‘বঙ্গবন্ধু’- বিশ্বরাজনীতির অনন্য এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষক

এস.এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, পিপিএম
 | প্রকাশিত : ১৩ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:৫৯

আমার জানামতে, বঙ্গবন্ধু ছাড়া বিশ্বের আর কোনো নেতা একটি জাতির ধর্মীয় মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক ভাবধারার মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে অসাম্প্রদায়িক কোনো রাষ্ট্রের জন্ম দিতে সক্ষম হননি। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তানকে মাত্র ২৪ বছরে উপমহাদেশের প্রথম সর্বব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন তিনি।

পূর্ব বাংলার যে বাঙালি মিছিল করেছিল ‘হাতমে বিড়ি, মু মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ সে বাঙালিই অস্ত্র উঁচিয়ে বলেছিল ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। এত দ্রুত সমগ্র জাতির মনস্তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সঞ্চালন সম্ভবত বিশ্বনেতাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুই করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে বিবেচনায়, নিঃসন্দেহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বসেরা অনন্য এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষক।

এ মহান নেতাকে সঠিকভাবে জানতে চাইলে আলোচিত বিষয়গুলোতে আরও অনেক বেশি সূক্ষ্ম দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অপ্রকাশিত, অজানা বঙ্গবন্ধুর পরিসর সসীমকে ছাড়িয়ে তারও পরে হাতছানি দেয়। হাজার হাজার বছর আগে যাত্রা শুরু করে, বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে, সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ-রস-গন্ধের মধ্য দিয়ে কর্ষিত হয়ে সর্বশেষ কথিত পাকিস্তানি ভাবধারার ধর্মাশ্রয়ী মনস্তত্ত্বকে দ্রুত বিগলিত করার মধ্য দিয়ে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পরিপূর্ণতা পায় মহাকালের মহানায়ক বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে।

প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সার্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলা ভাষাভাষী ও সাংস্কৃতিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এসব রাজ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস থাকায়, সেখানে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম, নানাবিধ বিষয়কে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে শ্রেণীবৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের মধ্যে বিশেষ একটি অংশ বাংলাদেশ কেন্দ্রিক যে কোনো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বা রাজনীতির প্রশ্নে প্রায় সব সময়ই নেতিবাচক সমালোচক চরিত্রের ভূমিকা রেখেছেন। তা হোক না খুব মূল্যবান কিংবা সামান্য বুদ্ধিবৃত্তিক, বিরোধিতা করাই যেন তাদের বিদ্যা প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে এদের মধ্যে কেউ কেউ সেটি অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয় বলে ব্যাখ্যা-যুক্তি অনেক কিছুর অবতারণা করেছেন। জাতীয়তাবাদ বিষয়ক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শকে সার্বিক চেতনার চেয়ে সীমানা প্রাচীরের মধ্যেই সুকৌশলে আটকে রাখার চেষ্টা করেছেন তারা।

অবশ্য বলতে দ্বিধা নেই, শক্তিশালী পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী জনগণ তাদের প্রাণের ভাষা রক্ষা ও জাতীয়করণের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করে পৃথিবীর ইতিহাসে রক্ত দিয়ে ভাষা বাঁচাবার যে মৌলিক ইতিহাস রচনা করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের এমন অহংকারের জায়গা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বরং বললে অত্ত্যুক্তি হবে না যে, দিল্লির মসনদকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় তারা নিজেদের কেন্দ্রীভূত করে হিন্দি ভাষার দেশাত্মবোধের আড়ালে বাংলা ভাষাকে সমর্পিত করে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন বেশ। তাত্ত্বিক ওই মানুষগুলোর চেয়ে বঙ্গবন্ধুর অন্তর্দৃষ্টি ছিল হাজার গুণ অগ্রসরমাণ। তিনি পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের এই জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে একত্রিত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। কারণ, যৌক্তিকভাবেই তারা স্বাধীন ভারতের নাগরিক।

অন্যদিকে ভাষার প্রশ্নে পূর্ব বাংলার মানুষের মতো অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়ে পশ্চিম বাংলার মানুষকে ভাষা রক্ষার আন্দোলন করার কোনো প্রয়োজনীয়তার মুখোমুখি হতে হয়নি কখনোই। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার একান্ত লক্ষ্যে তখন থেকেই অটুট ছিল। সে প্রেক্ষাপটে সমস্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সমগ্র ভূখণ্ড নিয়ে একক রাষ্ট্র গঠন করার মতো এতটা অদূরদর্শী কিংবা অপরিণামদর্শী জাতীয়তাবাদী নেতা তিনি ছিলেন না মোটেও। ভাষা, সংস্কৃতি, দর্শন, মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার সমন্বিত নান্দনিক বোধে যে জাতীয়তাবাদ ভাবনা আত্মপ্রকাশ করে, তাকে কোনো ভূখণ্ড দ্বারা সীমায়িত করে রাখা সম্ভব নয়, এ উপলব্ধি তাঁর ছিল। স্বকীয়তার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সেটি অনুধাবন করতে না চাইলেও, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুভূতিতে তা ছিল একেবারেই স্বচ্ছ।

অবশ্য, পশ্চিম বাংলার সাধারণ বাঙালি ও বিশেষ একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে হৃদয়ে লালন পালন করেন, তার প্রমাণ হিসেবে তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চায় বঙ্গবন্ধুকে সেই মর্যাদার আসনে রেখেছেন। সেই সাথে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতা করে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ জন্ম দেয়ার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে। প্রসঙ্গক্রমে, পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বঙ্গবন্ধুর প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করে মন্তব্যে উল্লেখ করেন-

‘এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্ম-মতনির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়।

লেখক: পুলিশ সুপার, কবি ও কণ্ঠশিল্পী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :