হারিছ চৌধুরী ঢাকায় মারা গেছেন? তাহলে কোথায় থাকতেন? কবে ঢাকায় এলেন? সবই রহস্যে ঘেরা!

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৩:৪৭ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:৪৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

হঠাৎ আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও প্রভাবশালী রাজনীতিক হারিছ চৌধুরী। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তেমন আলোচনা না থাকলে সম্প্রতি তার মৃত্যুর খবরকে কেন্দ্র করে সরগরম সিলেটের রাজনীতির অঙ্গন। একই সঙ্গে গণমাধ্যমও সরব তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে। দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাজ্যে তার বসবাসের কথা প্রচলিত থাকলেও মৃত্যুর আগে তিনি ঢাকায় এসে, এখানকারই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ঢাকাতেই তাকে দাফন করা হয়েছে এমন তথ্য দিলেন তার মেয়ে সামীরা তানজীন চৌধুরী মুন্নু। তিনি বলেছেন, গত সেপ্টেম্বরে ঢাকার একটি হাসপাতালে তার বাবা মারা গেছেন।

যদিও ২০০৮ সালে ১/১১ র সরকারের আমলে হারিছ চৌধুরী দেশ ছাড়ার পর লন্ডনসহ বিদেশে দুই এক জায়গায় তাকে দেখার কথা বলেছেন অনেকে। তবে ঢাকায় কেউ কখনো দেখেছেন এমন তথ্য কখনো পাওয়া যায়নি৷

অবশ্য যার বক্তব্য থেকে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবরটি চাউর হয় তার চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরীর দাবি তিনি মারা গেছেন লন্ডনে। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়েছে। পরিবারের ইচ্ছার কারণেই এতদিন মৃত্যুর খবরটি চেপে যাওয়া হয়েছিল।

ফলে প্রশ্ন উঠেছে কার বক্তব্য সঠিক। একইসঙ্গে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- মেয়ে মুন্নুর কথা ঠিক হলে কবে ঢাকায় এসেছেন হারিছ চৌধুরী? ঢাকায় তিনি কোথায় থাকতেন? মামলায় সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি কীভাবে নিজেকে এতদিন আড়াল করে রাখলেন। সবকিছুই যেন রহস্যঘেরা।

এসব কারণে বিষয়টি নিয়ে মনোকষ্টে ভুগছেন সিলেট ও কানাইঘাটের বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। রাজনীতির বাইরেও হারিছ চৌধুরীর এলাকার লোকজন বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

তাদের ভাষ্য, হারিছ চৌধুরীর মতো একজন রাজনীতিবিদের মৃত্যু নিয়ে এমন পরিস্থিতির তৈরি করা কাম্য ছিল না। কেউ কেউ আবার এজন্য আশিক চৌধুরীকেও দোষারোপ করছেন।

হারিছ চৌধুরীর মেয়ে জানিয়েছেন, তাকে ঢাকার কাছে একটি গোরস্থান দাফন করা হয়। কিছু নিকটজন এবং ওলামা-মাশায়েখ অনেকটা গোপনে করা এই জানাজায় শরিক হন।

তবে সিলেটবাসী যখন তাদের অঞ্চলের একসময়ের প্রভাবশালী রাজনীতিককে নিয়ে ব্যস্ত তখন একদমই চুপ বিএনপি। হারিছ চৌধুরীর বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো আলোচনাই নেই দলটিতে। তবে ভেতরে ভেতরে নিজেরা এ নিয়ে আলোচনা করছেন বলে জানা গেছে৷

যেভাবে আলোচনায় হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর

বেশ কিছুদিন ধরে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু নিয়ে তার চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরী ফেসবুকে স্ট্যাটাসে ইঙ্গিত দিলেও সরাসরি কিছু বলেননি। তখন থেকে বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরে সাংবাদিকদের তিনি জানান, হারিছ চৌধুরী লন্ডনে মারা গেছেন। ফলে কয়েকদিন ধরে তার মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়।

তিনি জানান, ২০০৭ সালে হারিছ চৌধুরী সবশেষ বাড়িতে আসেন। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন। পরে তার ঢাকার বাসায় যৌথবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে এমন খবরের পর তিনি চলে গেছেন। আর কখনো আসেননি। তার সঙ্গে আর কখনো কথাও হয়নি।

চাচাতো ভাইয়ের মত্যুর খবর বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আশিক চৌধুরী। বলেন, তিনি কখনো নিজে কথা বলতেন না। সন্তানরা আমাকে টেলিফোনে বলতো, কাকা অমুক মাদরাসায় ৫০ হাজার টাকা দান করে দিয়েন, দুটো গরু কোরবানির ব্যবস্থা করে দিয়েন। এভাবেই একদিন তার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর দেয় তার মেয়ে। পরে খুব অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। পরে তার মেয়ে একদিন খবরটা জানায় যে, সে লন্ডনে মারা গেছেন। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়েছে।

অবশ্য সিলেটের আরেকজন সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী হারিছ চৌধুরীর মেয়ের বরাত দিয়ে বলেছেন ভিন্ন তথ্য।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুশফিকুল ফজল আনসারী তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে জানান, হারিছ চৌধুরীর কন্যা সামীরা বলেছেন, শেষ গোসল, অন্তিমযাত্রা আর আতর গোলাপ ছিটিয়ে আন্তিম শয়ানে শুইয়ে দেওয়ার কাজটি করেছেন তিনিই।

সামীরা ঢাকাটাইমসকে বলেন, 'সিলেটের কানাইঘাটে পারিবারিক গোরস্থানে দাদুর কবরের পাশে বাবাকে সামাহিত করার কথা। কিন্তু আশিক চাচা (আশিক চৌধুরী) সাহস করলেন না।'

হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপনে থাকাকালে পরিবারের সঙ্গে খুব সামান্যই যোগাযোগ হয়েছে উল্লেখ করে সামীরা বলেন, 'বাবা চাইতেন, যা হয় তার ওপর দিয়ে যাক। সন্তান হিসেবে আমাদের, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি তিনি যে রাজনীতি করতেন সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বও যাতে তার কারণে কোনো বিপদে না পড়ে সেজন্য কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না। মাঝেমধ্যে তিনি ফোনে সবার খোঁজ নিতেন। সর্বশেষ তিনি যখন আমাকে কাছে চাইলেন তখন সব প্রায় শেষ।'

সামীরা আরও বলেন, 'আমি কয়েক ঘণ্টার নোটিশে সব ছেড়েছুঁড়ে ২৭ আগস্ট ঢাকা পৌঁছাই। ততোক্ষণে বাবা লাইফ সাপোর্টে। করোনা থেকে নিউমোনিয়া হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে। বাঁচাতে পারলাম না বাবাকে। বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি নিজেকে তার কাছ থেকে এক মুহূর্ত আড়াল করতে চাইনি। সবসময় তার পাশে বসেছিলাম। ভয় আর শঙ্কা আমাদের সব তছনছ করে দিল। মাত্র কয়েক দিন আগে ছোট চাচা (সেলিম চৌধুরী) স্ট্রোক করে মারা গেলেন। তার আগে মারা গেলেন হাসনাত চাচা (হারিছ চৌধুরীর ছোট ভাই), হারালাম এক ফুপু ও চার ফুপাকে। এমন বিপর্যয় আর কোনো পরিবারে হয়েছে কি না আমার জানা নেই।'

হারিছ চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে তার মেয়ে বলেন, 'এর সবটাই রাজনৈতিক। আমার বাবা হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসেননি। ১৯৭৭ সাল থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন, সিলেট জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাকে যুবকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ছিলেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব। তিনি জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার মতো রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। সবকিছুকে ছাপিয়ে আমার বাবা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। যিনি অস্ত্র হাতে দেশের জন্য লড়েছেন। তার সন্তান হিসেবে অবশ্যই আমি গৌরববোধ করি।'

তার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে সামীরা বলেন, 'এসব অভিযোগ কোন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে আসেনি, বলেন? এগুলোর ভিত্তিও আমাদের কারো অজানা নয়। পারিবারিকভাবে চৌধুরী পরিবার অস্বচ্ছল নয়। জন্মের আগে থেকে ট্রলারের ব্যবসা আর ছোটবেলা থেকে আমাদের গাড়ির শো-রুম দেখে আসছি। ঢাকা এবং সিলেটে বৃটিশ আমল থেকে আমাদের পরিবার ঐতিহ্যমণ্ডিত। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বাবা গুলশানে একটি বাড়ি সরকারি নিয়মানুযায়ী রাজউক থেকে কিনেছিলেন, যা সরকার পরবর্তীতে বাতিল করে ফেরত নিয়েছে।

হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে তার মেয়ে বলেন, 'আমি ২২ বছর থেকে দেশের বাইরে। পরপর দুই চাচা ও ফুফু মারা গেলেন। এর বাইরে আমি তেমন কাউকে চিনি না। আশিক চাচাই বাবার সাথে যোগাযোগ রেখে সব করতেন বলে জানি। দাদার নামে বাবার প্রতিষ্ঠিত এতিমখানা, মাদ্রাসা সব তিনিই দেখাশোনা করেন। আমার ভাইয়ের মাধ্যমে সহায়তা দিই। আমরা আশিক চাচার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। চাচাই মৃত্যু সংবাদটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছেন।'

তার বাবা লন্ডনে মারা গেছেন বলে আশিক চৌধুরী যে মন্তব্য করেছেন সেটার প্রসঙ্গে সামীরা বলেন, 'হয়তো কোনো চাপে বা পরিস্থিতির কারণে তিনি এমনটা বলে থাকতে পারেন। এই একই কারণে তিনি বলেছিলেন সিলেটে দাফন করা নিরাপদ হবে না। আমার সঙ্গে এ বিষয়ে তার কোনো কথা হয়নি। তবে আমার বাবার মতো একজন বিশাল ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হোক সেটা সন্তান হিসেবে আমার কাম্য নয়।

(ঢাকাটাইমস/১৫জানুয়ারি/বিইউ/ইএস)