সেন্টমার্টিনে প্রভাবশালীদের রাজত্ব

প্রকাশ | ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১৪:২৯

ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দেশের সর্ব দক্ষিণে অবস্থিত দ্বীপটি ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামে খ্যাত। প্রতিবছর এই দ্বীপে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক আসেন। প্রবাল পাথুরে সৈকত, চোখ জুড়ানো নারিকেল বীথি, কেয়াবন, নীল জল দিগন্তসহ হরেক রকম নৈসর্গিক দৃশ্য একইসঙ্গে দেখা যায় এ দ্বীপে। এর সঙ্গে আছে মানববসতিহীন ছেঁড়া দ্বীপ। তারপরও যেন মানুষের কোনও অভাব নেই। পর্যটন মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ যায় এ দ্বীপে। পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনার এ দ্বীপে পর্যটকদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এখানকার বাসিন্দারা সুবিধাবঞ্চিত। বাইরের প্রভাবশালীরা শাসন করছে দ্বীপকে। বড় বড় হোটেল রিসোর্ট ও যাবতীয় ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষমতাসীনদের নাম ব্যবহার করে দখলে নিয়েছে।

সেন্টমার্টিনবাসীরা কেমন আছেন বা কেমন থাকেন, সর্বোপরি তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা কেমন তার খোঁজ হয়তো দুই দিনের অতিথিরা রাখেন না। তেমনি এই দ্বীপের মানুষের খোঁজ রাখেন না সরকার বা প্রশাসন- এমনই অভিযোগ এই দ্বীপবাসীর।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যটন সমৃদ্ধ হলেও যোগাযোগ, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক অনেক সমস্যা রয়েছে তাদের।

সেন্টমার্টিনবাসী অন্যতম প্রধান সমস্যা যোগাযোগ। টেকনাফের মূল ভূখণ্ড থেকে জাহাজে চড়ে দ্বীপে যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। আর কাঠের নৌকা হলে সেই সময় তিন/চার ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। ফলে যে কোনও জরুরি কাজে টেকনাফ ও জেলা সদর কক্সবাজার আসা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না।

বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে এমভি বে-ওয়ান নামে বিলাসবহুল জাহাজ, কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলী নামে তাদের আরেকটি জাহাজ চলাচল করছে। টেকনাফ দমদমিয়া ঘাট থেকে চলাচল করছে-কেয়ারী সিন্দাবাদ, কেয়ারী ক্রুজ এন্ড ডাইন, এমভি পারিজাত, এসটি সুকান্ত বাবু, এমভি বে-ক্রুজার-১, গ্রীন লাইন, এমভি ফারহান-২ ও এসটি ভাষা শহীদ সালাম। এসব জাহাজে প্রতিদিন অতিরিক্ত পর্যটন বহন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দমদমিয়া ঘাট ঘাটে গলাকাটা ইজারা আদায় করছেন বলেও পর্যটকরা জানিয়েছেন।

আবার টেকনাফ থেকে স্পিড বোট থাকলেও শুষ্ক মৌসুম ছাড়া তা চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা হলো মোটা অংকের জাহাজ ভাড়া। তার সঙ্গে রয়েছে ঘাটে চাঁদাবাজি। বর্তমানে স্পিডবোট ভাড়া যাওয়া-আসা জনপ্রতি ১২০০ টাকা। কোন ক্ষেত্রে তা তিন হাজার টাকা পেরিয়ে যায়।

কোনও পণ্য সেন্টমার্টিনে নিতে গেলে কেনা মূল্যের কাছাকাছি টোল দিতে হয় বলে অনেকের অভিযোগ। এ নিয়ে সাধারণ লোকজনের ‘কিছু বলার’ সুযোগ নেই। আর বললে ঘাট ওয়ালাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে দিগুণ মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হয় দ্বীপবাসীকে।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রকট সংকট। কারণ যোগাযোগ ও চিকিৎসা সংকট একই সূত্রে গাঁথা। দ্বীপে একটি মাত্র ১০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। তাতে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও সেই চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ইউনিসেফ ও আরটিএম নামে দুটি এনজিওর দুইজন এমবিবিএস চিকিৎসক রয়েছে। তারা হেলিয়ে দুলিয়ে কোয়ার্টারে অবস্থান করে কোন রোগী গেলে অসাধ্য বলে টেকনাফ-কক্সবাজারে স্থানান্তর করে।

এবার আসা যাক বিদ্যুৎ ব্যবস্থার কথায়। সেন্টমার্টিন পর্যটকদের জন্য আকষর্ণীয় হলেও এখনও পর্যন্ত দ্বীপে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও তা শুধুই পর্যটকদের জন্য। সৌর বিদ্যুতের দেখা মিললেও দরিদ্রতার কারণে অধিকাংশ মানুষ এর বাইরে। যা চলছে তা চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।

সেন্টমার্টিনে রড, সিমেন্টসহ আধুনিক নির্মাণ সামগ্রী নেওয়ার অনুমতি নেই। এতে করে অনেকে স্থাপনা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। তবে প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এ নিয়মের বালাই নেই। সাধারণ লোকজন না পারলেও প্রভাবশালীরা ঠিকই রড-সিমেন্টের বাড়ি করছেন। একইভাবে বহুতল ভবনের নির্মাণের নিয়ম না থাকলেও প্রভাবশালীরা বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। স্থানীয়দের বাধা দিলেও প্রভাবশালীদের বাধা দেয় না পরিবেশ অধিদপ্তর-এমন অভিযোগ করেছেন দ্বীপবাসী।

নবনির্বাচিত মেম্বার খোরশেদ আলম বলেন, ‘সেন্টমার্টিন আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট। কিন্তু সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের সে রকম কোনও পরিকল্পনা নেই। অথচ অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল।’ এভাবে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপটি হারিয়ে যাবে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা ও সংবাদকর্মী জয়নুল আবেদিন বলেন, ‘সেন্টমার্টিনকে ঘিরে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করছে। কিন্তু দ্বীপের উন্নয়নে কোনও উদ্যোগ নেই।’

তিনি আরো বলেন, দ্বীপের বাসিন্দারা কোন কিছু করতে চাইলে বাধা দেয় প্রশাসন। প্রভাবশালীরা বাহনা দিয়ে ঠিক বড় বড় দালান নির্মাণ করছে। এভাবে মূলত প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে গর্বের এ দ্বীপটি।

নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান ও সেন্টমার্টিন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমি সরকার দলীয় হলেও স্বীকার করতেই হচ্ছে দ্বীপবাসীর জীবনমান উন্নয়নের তেমন কিছু করা হয়নি।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের অনেক সমস্যা আছে। ঘাটে হয়রানি, নৌযান সমস্যা, দ্বীপের নিরাপত্তা। কিন্তু পরিবেশ সংকটাপন্ন হবে বিধায় অনেক কিছু করার থাকলেও করা যাচ্ছে না। আমি এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন মহলকে জানাব।’

টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে অনেক সমস্যা রয়েছে সেটা আমি জানি। আমরা চেষ্টা করছি সেসব সমস্যাগুলো নিরসন করতে। ক্রমান্বয়ে হয়ে যাবে।’

(ঢাকাটাইমস/২১জানুয়ারি/এলএ/এসএ)