রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাবেই ইউপি নির্বাচনে সংঘাত-প্রাণহানি

প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৩২ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৩৮

বোরহান উদ্দিন, ঢাকাটাইমস

পাঁচ ধাপে সম্পন্ন হওয়া ৩ হাজার ৭৫০টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে বহু হতাহতের ঘটনা নানা মহলে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। গণমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী এসব নির্বাচনে অন্তত ৮৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এছাড়া ভোটরে আগে-পরে সংঘাত-সহিংসতায় অনেকে আহতও হয়েছেন।

অনেক ইউপিতে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন মনোনয়ন না পাওয়া বিদ্রোহী প্রার্থীরা। সংঘাত-সহিংসতাও বেশি হয়েছে তাদের তাদের দুই পক্ষের মধ্যে। রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাবের কারণেই এসব নির্বাচনী সংঘাত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে নিচের ধাপ। এ নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। আর নির্দলীয়ভাবে ভোট হয় ইউপি সদস্য পদে। তবে এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ না নেওয়ার মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক পাওয়া প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে প্রায় গোটা দেশেই।

সহিংসতা, প্রাণহানি নিয়ে প্রার্থী, কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে সাধারণ ভোটাররাও ছিল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায়। উদ্বেগ জানিয়েছেন খোদ নির্বাচন কমিশনও (ইসি)। তবে ভোটের মাঠে নির্বাচন কমিশনের শক্ত অবস্থান না থাকার সমালোচনাও রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোটের সময় ইসির হাতে স্থানীয় প্রশাসন ন্যস্ত থাকে। ভোটে সহিংসতা কমানোর দায়িত্বও তাদের। পাশাপাশি ভোট কারচুপি হলেও তা বন্ধ করাও ইসির দায়িত্ব। তবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সহযোগিতা না পেলে ইসির একার পক্ষে সহিংসতামুক্ত ভোট করা সম্ভব নয় বলেও তাদের ভাষ্য।

যদিও ভোটে সহিংসতা ও মৃত্যুর দায় ইসির নয় বলে একাধিকবার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা। সিইসির দাবি, নির্বাচনে সহিংসতা ও মৃত্যুর দায় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের। সহিংস ঘটনাগুলো ঘটেছে কেন্দ্রের বাইরে।

অবশ্য সিইসির সঙ্গে দ্বিমত করে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সম্প্রতি বলেছেন, ‘এখন ভোটযুদ্ধ আছে, ভোট নেই। উৎসবের ভোট এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। ব্যালট পেপারেরও নিরাপত্তা দেওয়া যায়নি’।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এখন বেশি ঘটছে। এটি বন্ধের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে সহনশীলতার রাজনীতির চর্চা গড়ে তুলতে হবে।’

নির্বাচনের আগে পরে সংঘর্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও দলের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও নিহত হয়েছেন। ভোটের আগে পরের এমন সহিংসতায় বিব্রত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। দফায় দফায় হুঁশিয়ারি দিয়েও লাগাম টানা যায়নি।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সহিংসতা বেড়েছে এটা উদ্বেগের। তবে চেয়ারম্যানের চেয়ে সাধারণ সদস্যের লোকজনের মধ্যে অনেক সহিংসতা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে সবসময় কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনকেও কঠোর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সামনের ধাপে যাতে সহিংসতা না হয় সেজন্য নির্বাচন কমিশনকে পুরো ক্ষমতা কাজে লাগাতে বলা হয়েছে।’

অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে দুর্বল হয়ে পড়া, কমিশনের যথাযথ ভূমিকা পালন না করা ও দলীয় প্রতীকে ভোটকে সহিংসতার জন্য দায়ী করছেন। ইসির সমালোচনা করে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থা এভাবে চলতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো হারিয়ে যাবে। নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, মনে হচ্ছে নির্বাচন কমিশন খুবই অসহায়। তাদের যে ফলাফল ধরিয়ে দেয়া হয়, নির্বাচন কমিশন তা-ই ঘোষণা করছে।’

আনুষ্ঠানিকভাবে ইউপি নির্বাচনে না যাওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের পর স্থানীয় নির্বাচনেও এখন সহিংসতা হচ্ছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড হচ্ছে। এসবের কারণ নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরে ধ্বংস করায় ভোটের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। আওয়ামী লীগের লোকজন নিজেরা মারামারি করছে। এটা খুবই উদ্বেগের।’

নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে ড. মোশাররফ বলেন, ‘ইসি সরকারের আজ্ঞাবহ। তারা পদ টিকিয়ে রাখতে ফাঁকা বুলি ছুঁড়ছে। কিন্তু কোনো কাজ করছে না। তাই এই সহিংসতার দায় তাদেরও নিতে হবে।’

সবশেষ পঞ্চম দফায় ৭০৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রাণ গেছে অন্তত ১৭ জনের। সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি হামলা, গোলাগুলি, গাড়ি ভাঙচুরের মতো সহিংসতার ঘটনায় অনেকে আহতও হয়েছেন। এর আগে চার ধাপে ২ হাজার ৮৪২টি ইউপি নির্বাচনেও ভোটের আগে-পরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ধাপে। ওই ধাপের নির্বাচন ঘিরে ৩০ জন নিহত হন। সবমিলিয়ে নির্বাচন নিয়ে সহিংসতায় সারা দেশে অন্তত ৮৬ জনের প্রাণহানির তথ্য এসেছে সংবাদমাধ্যমে। যদিও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, নির্বাচনের আগে পরে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাজনীতি কুলষিত হয়ে গেছে। নির্বাচনে প্রকাশ্যে সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে সংঘাত বাড়ছে। নির্বাচন কমিশনের শক্ত পদক্ষেপ নিতে না পারার সুযোগ নিচ্ছে দুষ্টুচক্র। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।’

দলীয় মনোনয়নে ভোট হওয়ায় সহিংসতা বাড়ছে কি-না প্রশ্নের জবাবে ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘এই পদ্ধতি আরও কিছুদিন দেখা উচিত। হুট করে আবার নতুন পদ্ধতি শুরু করা ঠিক হবে না। বিদ্যমান পদ্ধতিতে সুন্দর কিভাবে করা যায় সেই পরিকল্পনাই নিতে হবে।’

উল্লেখ্য, প্রথম ধাপে গেল বছরের ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয় ধাপে ১১ নভেম্বর, তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর, চতুর্থ ধাপে ২৬ ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি হবে ষষ্ঠ ধাপের ভোট। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে চলায় এই নির্বাচনের তফশিল এখনই না দিতে ইসির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

(ঢাকাটাইমস/১২জানুয়ারি/ডিএম)