেছিল।

লেখক

ইলিয়াস সানী
প্রভাষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়