বাংলার শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বর্তমান

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২২, ১৫:২৮

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার

সৌভাগ্যক্রমে অগ্রজদের হাত ধরে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার যে রূপটি স্বাধীনতা-উত্তর আমরা পেয়েছিলাম, তা অনেক সমৃদ্ধ, যথেষ্ট উন্নত ও উচ্চ মানসম্পন্ন। বুদ্ধিজীবিতার চর্চাও যথেষ্ট উন্নত ছিল। এসব ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেক সহায়ক। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা মানুষের দৃষ্টিতে এসব চর্চাকারী মানুষের, অর্থাৎ সৃজনশীল মানুষদের সামাজিক মর্যাদার জায়গাটা ছিল প্রশংসনীয়। এই কাজে জড়িত মানুষজন- বিশেষ করে কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সংগীতশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, অভিনেতা- সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাদের অবদানের জন্য রাষ্ট্র ও মানুষের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা অর্জন করতেন। ফলশ্রুতিতে, সৃজনশীল ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করে যাওয়া সৃষ্টিশীল মানুষগুলো বেশ দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্রকে আগামীর দিকে পরিচালিত হওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক বেশি  সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন।

সাম্য-সম্প্রীতি, সঙ্গতি-অসঙ্গতি, রাজনীতি-অর্থনীতি অর্থাৎ মানুষের প্রয়োজনের প্রায় সব  অঙ্গেই এসব সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রভাব প্রতিফলিত হতো।

শিক্ষা গ্রহণ কিংবা শিক্ষা অর্জন করে সুস্থ-সুন্দর ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার প্রভাব সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এটি বিশ্বের সব ক্ষেত্রে সব সময়ের জন্য সমসাময়িক এবং একইভাবে প্রযোজ্য। একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের মানুষ কতটুকু ভালো বা মন্দ হতে পারে তার প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু সে সমাজ বা রাষ্ট্রের চলমান সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিলে তা অনুমান করা সম্ভব। এতটাই শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এটি, যার সফল চর্চা সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, বিপরীতে এর চর্চাবিমুখিতা মানুষকে অমানুষে পরিণত করতে পারে, যার  চূড়ান্ত পরিণতি একটি জনসমাজ বা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিতে পারে। এর শুভ প্রভাব যেমন খুব বেশি কল্যাণকর, তেমনি এর অভাব কিংবা বিমুখিতা চূড়ান্ত অমঙ্গলকে আলিঙ্গন করে।

সৌভাগ্যক্রমে আমাদের শুরুটা ভালো থাকলেও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে অনেক স্বেচ্ছাচারিতার প্রবেশ  এ অঙ্গনে ক্ষত তৈরি করা শুরু করে। ধারাবাহিকভাবে খানিকটা লম্বা সময় ধরে মূল সংস্কৃতির বিপরীতে অপসংস্কৃতি, মুক্ত সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ভীতি, ধর্মাশ্রয়ী নেতাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অকাট্য অপব্যবহার মুক্তমনা মানুষের স্বাধীন চর্চার উপরে তার স্থায়ী প্রভাব পড়ার সুবাদে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার সঠিক মূল্য নিরূপণে ও বিশ্লেষণে উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন। আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় এটুকু বলতে পারি, এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়।

আমাদের নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির যে আধারগুলো বিশ্বের যেকোনো দেশের মানুষের থেকে আমাদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রকাশ করেছে, তার প্রায় সবই বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিরপেক্ষতার আর কোনো জায়গা থাকল না। বাঙালিয়ানা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখতে থাকলেন কিছু বুদ্ধিজীবী। নিরপেক্ষ চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র ধারণ করে এ দেশের প্রায় সব শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীই হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে ধর্মাশ্রয়ী এবং পাকিস্তানি মতাদর্শের পক্ষভূক্ত হয়ে যার যার মতো অবস্থান নিয়ে নিলেন। একটি স্বাধীন দেশ হারাতে শুরু করল প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত সুশীল সমাজের ধারণাটি। ফলে সুশীল সমাজের মানুষগুলো একসময় সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের কাছে যত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মসম্মান লাভ করেছিলন, সেই জায়গাটি পর্যায়ক্রমে বিসর্জিত হতে থাকলো। চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে আজকের বাংলাদেশে সুশীল সমাজের গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধিত্ব বলে প্রায় কিছুই নেই।

তেমনি করে সমাজের সব স্তরে শিক্ষিত মানুষের গুরুত্বও লক্ষণীয় মাত্রায় লোপ পেতে থাকল। বর্তমান সমাজচিত্রে মূল্যবোধ, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাম্য ইত্যাদি অনেকখানি দূরে সরে গেছে। বরং মাঝেমধ্যেই সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা মাথা চাড়া দিচ্ছে, ক্রমশই তা ভয়ানক আকার ধারণ করছে। আর সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা দুর্বল হলে অপসংস্কৃতির স্পর্ধা কতটা বেড়ে যেতে পারে তার উদাহরণ আমরা বারবার যেমন প্রত্যক্ষ করেছি, তেমনি সমসাময়িক বর্তমানে এসে আরেকটি চূড়ান্ত পরিণতি আমরা অবলোকন করছি।

যে মহান নেতার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন, যার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই দেশ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে, সংবিধানের মূলস্তম্ভকে অস্বীকার করে, জাতির পিতার ভাস্কর্য তার মাটিতেই করতে দেয়া হবে না মর্মে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে কার্যক্রম চালিয়েছে একটি বিশেষ চিহ্নিত গোষ্ঠী। যেখানে রাষ্ট্রক্ষমতায় শপথ নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মনে রাখা দরকার, একটি ভাস্কর্য সে দেশের অতীত ঐতিহ্য, ইতিহাস, শিল্পগুণ এবং সমসাময়িক সময়ে ভাস্করের সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনাশক্তির পরিচায়ক এক দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন, যা ভবিষ্যত বিবেচনায় অতীত কর্মকাণ্ডের গবেষণা কাজের উপজীব্য এবং চলমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয়, অনন্য পথনির্দেশকও বটে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে চলমান সমাজব্যবস্থা এক্ষেত্রে যে উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে, তাতে করে ভবিষ্যতে যদি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির অপব্যাখ্যা দিয়ে কোনোদিন শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি স্থাপত্যকে আমরা চোখের সামনে বিনষ্ট হতে দেখি, তাতে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই দায়ভার শুধু রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের নয়, সমগ্র জাতিই এর জন্য দায়ী হয়ে থাকবে।

 

 লেখক: পুলিশ সুপার, কবি ও কণ্ঠশিল্পী