ছেলে ‘হত্যার’ বিচার চেয়ে হাফেজ যুবায়েরের মায়ের আকুতি

প্রকাশ | ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ২২:০৩

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
হাফেজ যুবায়ের (ফাইল ছবি)

ঢাকার কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা নদী থেকে সৌদি প্রবাসী এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বসিলা বিআইডব্লিউটিএর জেটির পাশ থেকে হাফেজ যুবায়ের নামে ওই যুবকের লাশটি উদ্ধার করা হয়। যুবায়ের দেশের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের মেঝো ছেলে মাওলানা ওবায়দুল্লাহর নাতি।

পুলিশ বলছে, এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেলে বোঝা যাবে।

এদিকে নিহত হাফেজ যুবায়েরের মা মোমেনা খাতুন সম্প্রতি একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে তার ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। তার হৃদয়গ্রাহী স্ট্যাটাসটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

ফেসবুকে মোমেনা খাতুন লেখেন, “গত ২৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে তিনটায় মোবাইলে আমার ছেলে যুবায়েরের ম্যাসেজ আসে। ‘আমি দেশে চলে যাচ্ছি। সৌদির সরকারি রুসুম-এর সব টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। বাংলা দেশে নেমে তোমাদেরকে জানাবো। আসসালামু আলাইকু।’

ম্যাসেজটা আরবিতেই লিখেছিল যুবায়ের। ছোটবেলা থেকে সৌদিতে বড় হয়েছে। যুবা্য়ের হাফেজ্জী হুজুরের ছেলের নাতি। জামেয়া তায়েফ  থেকে শরিয়া বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করেছে৷ তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশে এসে ভালোমানের কোনো ইফতা বিভাগ থেকে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করবে। পাশাপাশি বাংলাটাও ভালো করে শিখবে।

এ বছর পুরো পরিবারসহ আমাদের দেশে চলে আসার কথা ছিল। অপেক্ষা করতে হচ্ছিল আমার মেয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অনার্সটা শেষ হওয়ার জন্য। আমাদের সরকারি রূসুমও বাকি ছিল। তবে যুবায়েরের যেহেতু অনার্স শেষ, তাই ও সময় নষ্ট করতে চায়নি। আগে আগেই চলে আসে। আমরা যদি তাকে একা আসতে না দেই, এ কারণে সে না জানিয়েই চলে আসে। 

যুবায়ের দেশে যাচ্ছে এ খবর শুনেই ওর আব্বা যুবায়েরের চাচাদের ফোন করে জানায়। এয়ারপোর্টে গিয়ে চাচারা যুবায়েরকে রিসিভ করে বাসায় নিয়ে আসে। 

যুবায়েরের বাবার বাড়ি ঢাকার বসিলা্য় ঘাটারচরের ওলামানগরে। দেশে এলে আমরা সেখানেই থাকি। যুবায়ের সেখানে উঠেছে। সেই বাসায় ওর চাচা থাকেন। আমার সাথে যুবায়েরের নিয়মিত কথা হচ্ছিল। যুবায়ের সিম কিনতে পারেনি৷ তাই ওর এক ফুফাতো ভাইয়ের ফোনে কল দিয়ে কথা বলতে হতো। 

দেশে যাওয়ার তিনদিন পর, ৩১ ডিসেম্বর দুপুরে যুবায়েরের সাথে কথা বলার জন্য ওর ফুফাতো ভাইকে ফোন দেই আমি। সে জানায়, ফজরের পর থেকে যুবায়েরকে পাওয়া যাচ্ছে না। এক চাচার সাথে ফজরের নামাজ পড়তে বের হয়ে যুবায়ের নামাজের পর আর ফিরে আসেনি। সাথে সাথে যুবায়েরের আব্বু ওর চাচাকে ফোন করে। তিনিও একই কথা বলেন। একটু পর পর ফোন দিতে থাকি। কিন্তু কোথাও যুবায়েরকে পাওয়া যাচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টা পর জিডি করার জন্য আমরা থানায় যেতে বলি। কিন্তু থানায় শুধু লিখিত অভিযোগ করা হয়। 

প্রশাসনে আমাদের পরিচিত যারা আছে তাদেরকে এই অভিযোগের কাগজ দেখিয়ে সহযোগিতা চাই। তারা আমাদেরকে জিডি করতে বলেন। কিন্তু দূর প্রবাসে বসে এতটাই অক্ষম অবস্থায় ছিলাম যে, ছেলে হারিয়ে যাওয়ার তিন দিন পরও জিডি করাতে পারিনি কাউকে দিয়ে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমরা তখন কতটা অসহায় হয়ে পড়েছি এটা শুধু আল্লাহ জানেন। শুধু আল্লাহর কাছে বলেছি, আমার ছেলেটাকে যেন সহিহ সালামতে ফিরিয়ে দেন। 

এভাবে যুবায়েরকে খুঁজতে খুঁজতে পুরা একটা সপ্তাহ কেটে যায়। দিনদিন আমি আরও বেশি পাগলের মতো অস্থির হয়ে যেতে থাকি। সবার কাছে ফোন করে বলতে থাকি আমার ছেলেটাকে একটু খুঁজে বের করে দিতে। 

সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি যুবায়েরর এক মামা ও এক চাচা জিডি করার জন্য আবার থানায় যায়। কিন্তু সেদিন পুলিশকে জিডি নেওয়ার কথা বলার সাথেই সাথেই পুলিশ অনেক কিছু জিজ্ঞাস করতে শুরু করে। যুবায়েরের পাসপোর্ট দেখতে চায়। 

একপর্যায়ে পুলিশ জানায়, ডুবুরিরা গত ৩ জানুয়ারি বসিলা ব্রিজ থেকে একটা লাশ উদ্ধার করেছে। জিডি করার আগে সে লাশটা দেখে নিতে৷ কিছুক্ষণ পর যুবায়েরের আব্বুকে ফোন করে জানানো হয় উদ্ধার করা লাশটা যুবায়েরের।

পুলিশ আমাদেরকে জানায়, লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ বাদী হয়ে একটা অপমৃত্যুর মামলা করেছে। তদন্তেরও অগ্রগতি হচ্ছে। আজ যুবায়েরের বাবার বাড়ি থেকে যুবায়ের সবকিছু জব্দ করেছে পুলিশ।

আমার ছেলে যুবায়ের খুবই শান্ত স্বভাবের ছিল। কখনোই কারো সাথে ঝগড়া পর্যন্ত করতো না।  নামাজের প্রতি কখনোই অবহেলা করতে দেখিনি। ওয়াক্ত হলে সবার আগে নামাজ পড়ে এরপর অন্য কাজ করতো। কুরআনের হাফেজ ছিল। দশ ক্বিরাতের ওপর সে সার্টিফিকেট নিয়ে ক্বারীও হয়েছিল। ওর তিলাওয়াত অনেক সুন্দর। যে মসজিদে যুবায়ের নামাজ পড়াতো সেখানকার মুসল্লিরা এখনো প্রতিদিন আমার বাসায় আসছে। ওর ইন্তেকালের খবর শুনে কাঁদছে। মুসল্লিরা আমার ছেলেকে এত বেশি ভালোবাসতো। 

এমন নিষ্পাপ একটা ছেলেকে কারা এতটা নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলতে পারলো আমি এটা জানতে চাই। আমি আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত চাই। আমি একজন ছেলেহারা অসহায় মা হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই।”

কী বলছে পুলিশ

বসিলা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির এসআই লুৎফর রহমান ঢাকা টাইমসকে জানান, বিআইডব্লিউটিএ'র জেটির পাশে লাশটি ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশটি উদ্ধার করে সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। উদ্ধারের সময় নিহতের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।

বসিলা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ওসি বলেন, আমাদের তদন্ত চলছে। তিনি কীভাবে মারা গেলেন তা জানতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছি। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বিস্তারিত জানা যাবে।

প্রতিবেদকন ছাড়া এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

(ঢাকাটাইমস/১৫জানুয়ারি/এসএস/জেবি)