কাজী আনোয়ার হোসেন: মাসুদ রানার স্রষ্টা তিনি

মাহবুব রেজা
| আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:২৯ | প্রকাশিত : ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:০১

শেষ পর্যন্ত কাজী দা'ও চলে গেলেন। কাজী আনোয়ার হোসেন- বাংলা রহস্য সাহিত্যের এক প্রবাদ প্রতিম পুরুষ। মাসুদ রানা আর কুয়াশা'র স্রষ্টা হিসেবে এক জীবনের পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন। তাঁর হাত ধরেই এদেশে ১৯৬৪ সালে সেগুনবাগিচার এক ছোট্ট ছাপাখানা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনি, স্পাই থ্রিলারের যাত্রা। পরবর্তীকালে যা রূপ নিয়েছিল এক মহীরুহে। শুরুটা হয়েছিল মৌলিক কাহিনির ওপর নির্ভর করে 'মাসুদ রানা' দিয়ে। তারপর কুয়াশা। পাঠকের কাছে মাসুদ রানা মানে কাজী আনোয়ার হোসেন আর কাজী আনোয়ার হোসেন মানে মাসুদ রানা। মাসুদ রানা প্রকাশের পর পাঠক খুব দ্রুতই তাঁর রানাকে আপন করে নিয়েছিলেন। তারপর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এদেশের অগণিত পাঠকের কাছে তিনিই প্রথম তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা ভাষার রহস্য আর রোমাঞ্চ কাহিনির বিচিত্র স্বাদ।

একথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে দেশের সব বয়সের পাঠকের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেনই প্রথম তৈরি করে দিয়েছিলেন পাঠ-তৃষ্ণা। এক জীবনের পুরোটাই তিনি ব্যয় করেছেন লেখালেখি আর লেখক- পাঠক তৈরির কাজে। এদেশে পাঠক তৈরির কাজে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি নিজে।

মাসুদ রানা'র শুরুটা হয়েছিল কীভাবে?

শুরুর দিককার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, 'কুয়াশা লেখা শুরু করেছি। কয়েকটি বইও বেরিয়েছে। এ সময় মাহবুব আমিনের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব। তিনি বইগুলো পড়ে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ডক্টর নো বইটি আমাকে দেন। ওটা পড়ার পর বিস্মিত ও লজ্জিত হয়েছিলাম। রহস্য-রোমাঞ্চ সাহিত্যে বাঙালি লেখকেরা যে কতটা পিছিয়ে আছে বুঝতে পারলাম। ঠিক করলাম, বাংলাতে ওই মানের থ্রিলার লিখব। শুরু হলো বিভিন্ন বিদেশি বই পড়া। কাহিনি সাজাতে মোটর সাইকেলে করে ঘুরে এলাম চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি। সেটা ১৯৬৫ সালের শেষ দিকের কথা। এরপর কাগজ-কলম নিয়ে বসলাম। কিন্তু লিখতে গিয়ে টের পেলাম, ভাষা নেই। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র আমি। সাহিত্যের ভাষা আসে। এ ভাষায় থ্রিল-অ্যাকশনের দৃশ্য ছবির মতো ফুটিয়ে তোলা বড়ই মুশকিল। তাই লিখছি, কাটছি, আবার লিখছি, পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছি, আবার লিখছি। এ ধরনের লেখা বাংলা সাহিত্যে ছিল না। ভাষা ও বিষয় কোনোটিই নয়। সে জন্যই চেষ্টা করতে হলো। চেষ্টা-চর্চায় তৈরি হলো ভাষা। সেবার ভাষা। এর মধ্যে কিছুটা রিপোর্টিং স্টাইল আছে। মানে, সহজভাবে বলার চেষ্টা, তার চেয়ে বেশি দৃশ্যপট পাঠকের চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা। এভাবে চেষ্টা ও পরিশ্রম করে সাতমাস ধরে লিখলাম মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস-পাহাড়। ১৯৬৬ সালের মে মাসে বাজারে এলো বইটি। প্রশংসা-সমালোচনা, নিন্দা, অভিনন্দন−সবই জুটল। এরপর সিরিজের দ্বিতীয় বই ভারতনাট্যম প্রকাশিত হলো। এটা লিখতে প্রায় ১০ মাস সময় লেগেছিল। বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে লিখছিলাম বইগুলো। পরবর্তী সময়ে মউত কা টিলা নামে ধ্বংস-পাহাড়ের উর্দু সংস্করণও হয়েছিল।'

সেই যে শুরু হল তারপর আর বিরতি নেই। প্রচুর লিখেছেন। একের পর এক মাসুদ রানা, কুয়াশাসহ নানা স্বাদের থ্রিলার, রহস্য, রোমাঞ্চ কাহিনি লিখেছেন।

সমালোচকরা বলছেন বাংলা মৌলিক থ্রিলার সাহিত্যে আজ পর্যন্ত ধ্বংস পাহাড় আর ভারত নাট্যম'কে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। কাজী আনোয়ার হোসেন সেই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন। পাঠকের সীমাহীন আগ্রহ আর পাঠ তৃষ্ণার কথা মাথায় রেখে তিনি বিদেশি কাহিনি থেকেও অনুবাদ করে তা পাঠকের হাতে তুলে দিতে থাকলেন। তাঁর জাদুমাখা হাতে পড়ে বিদেশি থ্রিলার, রহস্য সাহিত্যের অ্যাডাপটেশন শুরু হল এদেশে। কিন্তু কেন? এরকম প্রশ্নের বিপরীতে তিনি জানিয়েছেন, 'ধ্বংস-পাহাড় ও ভারতনাট্যম প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের কাছ থেকে চিঠির পর চিঠি আসতে থাকল−আরও দ্রুত বই চাই। আর আমি তো বই লিখে ও প্রকাশ করে জীবিকা নির্বাহের কাজটি শুরু করেছি। একজন লোক একাধারে লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক ও ব্যবসায়ী। তাই নিয়মিত প্রকাশনা নিশ্চিত করতে বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে মাসুদ রানা লেখা শুরু। আমি কিন্তু এখানে কোনো রাখঢাক করিনি। তাই আজও বইয়ের গায়ে স্পষ্টভাবে লেখা হয় ‘বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে’। রানার কাহিনী সংগ্রহ করা হয়েছে অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিন, জেমস হেডলি চেজ, রবার্ট লুডলাম, উইলবার স্মিথ, ক্লাইভ কাসলার, হ্যামন্ড ইনস, ডেসমন্ড ব্যাগলি, ইয়ান ফ্লেমিংসহ অসংখ্য লেখকের বই থেকে। কিন্তু এই অ্যাডাপটেশন এতটাই নিজেদের মতো সাজিয়ে করা হয়েছে যে কোত্থেকে কাহিনিগুলো এলো তা আর ভাবতে ইচ্ছে করে না। যখন খুশি মূল থেকে সরে গিয়েছি বলেই গিলটি মিয়া, ইদু মিয়া, সোহেল, অনীতা গিলবার্টের মতো চরিত্রগুলোর সৃষ্টি হতে পেরেছে।'

বেশ অনেক বছর ধরে কাজী আনোয়ার হোসেন অভিমান নিয়ে নিজের জন্য একটা আলাদা জগত তৈরি করে নিয়েছিলেন। সে জগতে তিনি একান্ত নিজের মত করে থেকেছেন। দীর্ঘদিনের পরিচিতদের কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে খুব যাতনা দিয়েছে, পীড়া দিয়েছে। ফলে তিনি প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না। কথাও বলতেন না। সারাটা জীবন চারপাশের সবকিছুকে যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন ঠিক সেরকম করে সবকিছু প্রত্যক্ষ করে গেছেন। কাছের মানুষজন তাঁর এরকম নিজের মত করে থাকার জগতকে মেনে নিতে পারেননি। তারা মনে করেছেন এই আলাদা থাকার জগত বুঝি মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের আরেক রহস্যময় জগত।

কাজী আনোয়ার হোসেনের দীর্ঘদিনের একান্ত নিকটজনেরা বলছেন, কী এক অজ্ঞাত কারণে জীবনের শেষ ক'বছর তিনি সবকিছু থেকে নিজেকে ভীষণরকম গুটিয়ে নিয়েছিলেন। সব কিছু থেকে এভাবে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া নিয়ে নানাজনের নানারকম জিজ্ঞাসাও তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে কিন্তু তিনি তাতে কানে তুলতেন না। কাজী আনোয়ার হোসেন সবকিছু সয়েও নিয়েছিলেন।

জীবনের শেষ ক'বছরের তাঁর এই একান্ত আলাদা থাকার জগত কিংবা সবকিছু সয়ে যাওয়ার বিষয়টি কী নিতান্ত অভিমান থেকে! সারাজীবন যাদের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন প্রতিদানে তাদের দেওয়া অপমান, উপেক্ষাই কি এর কারণ!

গোস্ট রাইটার- এ ধারনাটি পৃথিবীর সব দেশে স্বীকৃত, প্রচলিত। মাসুদ রানা, কুয়াশা'র জন্মলগ্ন থেকেই একাধিক গোস্ট রাইটার ছিলেন যারা কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে সিরিজের কাজ করেছেন। গোস্ট রাইটাররাও এসব জেনেশুনে, বুঝেই এ কাজটি এতকাল করে এসেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তার কাছে এ নিয়ে দু-চারজন ইনিয়ে বিনিয়ে, বিড়বিড় করে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছেন। কাজী আনোয়ার হোসেন সেসব প্রশ্নের মুখে কোনোরকম ফাঁকফোকর রাখেননি। সাংবাদিক, লেখক আসজাদুল কিবরিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সেকথা বলেছেন। আসজাদুল কিবরিয়ার ‘আমরা জানি, একাধিক গোস্ট লেখক মাসুদ রানা লেখেন। এঁদের নাম বলবেন কি? বই নির্বাচন থেকে পুরো লেখার প্রক্রিয়াটি একটু বলুন’- এরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘আড়ালে থেকে মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের বই যাঁরা লিখেছেন তাঁদের অনেককেই তুমি চেনো। বিভিন্ন সময় যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা কমবেশি প্রাপ্তিযোগের প্রত্যাশাতেই লিখেছেন। তাঁরা সবাই বড় লেখক। অন্যের নামে লিখলেও নিজের নামে বই লেখার ক্ষমতা যে তাঁদের নেই, এমন তো নয়। তাঁদের নাম বলে দিয়ে তাঁদের প্রতি অবিচার করা কি ঠিক হবে?’

যিনি রানার কাহিনি লিখতে আগ্রহী, তিনি প্রথমে কোনো একটি ইংরেজি বইয়ের কাহিনি সংক্ষেপ জমা দেন। কাহিনি পছন্দ হলে আলোচনার মাধ্যমে তাঁকে বুঝিয়ে দিই কীভাবে কাহিনি এগোবে, রানা কীভাবে আসবে, কী করবে ও কী করবে না। মাসখানেক পরিশ্রমের পর তাঁর লেখা শেষ হয়, তখন পান্ডুলিপিটি আমি পড়ি। যেসব জায়গায় সংশোধন ও পরিবর্তনের প্রয়োজন, সেগুলো চিহ্নিত করে টীকাসহ লেখককে ফেরত দিই। তিনি আবার ঠিকঠাক করে দিলে চূড়ান্তভাবে আর একবার দেখি ও সম্পাদনা করি। এসবে আমার লেগে যায় পনেরো দিনের মতো। তার পরই রানা বই আকারে ছাপা হয়।’

বেশ কিছুদিন ধরে মাসুদ রানা, কুয়াশা সিরিজের লেখক সত্ত্ব নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত এক বিতর্ক কাজী আনোয়ার হোসেনকে খুব বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে তা অগণিত পাঠকদের কাছে তো বটেই স্বয়ং তাঁর জন্য তা লজ্জার বিষয়ে পরিণত হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর জীবনের সব স্বপ্ন-সাধ, আশা আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তিল তিল করে তৈরি করলেন লক্ষ লক্ষ পাঠকের প্রিয় মাসুদ রানা, কুয়াশা সিরিজ আর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার স্বত্বাধিকারী কে তা নিয়ে তাঁকেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হলো! দেশের মানুষ বিশ্বাস করে আদালতের চেয়ে বড় আদালত মানুষের বিবেক। মাসুদ রানা, কুয়াশার লেখক কে তা একমাত্র তার স্রষ্টাই জানেন।

অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের 'সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ'- কথাটি এখন প্রায় প্রবাদের মতই অবধারিত সত্য বলে দেশের মানুষ মেনে নিয়েছেন। এদেশে কাজী আনোয়ার হোসেনকেও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। হায় সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :